ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াহিদ নবি

বিএনপির কার্যকরী কমিটি এবং কিছু প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

বিএনপির কার্যকরী কমিটি এবং কিছু প্রসঙ্গ

বিএনপির কাউন্সিল শেষ হয়েছে এক মাসেরও বেশি। এখানে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল কমিটি গঠনের। একটা স্তর পর্যন্ত পদ বণ্টনের তালিকা প্রকাশ করা গেলেও এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটির নাম প্রকাশ করা হয়নি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন মনে জাগে যে কি হচ্ছে? একজনের হাতে সব দায়িত্ব অর্পিত হলে মনে হয় যে অনেক জটিলতা এড়ানো যাবে। কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। বাস্তবে তাই হয় কি? বিশেষ করে যেখানে বড় ব্যাপার জড়িত আর যেখানে বহুজন জড়িত! আসলে শুধু একজন সব কাজ করতে পারে না। দলীয় ব্যাপার তো পারেই না। এমনকি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একনায়কেরও একদল উপদেষ্টা জুটে যায়। তারা উপদেশ দেয় কিন্তু নেপথ্যে আরও অনেক কিছু ঘটতে থাকে। উপদেষ্টাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। কার কথা নেতা বেশি শোনেন এই নিয়ে শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রেই উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে এবং নানাভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। অনেক সময় আসল নেতাকে সামনে রেখেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয় কোন কোন ষড়যন্ত্রকারী। অনেক নোংরা ব্যাপার-স্যাপারও ঘটতে থাকে সেখানে। গুজব এমন যে তারেক রহমান আর খালেদা জিয়ার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কমিটি গঠন নিয়ে। তারা মা ছেলে হওয়ায় তাদের নামের শেষ অংশ এক হওয়া উচিত ছিল কিন্তু এটা তাদের ব্যাপার। শোনা যাচ্ছে, দু’জনের দ্বিমতের বড় কারণ হচ্ছে তারেকের নিজের পদ নিয়ে। কিছুদিন থেকে শোনা যাচ্ছিল যে দলের সংবিধান পরিবর্তন করে ‘কো-চেয়ারম্যানের’ একটি পদ সৃষ্টি করা হবে এবং ঐ পদটি তারেককে দেয়া হবে। এখন পর্যন্ত তেমনটি হয়নি। এতে করে তারেক অভিমান কিংবা হয়ত রুষ্ট হয়েছেন। কো-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করে তারেককে সেটি দিলে সাধারণ মানুষের চোখে সেটি যেমন দেখাত? সাধারণ চোখে মনে হতো যে দলের দু’জন নেতা। যার মধ্যে একজন আজ আট বছর বিদেশে। তার কাছে পৌঁছাতে পারে শুধু ‘বড়রা’। কিছুদিনের ভেতর দলের মধ্যে অবশ্যই অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠত। পরিবারতন্ত্রের ব্যাপারটা আরও আলোচিত হতো। দুই চেয়ারপার্সনের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতো। দুই ধরনের মানুষেরা দু’জনের কাছাকাছি হতো। নানা সমস্যার সৃষ্টি হতো এতে করে। তারেক জিয়ার এখন যা বয়স তাতে করে তাকে এখন আর তরুণ বলা যায় না কিন্তু তার তরুণ অনুসারীরা রয়েছে বলে শোনা যায়। তরুণদের শক্তি ও উৎসাহ বেশি। প্রবীণরা তাদের সঙ্গে মিলে মিশে চলতে পারতেন কিনা কে জানে। এসব এবং অন্যান্য কারণে হয়ত খালেদা জিয়া কো-চেয়ারম্যান পদটির দিকে যাননি। আমরা জানি না তারেকের ব্যক্তিগত খ্যাতির কথা তার মা