ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মধুশ্রী ভদ্র

ভূকম্পনে হৃদকম্পন

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৮ এপ্রিল ২০১৬

ভূকম্পনে হৃদকম্পন

জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখে অতি প্রত্যুষে প্রচ- ঝাঁকুনিতে গভীর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সঙ্গে সুন্দর স্বপ্নটাও; ছিলাম যে এক স্বপ্নের পৃথিবীতে! ও মাগো! ঘরের বিছানা, টেবিল, আলমারি, বুকশেলফ- সব কেঁপে কেঁপে উঠল। বুক শেলফটার পাল্লা খোলা ছিল, শাটার বন্ধ করতে রাতে মনে ছিল না! ঝুরঝুর করে যেন ইট-সুরকি পড়ছে, তেমনি করে শেলফের সারি সারি বই মেঝেতে ঝুরঝুর করে পড়ছে। একি ভুতুড়ে কা- নাকি তীব্র ভূকম্পন? আমার হৃদকম্প শুরু হয়ে গেল কি! সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে না করতেই ভূকম্পন থেমে গেল! নাহ্্! আর তো নিশ্চিন্তে ঘুমানোর উপায় নেই! ‘আফটার শক’ হতে পারে। এরপর নগরায়ন আর যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততায় ভুলেই গেছি ভূগর্ভস্থ তীব্র ভূকম্পনের কথা। কিন্তু ভুলে যাওয়া তো চলবে না! ২০১৬তে আমরা কি আবহাওয়ার বৈরিতা ও ভৌগোলিক বিপদের সম্মুখীন হব? কারণ ইতোমধ্যেই ২০১৬কে পৃথিবীর সবচেয়ে ‘উত্তপ্ত বছর’ হিসেবে মত প্রকাশ করেছে বিশ্বের অধিকাংশ আবহাওয়াবিষয়ক গবেষণা সংস্থা! এলো উৎসবপ্রিয় বাঙালীর প্রাণের সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। দিনব্যাপী বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রস্তুত বাঙালী জাতি। চলছে বাংলা বর্ষ বিদায়ের অনুষ্ঠান ‘চৈত্রসংক্রান্তি’, ‘বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স সেন্টার’-এ। সুর ও ছন্দে বিভোর হয়ে মনের আনন্দে গান শুনছি, এমন সময় আবারও তীব্র ঝাঁকুনি খেলাম, দুই দফায়। বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে এমন ভূমিকম্প যেন আমাদের মনে করিয়ে দিল, ভূ-বিজ্ঞানীদের তথ্য সত্য হতে চলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে আমরা এখন একটি যান্ত্রিক ইট-পাথর-সিমেন্টের খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে বাস করছি। চারপাশে শুধু সুউচ্চ ইমারত আর কংক্রিটের জঞ্জাল। আমরা কোথায় যাব? কোথায় আশ্রয় নেব? নেই একটি উন্মুক্ত খোলা প্রান্তর। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক অনেক বেশি হাইরাইজ বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ এই ঢাকা শহরে। আর এগুলোই ভূমিকম্পের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কতিপয় অসৎ হাউজিং কোম্পানি খাল-বিল, ডোবা-নালা, জলাভূমিকে বালি বা অন্য কিছু দিয়ে ভরাট করে, নয়ন লোভন সুউচ্চ ইমারত নির্মাণ করছে। তারা মানছে না কোন ‘বিল্ডিং কোড’ বা ইমারত নির্মাণ নীতিমালা। ঢাকা শহরে কয়টি নির্মিত হয়েছে ভূমিকম্প সহনশীল ভবন? নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, ফাউন্ডেশন-পাইলিং নির্মাণে ত্রুটি, ইট-বালি-রড-সিমেন্টে ব্যবহারে ভেজাল ও কারচুপি, বালি-সিমেন্টের অনুপাত মিশানোয় ফাঁকি দিয়ে নির্মিত হচ্ছে দুর্বল কাঠামোর আকাশচুম্বী অট্টালিকা! যার অধিকাংশই ভূকম্পনে হেলে পড়বে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। এই তো ক’মাস আগে ভূমিকম্প না হতেই মোহাম্মদপুরের এক দালান হেলে পড়ল। নিচে নরম মাটি আর ওপরে ভেজাল মিশ্রিত দুর্বল কাঠামো! ঢাকায় এখন শত-সহস্র ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। বড় ভূমিকম্প হলে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ নিতে না পেরে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলোÑ মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত বৈদ্যুতিক তার এবং গ্যাসের লাইন। ভূ-তলে ছড়ানো ছিটানো গ্যাসের পাইপগুলো ভয়াবহ ভূমিকম্পে ফেটে গিয়ে গ্যাস নির্গত হতে থাকবে আর সেই সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গিয়ে স্পার্কিং হবে, আগুন জ্বলে উঠবে। আগুন ও গ্যাস মিলে শুরু হবে অগ্নিকা-, পুরো ঢাকা শহর যদি আগুনে প্রজ্বলিত হয়, তাহলে কী হবে? বিপদ যা হবে তা অকল্পনীয়! ইমারত বা ইট-সুরকির নিচে চাপা পড়লে কয়েকদিন বেঁচে থাকা সম্ভব? কিন্তু ঢাকা শহরের সর্বত্র আগুন লাগলে কী ভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব? এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় হলো, জরুরী ভিত্তিতে গ্যাসের লাইনগুলোতে ‘অটোসেন্সর’ লাগানোর ব্যবস্থা করা; যাতে ভূকম্পন অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের পাইপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে গ্যাসের লিকেজ বা গ্যাস নির্গত হতে না পারে। অনেক উন্নত দেশে ভূমিকম্প হলে বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে, যাতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা না ঘটে। জানা গেছে, ভূমিকম্প মোকাবেলার জন্য কয়েক হাজার ভলানটিয়ার্সকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে কিন্তু ভূমিকম্পের সময় তাদের নিরাপত্তা, তাদের পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে কি? তা না হলে, তারা কিভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাবে? ট্রেনিং নিয়ে লাভটাই বা কী, যদি তারা ঐ দুর্যোগে সুস্থ ও অক্ষতভাবে বেঁচে না থাকে? আসলে ভূমিকম্পে মোটেও আতঙ্কিত হওয়া চলবে না। ঠা-া মাথায় শক্ত টেবিল বা বিছানার নিচে আশ্রয় নিতে হবে কিংবা বালিশ মাথায় দিয়ে ঘরের কোনায় বিমের নিচে বসে থাকতে হবে। সুউচ্চ ভবন থেকে নামা মোটেও নিরাপদ নয়, সিঁড়ি দিয়েও নয়, লিফট, দিয়েও নয়। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে ভূমিকম্পে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে, আতঙ্কিত না হয়ে নিজেকে কিভাবে নিরাপদ রাখতে পারে। ভূমিকম্পে কখনই তাড়াহুড়া করে উঁচু ভবন থেকে নামতে হয় না, তাতে বিপদ বাড়ে বৈ কমে না। সুতরাং ভূমিকম্পে সবচেয়ে জরুরী সচেতনতা ও সতর্কতামূলক আগাম পদক্ষেপ। মিরপুর, ঢাকা থেকে
×