ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টেকসই উন্নয়ন ॥ নতুন কর্মসৃজন ও চাকরিচ্যুতি বন্ধকরণ দরকার

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

টেকসই উন্নয়ন ॥ নতুন কর্মসৃজন ও চাকরিচ্যুতি বন্ধকরণ দরকার

শাক-সবজি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যে উর্ধগতির বিপরীতে একটা ভাল খবর আছে। খবরটি ফসলের। এখন বোরো ফলনের সময়। ইতোমধ্যেই দেশের সর্বত্র কৃষকরা বোরো ধান কাটা শুরু করে দিয়েছে। সরকারী আভাস অনুযায়ী এবারও ফলন হবে খুবই ভাল, যদিও সিলেটের কিছু অঞ্চলে বোরোর সামান্য ক্ষতি হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এবার কম জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে, কিন্তু ফলন হবে ‘বাম্পার’। ৪৮ লাখ হেক্টরের স্থলে বোরো করা হয়েছে ৪৬ লাখ ৮৫ হাজার হেক্টরে। এতদসত্ত্বেও ফলন হবে ১ কোটি ৯০ লাখ টন। সর্বোচ্চ ফলন। বোরোই এখন সবচেয়ে বড় ফসল। আগে ছিল আমন সবচেয়ে বড়, তারপরে আউশ। এখন ফলনের ক্রম হচ্ছে বোরো, আমন ও আউশ। আশা করা হচ্ছে এবার সর্বমোট চাল উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন। ভাবা যায়! স্বাধীনতার আগে সর্বমোট চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি টনেরও কম। এখন খাদ্যের অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে, সমস্যা হয়েছে সরকারী গুদামের। গুদামের অভাব, রক্ষণাবেক্ষণের গুণগতমান রক্ষার সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা উৎপাদনের পরিমাণ রক্ষা করা। ভূগর্ভস্থ জলের স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, বৃষ্টির জল নেই। অথচ জল ছাড়া, সেচের জল ছাড়া ধানের উৎপাদন স্তর রক্ষা করা কঠিন। তৃতীয় সমস্যা কৃষি শ্রমিকের সমস্যা, গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজে পুরুষ শ্রমিক হ্রাস পাচ্ছে। চতুর্থ সমস্যা বিনিয়োগ সমস্যা। কৃষিতে এখন যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়, সার প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। বিদ্যুতের জন্য অবকাঠামো লাগে। রাস্তাঘাট, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ইত্যাদির জন্য টাকা লাগে। অথচ বিনিয়োগ কৃষিতে কম। সরকারী বিনিয়োগ/বরাদ্দ শতাংশের হিসেবে হ্রাসমান। আরেকটি বড় সমস্যা কৃষকের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি সমস্যা ও কৃষি বীমা। অবশ্য ফসল তোলার সময় বড় সমস্যা এই মুহূর্তে দুটি। পুরনো স্টক বিদায় করা এবং নতুন ধান-চাল সংগ্রহ করে তা গুদামে রাখা। এবারের সমস্যা আরও বড়। সমালোচনা ছিল সরকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল কেনে না। কেনে ফড়িয়াদের কাছ থেকে, মিলারদের কাছ থেকে। এতে কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না। সরকার, দেখা যাচ্ছে, এবার ধান-চাল কিনবে কৃষকের কাছ থেকে। সরাসরি ক্রয়। কঠিন কাজ। ধান কেনা হবে ৭ লাখ টন এবং চাল কেনা হবে ৬ লাখ টন। কেনা হবে মে মাসের ৫ তারিখ থেকে আগস্টের ৩১ তারিখের মধ্যে। মূল্য কত? ধান কেনা হবে ২৩ টাকা কিলোতে এবং চাল কেনা হবে ৩২ টাকা কিলোতে। সরকারী হিসাবে এতে কৃষকের কিলোপ্রতি দুই-তিন টাকা লাভ হবে। ধান-চাল সংগ্রহের সঙ্গেই লুক্কায়িত প্রশ্নÑ পুরনো স্টকের কী হবে? ধান-চাল দীর্ঘদিন স্টকে ধরে রাখা যায় না। এসব নিয়মিত বাজারজাত করে শেষ করতে হয়। নতুবা পোকা-মাকড়ে তা নষ্ট করে। নষ্ট