ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাজ্জাদ কাদির

বিকৃত ইতিহাস ও মিথ্যাচারে আক্রান্ত এক প্রজন্ম

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

বিকৃত ইতিহাস ও মিথ্যাচারে আক্রান্ত এক প্রজন্ম

১৯৭৫ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, নেতৃত্ব, অর্জন নিয়ে কোন গোষ্ঠী তেমন জোরালোভাবে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। যদিও উগ্র বামপন্থী চিন্তাধারার একটি গোষ্ঠী পানি ঘোলা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেনি। ঘটনা ঘটে ’৭৫ পরবর্তী সময়ে। ’৭৫-এর ট্র্যাজেডি যে ছিল দেশী-বিদেশী নানা অপশক্তির গভীর চক্রান্তের ফসল তা সচেতন মহল মাত্রই বোঝেন। নিজেকে প্রশ্ন করুন তো যে, আপনার সঙ্গে কোন একটি কাজে আর একজন অংশীদার ছিলেন। কিন্তু নানাভাবে আপনাকে ঠকানোর কারণে আপনারা আলাদা হয়ে গেলেন। আলাদা হয়ে যাবার পর আপনার ঐ ঠকবাজ অংশীদারটি কি চাইবে যে, আপনি সঠিকভাবে আপনার কাজ চালিয়ে যান? নিশ্চই নয়। তাই যদি হতো তাহলে পাকিস্তান বাংলাদেশে দূতাবাস খোলে ১৯৭৬-এ, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে কেন? সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ’৭৫-এর ১৬ আগস্ট কেন? আমি নিশ্চিত আপনি যদি গভীরভাবে ভাবেন তাহলে আপনার মাথায় এরকম নানান ভাবনা ঘুরপাক খাবে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে এদেশে লঙ্কাকা- বাধিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলাও করে প্রচার করা শুরু“হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এর নেতৃত্বকে হেয় করার মাধ্যমে একটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রজন্ম তৈরির জন্য এই শক্তি পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ক্রমাগতভাবে বিকৃতি ঘটাতে থাকে। ১৯৭৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কোন বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭৮-৭৯ সালে পাঠ্যপুস্তকে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের সঙ্গে ২৭ মার্চ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমানের একটি ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৯১ সালের পর এম এ হান্নানের নাম পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। জিয়াউর রহমানের ছবি ও নাম বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর চারদলীয় জোট সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকে সম্পূর্ণরূপে বঙ্গবন্ধুকেই সরিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমানকে এককভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। জিয়াউর রহমানকে ‘সময়ের সাহসী সন্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে গোটা মুক্তিযুদ্ধ তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছেÑ এমনটিই পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরা হয়। সেনাবাহিনীর একজন মেজর যিনি অপেক্ষাকৃত জুনিয়র একজন কর্মকর্তা। এরকম একটি পদে থেকে স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে যাওয়া যায় কিনা? বিশেষ প্রেক্ষাপটে সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একটি বার্তা পাঠ করেছিলেন মাত্র। যে বার্তায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখও আছে। অথচ কী দুঃসাহস ভাবা যায়? এদেশের মানুষকে কতটা মূর্খ ভেবে একটি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে এই গোষ্ঠীটি দিনের পর দিন শোষণ করেছে। ‘জয় বাংলা’ যেটি কোন দলের সেøাগান নয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন এদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণাদানকারী এক অবিস্মরণীয় সেøাগানের নাম। সেই ‘জয় বাংলা’কে দলীয় সেøাগান হিসেবে প্রচার করে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারার জিন্দাবাদের আমদানি ঘটে। একটি দীর্ঘ সময় গেছে এদেশের মানুষকে দলমতের উর্ধে উঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘জয় বাংলা’ বলতে দেয়া হয়নি। ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিনিয়ত হেয় করা হয়েছে। যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলার মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য বারবার জেলে যেতে হয়েছে। ৫৫ বছরের (১৯২০-১৯৭৫) জীবনে তিনি মোট বার বছর জেল খেটেছেন। তাই তিনি হাসতে হাসতে প্রায়ই বলতেন, ‘জেলখানা আমার দ্বিতীয় বাড়ি। আমাকে ঘন ঘন সেখানে যেতে হয়। যার দুই বাড়ি তার শুধু এক বাড়িতে থাকলে চলে না, দুই বাড়িরই খোঁজখবর রাখতে হয়।’ ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা চারদলীয় জোট সরকার সেই বঙ্গবন্ধুকে ’৭১-এ পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণকারী, সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারতে পলায়নকারী হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে উপস্থাপন করে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালকে নিয়ে ব্যাংক ডাকাতি ও বঙ্গবন্ধুর খুনী মেজর ডালিমের স্ত্রী অপহরণকারী এ রকম দুটি মিথ্যাচার ’৭৫ পরবর্তী সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে শেখ কামাল ছিলেন একজন সংস্কৃতমনা মানুষ। গান, নাটক, খেলাধুলা সবই ছিল তাঁর নেশা এবং সেই অনুযায়ী তিনি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে এসব কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক অনন্য উজ্জ্বল নাম। অথচ তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে হেয় করার সকল প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। সত্য ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। যে রাতে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে সে রাতে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর ব্যাংক লুটের ষড়যন্ত্রের খবরটি কামাল আগেই জানতে পেরেছিলেন তাঁর সদ্য গঠিত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের ফকিরাপুলে অবস্থানকারী দুজন খেলোয়াড়ের মাধ্যমে। দুষ্কৃতকারীদের ধরার জন্য তিনি মতিঝিল এলাকায় জিপে করে ছুটে যান কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আবাহনী মাঠের রাতের আলোচনা বৈঠক থেকে। তাঁর মাধ্যমে খবর পেয়েই ঢাকার পুলিশ সুপার বীর বিক্রম মাহবুবের পুলিশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে দুজনকে পায়ে গুলিবিদ্ধ করে। আর শেখ কামাল দুষ্কৃতকারীদের ধরার জন্য জিপ থেকে লাফ দিলে রাস্তায় পড়ে যান। এই ঘটনার মূল সত্য কাহিনী পরেরদিন ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’-এ প্রকাশিত হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের কুৎসার নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল সত্য ঘটনা। