ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বতন্ত্র ভাষায় মৌলবাদী তা-বের প্রতিবাদ

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মুখ- রং-তুলিতে বেদনার কাব্য

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৮ এপ্রিল ২০১৬

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মুখ- রং-তুলিতে বেদনার কাব্য

মোরসালিন মিজান ॥ সঙ্গীতের চেয়ে শুদ্ধ সুন্দর আর কী হতে পারে! অথচ সেই শুদ্ধ সুন্দরের চর্চাটিও আজ আক্রান্ত হচ্ছে। একের পর এক নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনায়। ক’টি আর মনে রাখা যায়? এ কারণে অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাটির কথা। কী ভয়ঙ্কর তা-ব চালিয়েছিল মৌলবাদীরা! আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল কিংবদন্তি সুর সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর স্মৃতি। সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনও ছটফট করে ওঠে ভেতরটা। ধ্বংসযজ্ঞের ছবি গোটা দেশ দেখেছে এবং একই সময় সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন একদল চিত্রশিল্পী। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত আর্টক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন তারা। তবে আর সব আর্টক্যাম্পের মতো এটি ছিল না। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আঁকা ছবি ছবির বেশি কিছু হয়ে উঠেছিল। ধ্বংস যেমন পরিপূর্ণ মাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি জোরালো হয়েছে প্রতিবাদ। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে গত ১২ জানুয়ারি। এদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’ মৌলবাদী আক্রমণের শিকার হয়। সামান্য ভাংচুর নয়। গোটা ভবনটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মহামূল্যবান সব স্মৃতি ছাই ভস্ম হয়ে যায় সবার চোখের সামনে। এত বড় ক্ষতি কোন মানুষ করতে পারে? গোটা দেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। ঠিক সে সময় চিত্রশিল্পীদের দলটি পৌঁছে আক্রান্ত শহরে। তিনদিনব্যাপী আর্টক্যাম্পে অংশ নেন আব্দুল মান্নান, রণজিৎ দাস, প্রদ্যোৎ দাস, সোহাগ পারভেজ, কামাল উদ্দিন, শিপ্রা বিশ্বাস, অরনী, সানিয়া, তৌফিক, শহীদ কাজীসহ দশজন শিল্পী। তখনই জানা হয়েছিল, একেবারে ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছেন শিল্পীরা। সঙ্গত কারণেই আলাদা গুরুত্বের হয়ে ওঠে এক একটি ক্যানভাস। এখনও ছবিগুলোর কোন প্রদর্শনী হয়নি। চিত্রশালায় সংরক্ষিত। বুধবার সেখানে গিয়ে ছবিগুলো দেখে বেদনায় নীল হতে হয়। রিয়ালিস্টিক ছবিতে কেবল চোখের দেখা নয়, মনের গভীরের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াগুলো কথা বলে ওঠে। একাধিক শিল্পীর ক্যানভাসে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহার করা বাদ্যযন্ত্র। সেতার, সরোদ, তবলা সবই অগ্নিদগ্ধ। রং তুলিতে ক্ষতগুলো গাঢ় হয়ে ওঠে। কত কত দুর্লভ আলোকচিত্র কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো ছিল। সব নিশ্চিহ্ন এখন। সেই শূন্যতাকে এঁকেছেন শিল্পীরা। অহিংস মহাত্মা গান্ধী একটি পত্র লিখেছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে। সেই অমূল্য স্মারকও রক্ষা পায়নি আগুন থেকে। পোড়া চিঠির সঙ্গে নিজের প্রতিবাদ জুড়ে দিয়েছেন শিল্পীরা। সেই ১৯৩৬ সালে হজব্রত পালন করতে মক্কায় গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। তখন সৌদি বাদশা মহান শিল্পীকে একটি জায়নামাজ উপহার দিয়েছিলেন। জায়নামাজটিও উঠে এসেছে শিল্পীর ক্যানভাসে। হ্যাঁ, ধর্মের আগুনে দগ্ধ জায়নামাজ! ভবনের কালো দাগ, ছাই ভস্ম সবই রং তুলিতে এঁকেছেন শিল্পীরা। বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্ন রঙের ব্যবহার করেছেন ক্যানভাসে। সব রংই পরিশেষে বেদনার রং হয়ে ধরা দেয়। একইসঙ্গে মুখর হয় প্রতিবাদে। ধ্বংসযজ্ঞের কেন্দ্রে বসে ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা জানতে কথা হয় শিল্পী রণজিৎ দাসের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, শিল্প সংস্কৃতির চর্চার ওপর এমন আঘাত কল্পনাও করা যায় না। খবরটি শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আর তার পর আগুনে পোড়া বাড়ির প্রতিটি কক্ষ ঘুরে দেখেছি। ততক্ষণে চোখ ভিজে উঠেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনের ওই অবস্থা নিয়েই ছবি এঁকেছিলাম আমরা। আমি যে টেবিলে ক্যানভাস পেতেছিলাম সে টেবিলিটিও ছিল আগুনে পোড়া। ফলে ছবিগুলো সাধারণ ছবি থেকে আলাদা হয়েছে। ভেতরের আবেগ মুহূর্তেই ক্যানভাসে সঞ্চারিত হওয়ায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। দলটিকে সংগঠিত করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন একাডেমির কর্মকর্তা শিল্পী প্রদ্যোৎ দাস। নিজেও চমৎকার এঁকেছেন। কথা হয় তরুণ এই শিল্পীর সঙ্গেও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সাধারণত আর্ট ক্যাম্প আনন্দের হয়। শিল্পীরা গল্প আড্ডায় মাতেন। সেই সঙ্গে চলে ছবি আঁকার কাজ। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে যে দৃশ্য দেখা হয়, এর পর কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারেন না। সবাই বেদনায় ডুবে গিয়েছিলেন। নিঃস্ব মনে করছিলেন নিজেদের। সেই নিঃস্ব মন নিয়েই ছবি আঁকেন শিল্পীরা। ছবিগুলো তাই স্বতন্ত্র আবেদনের হয়েছে বলে জানান তিনি। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী জানান, আর্টক্যাম্পের ছবিগুলো নিয়ে অচিরেই বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। এখন চলছে প্রস্তুতি। যখন শিল্পীদের ওপর, সংস্কৃতি চর্চার ওপর আক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে তখন এই প্রদর্শনী একই সঙ্গে প্রতিবাদ হয়ে সামনে আসবে বলে জানান তিনি।
×