হয় খাদ্যগুণ। কাগজে দেখলাম কোন কোন ‘অর্থনীতিবিদ’ চাল রফতানির বিরুদ্ধে। বিকল্প থাকে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাল বিক্রি করা। মৌসুম অথবা মৌসুমের বাইরের সময়ে খোলাবাজারে অধিকতর মাত্রায় ধান-চাল বিক্রি করলে চালের বাজার পড়ে যেতে পারে। ফল? ফল হবে কৃষকরা এই ফসল থেকে অন্য ফসলে চলে যাবে। এখন আগের দিন নেই। বাংলাদেশে ফলনের ‘ইনটেনসিটি’ এখন সর্বোচ্চÑ বছরে প্রায় দুই ফসল। উপরন্তু নানা জাতের শাক-সবজি, ফলমূল হচ্ছে। কৃষক জমিকে পুকুরে রূপান্তর করে মাছও চাষ করতে পারে। ভীষণ খবর, সিলেটের মতো জায়গায় ভুট্টাও হচ্ছে। অতএব চালের মূল্যকে স্থিতিশীল রাখা, কৃষকের কাছে লাভপ্রদ রাখা এখন এক কঠিন সরকারী সংগ্রাম। এসব বিবেচনা করেও কেন কেউ কেউ চাল রফতানির বিরোধিতা করছেÑ তা আমার বোধগম্য নয়। চালের বাজারকে মন্দা রেখে, অতীব মন্দা রেখে কৃষকদের অন্য ফসলে নিয়ে পুষ্টির সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থেকে কী চাল রফতানির বিরোধিতা? জানি না। তবে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার, আজকের জন্য যেমন, আগামী দিনের জন্যও তেমনি। ভারতে বহু লোক অভুক্ত থাকে, দারিদ্র্যসীমার নিচেও অনেক লোক। কিন্তু তবু তারা চাল, গম রফতানি করে। এসব থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার। চালের প্রসঙ্গেই এ সপ্তাহেও সরকারকে দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য তাগিদ দিচ্ছি। রোজা এবং বাজেট একসঙ্গে। ঈদও সামনে। ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীরাÑ আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী সবাইÑ ওঁৎ পেতে বসে আছে বাজারকে অস্থিতিশীল করার জন্য। এমনিতে সন্ত্রাসী কর্মকা-, হত্যাকা- ঘটিয়ে ইতোমধ্যেই আতঙ্কের সৃষ্টি করা হয়েছে। আগামী দিনে কী করবে জানি না। যদি হত্যাকা-ের ঘটনা বাড়ে এবং তার সঙ্গে অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে তা কিন্তু অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। অতএব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের স্টক ও তার বণ্টনের দিকে নজর দেয়া দরকার। ধান-চালের খবর ভাল, কিন্তু আরেকটা খবর খারাপ। খারাপ খবরটা এমন খারাপ যে, তা না হলে ধান-চাল কেনার লোক থাকবে না। খবরটা হচ্ছে কর্মসংস্থানের। বুধবারের একটা খবরে দেখলাম ‘দেশে বেকারত্ব বাড়ছে।’ খবরটি পড়ে কিছুই বুঝলাম না। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। এর আগের দুই বছর প্রবৃদ্ধির হার ছিল সাড়ে ছয়-পৌনে সাত শতাংশ। এই খবরের সঙ্গে বেকারত্ব বাড়ার খবর মানানসই নয়। এখন কী করে বলি বেকারত্ব বাড়ার খবরটি ঠিক নয়। কারণ, খবরটির সূত্র সরকারী অর্থাৎ বিবিএস (ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস)। তথ্যে বলা হচ্ছে ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অর্থাৎ দুই বছরে মাত্র ৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দুই শতাংশ বৃদ্ধি ধরলে ১৬ কোটি লোকের দেশে নতুনভাবে চাকরির বাজারে ঢুকেছে ৩২ লাখ লোক, আর দেড় শতাংশ ধরলে কর্ম প্রার্থীর সংখ্যা হবে ২৪ লাখ। ৪৮ লাখ লোকের মধ্যে যদি ৬ লাখের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে তাহলে তো বিপর্যয়কর অবস্থা! তাই নয় কী? খবরটিতে বলা হয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর চাকরি বা কাজ পেয়েছিল ১৩ লাখ ৮০ হাজার লোক। একবার