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে ডালিমের সম্পৃক্ততা বোঝানোর জন্য আর একটি মিথ্যা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। অথচ যে বিষয়টি শেখ কামাল ভাল করে জানতেনও না। কিন্তু ডালিম নিজেই তার লেখা ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইতে এই বিষয়ে স্পষ্ট করে লিখেছেন সেদিন কি ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার দিন ঢাকা লেডিস ক্লাবে ডালিমের খালাত বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে সামরিক-বেসামরিক অনেক লোক উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও রেডক্রসের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার পরিবার। ডালিমের কানাডা ফেরত শ্যালক বাপ্পির চুল টানা নিয়ে গাজীর ছেলেদের সঙ্গে কথা কাটাকটি ও হাতাহাতি হয়। বিষয়টির ব্যাপারে সশস্ত্র লোকজনসহ ক্লাবে এসে ডালিম, ডালিমের স্ত্রী ও তাদের পরিবারের আরও কয়েকজনকে উঠিয়ে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর হাতেই নিষ্পত্তি হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে এসেছে শেখ কামালের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগ নেতাদের মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে প্রচারণা চালানো হয় দীর্ঘ সময়। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি প্রচার করত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি দেয়া হবে। ইসলাম ধর্ম বলে এই দেশে কিছু থাকবে না। শেখ হাসিনাকে ইসলামবিদ্বেষী বলে প্রচার করা হয় ব্যাপকভাবে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে, পরে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে পুনরায় সরকার গঠন করে এখন পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করছে। কোথায় সেই উলুধ্বনি? বরং মসজিদ তার যথাযথ পবিত্রতা নিয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আওয়ামী লীগ নেতারাও প্রয়োজনমতো ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন। ইসলাম ধর্মও বর্তমান বাংলাদেশে যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে আছে। আর শেখ হাসিনা পাঁচ ওয়াক্তসহ তাহাজ্জুত নামাজও পড়েন, নিয়ম করে কোরআন শরীফ পাঠ এবং পুরোপুরি ইসলামী জীবনবিধান মেনে চলার চেষ্টা করেন। সরকারপ্রধান হিসেবে বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি একজন মুসলমান এবং মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দুবার নয়।’ বঙ্গবন্ধু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের জন্য নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে এরকম একটি প্রচারণাও চলেছে এদেশে ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ সময়। অথচ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তি করতে সক্ষম হয়। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিশী আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সাড়ে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার নতুন সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়। বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে ১৯,৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পায়। ৬৮ বছর ধরে যাদের রাষ্ট্র ছিল না, ছিল না পরিচয়, সবাই যাদের চিনত ছিটবাসী হিসেবে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে সেই তাদের জাতীয়তার পরিচয়, নাগরিকত্বের পরিচয় চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করে ২০১৫ সালে? ১৯৭১ সালে ভারত অপার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিলে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ আরও দীর্ঘ হয়ে যেতে পারত। এ প্রসঙ্গেও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের খানিকটা উল্লেখ করবার প্রয়োজন মনে করছি। এরকম নানান মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালিয়ে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছিল। ২০০১ সালে আবারও ছন্দপতন। কারণ তখনও অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগের সূচনা হয়নি। এদেশের শান্তিকামী সহজ-সরল মানুষকে এই গোষ্ঠীটি যা বুঝিয়েছেন তাই বুঝেছে এবং সেই অনুযায়ী ভোটের রাজনীতিতে রায় দিয়েছে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে এদেশের বর্তমান প্রজন্ম। অবাধ তথ্যপ্রবাহের কারণে প্রতিনিয়ত প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন হচ্ছে। সেই অনুযায়ী আজকের প্রজন্ম সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে কাকে গ্রহণ আর কাকে বর্জন করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিটির মনে রাখতে হবে চাঁদে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে দেখা যাওয়ার মিথ্যা প্রচারণা, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ফোন করে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খোঁজ নেয়ার মিথ্যা প্রচারণা, খালেদা জিয়াকে নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের ছয় সদস্যের ভুয়া বিবৃতির মিথ্যা প্রচারণা আজকের প্রজন্ম মোটেই গিলবে না। লেখক : সাংস্কৃতিক কর্মী
×