ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হজের জন্য উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৮ এপ্রিল ২০১৬

হজের জন্য উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন

আজাদ সুলায়মান ॥ প্রয়োজন না থাকলেও হজের জন্য একটি সুপরিসর উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার জোর পাঁয়তারা চলছে। বিমানের ভেতরে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চলতি হজের জন্য যে কোন মূল্যে একটি উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে। এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে সেই বিতর্কিত কাবো এয়ারলাইন্স। যদিও এবার কাবো দরপত্রে অযোগ্য হয়েছে, তারপরও ঈগল নামে দরপত্রে অংশ নিয়ে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে টিকেছে। অথচ গত বছর বিমান নিজস্ব বহরের উড়োজাহাজ দিয়েই ৫৫ হাজার হজযাত্রী স্বচ্ছন্দে বহন করে বিমানকে লাভের মুখ দেখিয়েছে। এবারও লিজের উড়োজাহাজ ছাড়াই স্বচ্ছন্দে হজ পরিচালনা করা সম্ভব। এটা নিশ্চিত জেনেও মূলত কমিশন বাণিজ্যের জন্যই এবার উল্টো পথেই হাঁটছে বিমান। এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে হজ পরিচালনা করায় যে অঙ্কের লাভ করা সম্ভব হয়েছিল, এবার লিজের জাহাজ দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করালে সেটা হবে আত্মাঘাতী। এটা বোঝার জন্য কোন বিশেষজ্ঞের গবেষণার প্রয়োজন নেই। অবশ্য বিমানের নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল ইনামুল বারী জনকণ্ঠকে বলেছেন, পর্ষদের সাব-কমিটি এটা খতিয়ে দেখছে। সেখানে বিশ্লেষণ করে দেখা হবে লিজ নেয়া প্রয়োজন আছে কি নেই। তারপর সাব-কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন সম্পর্কে সিদ্বান্ত নেয়া হবে। তার আগে কিছুই বলা যাবে নাÑলিজে উড়োজাহাজ নেয়ার প্রয়োজন আছে কি নেই। বিমান সূত্র জানায়, গত বছরের তুলনায় এবার হজ যাত্রীর সংখ্যাও কমেছে বেশ কয়েক হাজার। অন্যদিকে বিমান বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যাও বেড়েছে। তবুও এসব বিষয় আমলে না নিয়ে পর্দার আড়ালে সক্রিয় হয়েছে একটি প্রভাবশালী মহল। বিমানের বর্তমান পর্ষদ অবশ্য লিজের বিষয়টি সাব-কমিটি পাঠিয়েছে যাচাই বাছাইয়ের জন্য। হজের জন্য আদৌ একটি উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই সেটাই এখন পর্যবেক্ষণ করছে পর্ষদের সাব-কমিটি। জানা যায়, চলতি বছর হজযাত্রী বহনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিমান একটি সুপরিসর উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার জন্য ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি দরপত্র আহ্বান করে। ১৫ মার্চ দরপত্র খোলার পর দেখা যায়-এতে বিতর্কিত কাবো, কাবোর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ঈগল ও এভিকো নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তারমধ্যে কাবোর ইন্স্যুরেন্সের কাগজপত্র ঠিক না থাকায় তা বাতিল করা হয়। বাকি দুটোর মধ্যে ঈগলের দর হচ্ছে ৯ হাজার ২শ’ ডলার, এভিকোর ৯ হাজার ৯৮৫ ডলার। এ দুটোর কাগজপত্র ঠিক থাকায় প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। এখন এ দুটোর অফার পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে পর্ষদের সাব-কমিটি। কমিটি উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার লাভ লোকসান খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। এদিকে বিমানের ভেতর থেকেই চলতি হজের জন্য একটি বড় উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার প্রযোজনীয়তা ও যৌক্তকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিমানের পরিকল্পনা বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত বছর বিমান নিজস্ব বহরের ব্র্যান্ড নিউ বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ দিয়ে ৫৫ হাজার হজযাত্রী বহন করে। এ নিয়ে কোন রুটেরই সিডিউল বা সার্ভিস ক্ষুণœœœ হয়নি। যে কারণে বিমান দু’শ’ কোটি টাকারও বেশি লাভ করে শুধু হজ ইভেন্টেই, যা গোটা অর্থবছরের লাভের ধারায় বিমানকে বেশ জোরালো অবস্থানে নিয়ে যায়। গত বছরও হজের সময় বিতর্কিত কাবো সিন্ডিকেট বড় উড়োজাহাজ লিজে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার মার্র্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ প্রভাবশালী মহলের চাপ উপেক্ষা করে নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়েই হজ অপারেট করার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় ওদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। জানা যায়, গত বছর ব্যর্থ হলেও ওই একই সিন্ডিকেট এ বারও একই কায়দায় মাঠে নামে। তাদের ইন্ধনেই বিমান আবারও একটি দরপত্র আহ্বান করে। তাদের বদ্বমূল ধারণা ছিল এবার হজের সময় বিমান পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে এয়ারমার্শাল জামাল উদ্দিন আর থাকছেন না। সেজন্য অনায়াসেই একটি বড় উড়োজাহাজ বিমানকে গছানোর জন্য ওই সিন্ডিকেটই তৎপর হয়। এখন ওরা যথেষ্ট আশাবাদী হয়ে উঠেছে। যদিও সাব-কমিটি ঈগল ও এভিকোর অফার মূল্যায়নের পাশাপাশি আদৌ এ ধরনের উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা যাচাই করছে। বিমান সূত্র জানায়, দরপত্রে উড়োজাহাজের লিজ আওয়ার কমপক্ষে সাড়ে ৭শ’ ঘণ্টা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে হজের সময়ে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৮ থেকে ৯শ’ ঘণ্টায়। তাতে ঘণ্টাপ্রতি সাড়ে ৯ হাজার ডলার হিসেবে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০ কোটি। লিজ বাবদ এত টাকা ব্যয় করা হলে লাভের পরিমাণ যে গতবারের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিমানের একজন পরিচালক জানান, এবারও গতবারের তুলনায় আরও বেশি স্বচ্ছন্দে নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে হজ পরিচালনা করা সম্ভব। কেননা গতবারের তুলনায় এবার হজ যাত্রী কমেছে প্রায় চার হাজার। অন্যদিকে বিমান বহরে যোগ হয়েছে নতুন দুটো বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ। তার সঙ্গে রয়েছে ৪টি নিজস্ব বোয়িং ৭৭৭ ও লিজের ২টি ৭৭৭ উড়োজাহাজ। বিমান অপারেশন সূত্র জানায়, বর্তমানে এ ছয়টি উড়োজাহাজের লোড ফ্যাক্টরের ভয়াবহ পতন ঘটেছে। জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম ও কুয়েতের প্রতিটি ফ্লাইটের যাত্রী সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সর্বশেষ গত তিন দিনের ওই তিনটি রুটের লোড ফ্যাক্টর ছিল চরম হতাশাজনক, যা শতকরা ৫০ ভাগেরও কম। এমনকি কুয়েত থেকে বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে এক শ’ যাত্রীও মিলছে না। এত সুপরিসর উড়োজাহাজের আসন যদি এমন খালি যায় তাহলে ৬টা ৭৭৭ কোথায় ব্যবহার করা হবে। বিমানের অপারেশন সূত্র জানায়, বর্তমানে বিমান বহরের ৬টি সুপরিসর বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের মধ্যে গড়ে দেড়টি অলস বসে থাকছে। এতগুলো উড়োজাহাজের সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না বিমান, যা বিমানের জন্য অশনি সংকেতস্বরূপ বলে মন্তব্য করছেন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেভিন। এ সম্পর্কে বিমান পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী জনকণ্ঠকে বলেছেন, অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। উড়োজাহাজ থাকলেও হজ একটা সেনসেটিভ ইস্যু। কোন কারণে দেখা গেল একটা জাহাজ টেকনিক্যাল হয়ে গেল তখন তো হজ বিঘিœত হলে মিডিয়াতে হৈচৈ পড়ে যাবে। কাজেই সবকিছুই বিবেচনায় নিতে হবে। এদিকে দরপত্রে অংশ নেয়া ঈগল সম্পর্কে বিমান বলছে, এটা বিতর্কিত কাবোরই একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। নাইজিরিয়াভিত্তিক কাবোর বিরুদ্ধে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগের দরুন ইউরোপের অনেক দেশেই তাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বিমানে এর আগে ২০১১ সালে কাবোর উড়োজাহাজ লিজে নেয়ায় বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটে। তখন মিডিয়াতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে দ্বিতীয় দফা আর দরপত্রে অংশ নিতেও পারেনি। কিন্তু এবারের দরপত্রে কাবো আবার অংশ নিলেও কাগজপত্র ঠিন না থাকায় বাদ পড়ে যায়। টিকে যায় কাবোরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান ঈগল। এ দুটোরই স্থানীয় প্রতিনিধি একই ব্যক্তি বলে বিমানের পরিকল্পনা বিভাগ জানিয়েছে।
×