কাগজে দেখেছিলাম এসব খবরকে ভিত্তিহীন বলে পরিকল্পনা কমিশনের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা উড়িয়ে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় অনেকদিন ধরেই আমি ভাবছিলামÑ কোনটা সত্য? বুধবারের দৈনিক জনকণ্ঠের একটি খবর আমার নজরে পড়ল। খবরটির শিরোনাম : ‘চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমেছে’। খবরটির ভেতরে বলা হয়েছে ২০১০ সালে ২৯৮টি নতুন প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে বিনিয়োগ হয়েছে ৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। এই বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩০ হাজার ৬৪৯ জনের। সেইস্থলে ২০১৫ সালে ১২১টি নতুন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। আর ঐ বছরে কর্মসংস্থানের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯ হাজার ৩৪২ জন। খবরটিতে আরও বিস্তারিত তথ্য আছে। বলা হয়েছে, জমি ও গ্যাস স্বল্পতার কারণেই তা হয়েছে। অনুমান করা যায়, এসব খবর সংগঠিত খাতের (অর্গানাইজড সেক্টর)। গ্যাস ও জমি সঙ্কট রয়েছে দেশের সর্বত্র। জমি সঙ্কটের কথা অর্থমন্ত্রী আবুল আল আবদুল মুহিত মঙ্গলবার হংকংয়ের এক শীর্ষ সম্মেলনেও বলেছেন। আমরাও সাদা চোখে তা দেখতে পাচ্ছি। বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর হাতে হাজার হাজার একর জমি বন্দী। সারাদেশে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী লোক জমি হস্তগত করে নিচ্ছে, পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে শিল্পের জমি নেই। যদি তাই হয় অবস্থা তাহলে বলা যায়, সারাদেশের একই চিত্র। বিনিয়োগও কম, কর্মসংস্থানও কম। এটা সকল তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কর্মসংস্থানের তথ্য হবে ইতিবাচকÑ তা আশা করা অবান্তর। এমনিতেও দেখা যাচ্ছে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো হরে-দরে ছেলেমেয়েদের চাকরি খাচ্ছে। দেশের বেসরকারী ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এবং অন্যান্য জাতের কোম্পানির খবরও তাই। শত শত, হাজার হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি যাচ্ছে নিয়মিত। মধ্যবয়সে বেকার। এসব হচ্ছে চাকরিচ্যুতি অর্থাৎ নতুন চাকরি তো নয়ই, পুরনোদের চাকরিচ্যুতি। অসংগঠিত খাতের অবস্থা একই হওয়ার কথা। বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান কোত্থেকে আসবে? অতএব প্রশ্ন : চাল কিনবে কে? অর্থাৎ বাজার (মার্কেট) কিভাবে সৃষ্টি হবে? নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যাদি, শাক-সবজি, দুধ-মাছ-মাংস, ফলমূল কেনার জন্য দরকার দেশীয় ক্রেতা। এসব আমেরিকার ক্রেতারা কিনবে না। অভ্যন্তরীণ বাজার যদি সৃষ্টি না হয় এবং তা ধীরে ধীরে বড় না হয় তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হবে কী হবে? টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার ক্রয়ক্ষমতা, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ক্রয়ক্ষমতা আসবে নতুন কর্মসংস্থান থেকে, চাকরিচ্যুতি বন্ধের মাধ্যমে। অতএব আবার বলছি চাল, শাক-সবজি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, ফলমূল, মাছ-মাংস ও দুধ ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করা দরকার এবং দরকার ক্রয় ক্ষমতা (কর্মসংস্থান)। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×