বিবেচনা করেছেন কি-না! মানুষের ধারণা একটা অদ্ভুত জিনিস। সত্য সময় ধারণার পিছনে থাকে না। কিন্তু রাজনীতিতে মানুষের ধারণাকে অবজ্ঞা করা যায় না। বিএনপি দলের একজন প্রাক্তন সাংসদ, প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা, উচ্চকণ্ঠ এবং টকশোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে থাকেন। একদিন এক টকশোতে বলেছিলেন যে, ‘আমরা ম্যাডামকে বলেছিলাম যে আপনার ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে।’ তারেক রহমানের কথা উঠলেই অনেকে দুটি শব্দ মনে করেন আর সে দুটি হচ্ছে ‘হাওয়া ভবন’। তার সঙ্গীদের মনে হলে একজনের কথা অনেকের মনে পড়ে আর তার নাম গিয়াস উদ্দিন মামুন। তার ব্যবসা বাণিজ্যের কথা উঠলেই একটি শব্দ অনেকের মনে পড়ে আর সেটি হচ্ছে ‘খাম্বা’। অনেকে বলেন, মাতৃস্নেহে খালেদা জিয়া তারেকের প্রতি অন্ধ। কিন্তু তিনি হয়ত বুঝেন যে দৃষ্টিহীনতার কারণে দল ডুবে গেলে তার স্নেহ ছেলেসহ কারও কাজে আসবে না। এসব অবশ্য আমাদের ধারণা। কেন তিনি তারেককে কো-চেয়ারপার্সন করেননি তা তিনিই জানেন। নানা রকমের কথা শুনেছি আমরা। তারেক নাকি সিনিয়র নেতাদের গায়েই লাগাতেন না। তিনি নাকি একজন জেনারেলের গালে চড় মেরেছিলেন ইত্যাদি। অতি দীর্ঘ চিকিৎসা এবং বিদেশে তার লাইফস্টাইল ও তার খরচ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। আগে অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু এখন বিএনপির দিন ভাল যাচ্ছে না। দুবারের আক্রমণাত্মক আন্দোলন দলের ভীষণ ক্ষতি করেছে। অনেক পুরনো কথা মানুষের মনে হয়েছে যা দলটির ক্ষতি করেছে। জাতির পিতাকে যারা সপরিবারে হত্যা করেছে তাদের প্রতি দলের ব্যবহার অনেকের মনে সন্দেহ জন্মিয়েছে যে খুনিরা জিয়াউর রহমান সরকারের সাহায্য পেয়েছে। তাদের বিচার বন্ধ করে দেয়ায় এই সন্দেহ বদ্ধমূল হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীদের পুনর্বাসিত করা হয়েছে বিএনপি সরকারের সময়। অতিপরিচিত স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিসহ সরকারী পদ দেয়া হয়েছে। শাহ এএসএম কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ অনেক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ বিএনপি সরকারের সময়। উলফা উপস্থিতি, দশ ট্রাক অস্ত্র, আইএসের তৎপরতা এমনি আরও কাহিনী আছে যা অনেকের মনে আছে। টকশো দেখলে মনে হয় নিজেরা কি করেছি বা কি করব সেটা আলোচনা করার চেয়ে অন্যেরা কি করেনি সেটা আলোচনা করাতেই বিএনপি সমর্থকরা বেশি উৎসাহী। ভারত বিরোধিতা তাদের নীতি এবং কৌশল। কিন্তু ইদানীংকালে ভারতকে খুশি করার চেষ্টা মানুষের মনে কৌতুকের সৃষ্টি করেছে। তাই বর্তমানে দলের দুর্দিনে নেতৃত্বকে সাবধানে চলতে হবে বৈকি! বিএনপির কমিটি বেশ বড়। গণতান্ত্রিক দলে স্থায়ী কমিটি মানানসই বলে অনেকে মনে করেন না। কমিটি সদস্য-সদস্যাদের ভোটে নির্বাচিত হলে গণতান্ত্রিক হয়। নেত্রীর হাতে সব ছেড়ে দেয়াটা অপরিপক্বতার লক্ষণ বলে মনে হয়। লোকে নতুন ও তরুণ সদস্য পছন্দ করে। আসল কথাটা হচ্ছে উপযুক্ততা। প্রশ্ন হচ্ছে নতুন কমিটি জনসাধারণের মনে কতটা উৎসাহের সৃষ্টি করেছে? দলের তৃণমূলকে কতটা চাঙ্গা করেছে? লেখক : ফেলো, রয়্যাল কলেজ অব সাইক্রিয়াটিস্ট
×