ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ সেøাগানটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের সেøাগান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। শ্রমিক বা মেহনতী মানুষের অধিকার ও শ্রমের মর্যাদা ইসলাম তারও বহু পূর্ব থেকে নিশ্চিত করেছে। প্রথম মানব আদম আলায়হিস্ সালাম ও প্রথম মানবী হযরত হাওয়া আলায়হাস্ সালামকে জান্নাত থেকে যেদিন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হলো সেদিন থেকেই তাঁরা শ্রমনির্ভর হয়ে পড়লেন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড় চূড়ায় এবং হযরত হাওয়া আলায়হাস্ সালাম লোহিত সাগরের তীরবর্তী জেদ্দার বিরান ভূমিতে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাত-দিন আল্লাহ্র কাছে তাঁদের জান্নাতে থাকাকালে শুধুমাত্র একটি ভুলের জন্য মাফ চেয়ে কান্নাকাটি করেছেন। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রম করার স্পৃহা তখন থেকেই মানব-মানবী সত্তায় সঞ্চারিত হয়। যে কোনো কিছু অর্জনের জন্য শ্রম অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আদম-হাওয়ার সেই শ্রম বিফলে যায়নি। আল্লাহ্ তাঁদের তওবাকে কবুল করে মক্কা মুকাররমায় পুনর্বাসিত করেন। পৃথিবীতে প্রথম মানব-মানবী সংসার বাঁধেন। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য প্রয়োজন হয় শ্রমের। আল্লাহ্র ফেরেশ্তা জিব্রাঈল (আ.) হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে খাদ্য উৎপাদন, বস্ত্র বয়ন, গৃহনির্মাণ এবং মা হাওয়া আলায়হাস্ সালামকে বস্ত্র সেলাই, রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালন প্রভৃতির কায়দা-কানুন বাতলিয়ে দেন। তখন থেকেই উপার্জনে এবং সংসার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শ্রমের বা মেহনতের গুরুত্ব প্রকট হয়ে ওঠে। আদম-হাওয়ার বংশধারা বৃদ্ধি পেতে পেতে সমাজ, গোষ্ঠী, জনপদ গঠিত হতে থাকে। সবাই মিলেমিলে যৌথ শ্রমে খাদ্য সংগ্রহে, খাদ্য, উৎপাদনে এবং জীবিকার তাবত্ কিছুতে আত্মনিয়োগ করে এবং সমতার ভিত্তিতে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু কালক্রমে একপর্যায় এসে তাদের ভেতরে শক্তিধরের উদ্ভব ঘটে। ফলে সমাজের মানুষ শিকার করে আনে, ফসল উৎপাদন করে এনে তা জড়ো করে শক্তিধরের উঠোনে। শক্তিধরের কবজায় শ্রমজীবী বা মেহনতী মানুষের উৎপাদিত ফসল বিনাশ্রমে এসে যায় এবং সেই শক্তিধর ব্যক্তি বিনাশ্রমে ওগুলো সিংহভাগ আত্মসাত করতে থাকে। এমনি করে সমস্ত প্রথার উদ্ভব ঘটে, উদ্ভব ঘটে শোষক ও শাসকের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শ্রমিক উৎপাদন করে আর তার বেশিরভাগ ভোগ করে শোষক ও শাসক। ক্রমান্বয়ে রাজতন্ত্র এসে সব গ্রাস করতে থাকে। অথচ আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছেন। কেউ খাবে আর কেউ খাবে নাÑ এই অসমনীতির বিরুদ্ধে ইসলাম সোচ্চার হয়েছে এবং এমন এক সুষম ব্যবস্থা সুসংহত করেছে যার মাধ্যমে একটা ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতির বিকাশ লাভ করেছে। যে নীতিতে মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান ও বৈষম্য দূর করে ইনসাফ ও আদলভিত্তিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। মালিক পুঁজি বিনিয়োগ করে আর শ্রমিক বিনিয়োগ করে শ্রম। যে কারণে যে কোনো ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগকারীর অবদান যে রকম গুরুত্ব বহন করে, একই রকম গুরুত্ব বহন করে শ্রমিকের শ্রম। উৎপাদনে উভয়ের অবদানই সমান। আবার এটাও ঠিক শ্রমিকবিহীন কোনো উৎপাদনই সম্ভব নয় সেদিকটা বিচার করলে পুঁজিলগ্নিকারীর চেয়ে শ্রমলগ্নিকারীর অবদান বেশি। হযরত ‘আবদুল্লাহ্ ইবন্ উমর রাদিআল্লাহ্ তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খায়বারের বাগান ও জমি ইয়াহুদীদের দিয়েছিলেন এই শর্তে যে, তারা তাতে মেহনত করবে ও ফসল ফলাবে এবং তারা সেই ফসলের অর্ধেক পাবে। (বুখারী শরীফ)। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রদানের জোর তাকীদ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; তিনি বলেছেন : তোমরা যা খাবে যা পরিধান করবে তাদেরকেও তাই খেতে দেবে, তাই-ই পরতে দেবে। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় মালিকের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যেমনটা হবে, তেমনটা শ্রমিকেরও হতে হবে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যথাসময়ে শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক দিয়ে দেবার তাকীদ দিয়ে বলেন, শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাবার পূর্বেই তার ন্যায্য মজুরি দিয়ে দাও। (ইবনে মাজা)। হাদীসে কুদ্সীতে আছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, কিয়ামতের দিন আমি যে তিন ধরনের লোকের বিপক্ষ হবো তারা হচ্ছে : আমার নামে ওয়াদা করার পরে যে লোক তা ভঙ্গ করে, যে লোক আযাদ ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য খায় এবং যে লোক শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে তার দ্বারা নিজের কাজ আদায় করে নিয়ে তার পারিশ্রমিক দেয় না। (বুখারী শরীফ)। শ্রমিকের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নিয়ে তার যথাযথ মজুরি না দেয়া উপরিউক্ত হাদীস শরীফের মর্মানুসারে বড় গোনাহ্র কাজ, শুধু বড় গোনাহ্র কাজই নয়, কিয়ামতের দিন শ্রমিকের মজুরি না দেয়ার কারণে সে ব্যক্তি আল্লাহ্র শত্রু হিসেবে গণ্য হবে। ইসলাম শ্রমের মর্যাদা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, শ্রম না করে যারা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে তাদের ব্যাপারেও কঠোর শাস্তির কথাও ঘোষণা করেছে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রাদিআল্লাহ তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে লোক রুজি-রোজগারের জন্য শ্রমের পরিবর্তে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উত্থিত হবে যে, তার চেহারায় এক টুকরো গোশ্তও থাকবে না। (বুখারী শরীফ)। এই হাদীসখানি দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শ্রমবিমুখ মানুষের রোজহাশরে বিকৃত ও হাড্ডি সর্বস্ব কঙ্কাল চেহারা হবে। হাদীস শরীফে আছে যে, হযরত আনাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু বলেন যে, একবার আনসারদের অন্তর্ভুক্ত এক ব্যক্তি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকটে এসে ভিক্ষা চাইলে তিনি বললেন : তোমার ঘরে কি কিছুই নেই? সে বললো : জি, হ্যাঁ, একটি কম্বল আছে যার একটি অংশ বিছিয়ে শুই আর একটি অংশ গায়ে দেই। আর একটি পানি পান করার জন্য লোটা আছে। হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম লোকটিকে ঐ দুটো জিনিস নিয়ে আসতে বললে সে তা নিয়ে আসলো। তখন হযরত রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তা হাতে তুলে নিয়ে বললেন : এই দুটো জিনিস কিনে নেবার মতো কেউ কি আছো? উপস্থিত সাহাবীগণের মধ্যে থেকে একজন বললেন : আমি এক দিরহামের বিনিময়ে ঐ দুটো জিনিস কিনতে রাজি আছি হযরত রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : এর চেয়ে বেশি দামে কেউ কি খরিদ করার আছে? এভাবে তিনি দুই বা তিনবার বললেন। এক ব্যক্তি বললেন : আমি দুই দিরহাম মূল্য দিয়ে তা কিনতে রাজি আছি। হযরত রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম দুই দিরহামের বিনিময়ে লোকটিকে জিনিস দুটো দিয়ে দিলেন। তারপর দিরহাম দুটো আনসার লোকটির কাছে দিয়ে বললেন : এক দিরহাম দিয়ে খাবার-দাবার কিনে নিজ পরিবারের কাছে যাবে, আর অন্য একটি দিরহাম দিয়ে একটি কুড়াল কিনে আমার কাছে নিয়ে আসবে। লোকটি একটি কুড়াল কিনে হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট নিয়ে আসলো। হযরত রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে কুড়ালটির একটি হাতল লাগিয়ে দিয়ে বললেন : যাও এই কুড়াল দিয়ে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বিক্রি কর গিয়ে। আমি যেন পনেরো দিনের মধ্যে তোমাকে না দেখি। অতঃপর লোকটি জঙ্গলে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে এনে তা বিক্রি করে দশ দিরহাম আয় করলো। এই উপার্জিত দিরহামের কয়েকটি দ্বারা খাবার-দাবার ও কাপড়চোপড় খরিদ করলো। সে হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হলো। তখন হযরত রসুলুল্লাহ (সা) বললেন : কিয়ামতের দিন তোমার চেহারায় ভিক্ষা করার কারণে যে বিশ্রী দাগ পড়তো তার চেয়ে এটা তোমার জন্য উত্তম পন্থা। (আবু দাউদ শরীফ)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন : যে ব্যক্তি ভিক্ষা করে সে নিজের চেহারাকে নিজেই ক্ষত-বিক্ষত করে। (আবূ দাউদ শরীফ)। আমরা যদি নবী-রসুলগণের জীবনী পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব তাঁরা সবাই পরিশ্রমী ছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে যে, কানা দাউদু র্যারাদান্ ওয়া কানা আদামু র্হারাছান্ ওয়াকানা নূহুন নাজ্জারান্ ওয়া কানা ইদ্রীসু খায়ইয়াতান্ ওয়া কানা মূসা র’ইইয়ান-হযরত দাউদ ছিলেন বর্ম প্রস্তুতকারী, আদম ছিলেন কৃষিজীবী, নূহ ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, ইদ্রীস ছিলেন দর্জি এবং মূসা ছিলেন রাখাল। হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : পৃথিবীতে আল্লাহ্ এমন কোনো নবী পাঠাননি যিনি বকরি চরাননি। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন : আপনিও কি! তিনি বললেন : হ্যাঁ, আমি কয়েকটা কীরাতের বিনিময়ে মক্কার লোকদের ছাগল চরাতাম। (বুখারী শরীফ)। শ্রমজীবী মানুষের মেহনতে বিশ্ব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আমি (আল্লাহ্) মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে। (সূরা বালাদ : আয়াত ৪)। ১ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই দিবসের উদ্ভব তা ঘটছিল ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে চলা শ্রমিক ধর্মঘটের সময় মালিকদের লেলিয়ে দেয়া পোষ্য গু-া ও পুলিশ বাহিনীর আক্রমণে নিহত ৬ শ্রমিকের স্মরণে। সেই আন্দোলনের যাঁরা নেতা ছিলেন তাঁদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফাঁসির হুকুম দেয়া হয়। এই ফাঁসির বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেক সোচ্চার হয়ে ওঠে। মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ’ও জোরালো প্রতিবাদ জানান। সেই জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেছেন : ওভ ধষষ ঃযব ড়িৎষফ ধিং ঁহরঃবফ ঁহফবৎ ড়হব ষবধফবৎ ঃযবহ গঁযধসসধফ ড়িঁষফ যধাব নববহ ঃযব নবংঃ ভরঃঃবফ সধহ ঃড় ষবধফ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষবং ড়ভ াধৎরড়ঁং পৎববফং, ফড়মসধং ধহফ রফবধং ঃড় ঢ়বধপব ধহফ যধঢ়ঢ়রহবংং- নানা ধর্মমত, ধর্ম বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মানুষকে শান্তি ও সুখের দিকে পরিচালিত করার জন্য গোটা পৃথিবীটাকে যদি একত্র করা হতো তাহলে হযরত মুহম্মদ (সা.)-ই হবেন সর্বোত্তম যোগ্য নেতা। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×