ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

ওয়েস্ট ইন্ডিজ পারে, আমরা পারি না

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

ওয়েস্ট ইন্ডিজ পারে, আমরা পারি না

অনেকে বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ৪০ বছরের পথচলায় বাংলাদেশ সবচেয়ে সফল সময় পার করছে। এ কথার সাথে অনেকে ঐকমত্য পোষণ করলেও অনেকে নাও করতে পারেন। কেননা ‘ক্রিকেটের’ শব্দটার সাথে জড়িয়ে থাকে গোটা ক্রিকেট। যেখানে থাকে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেট, টেস্ট ক্রিকেট, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। একদিনের ক্রিকেটের মধ্যে আবার শ্রেণী বিভাগ রয়েছে। টি২০ ক্রিকেট, সিক্স এ সাইড ক্রিকেট, আরও কত কী। আজ আমরা ক্রিকেটের দীর্ঘ আলোচনায় যাব না। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় টি২০ ক্রিকেট। বাংলাদেশ মূলত একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেকটাই এগিয়ে গেছে সেটা বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিংয়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়েকে পেছনে ফেলে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের স্থান ‘লাকি সেভেন’-এ। কিন্তু টেস্ট বা টি২০ ক্রিকেটে রিভার্স চিত্র। টেস্টে মাত্র ৫ পয়েন্ট পাওয়া জিম্বাবুয়েকে পেছনে ফেলে ১০ জনের মধ্যে ৪৭ পয়েন্ট নিয়ে নবম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। আর টি২০ ক্রিকেটে ১৭ দলের মধ্যে ৭৪ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দশম আছে। ৭ পয়েন্ট বেশি নিয়ে এ তালিকায় বাংলাদেশের ওপরে আছে ননটেস্ট-প্লেয়িং দল আফগানিস্তান। তার মানে দাঁড়াচ্ছে টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ আফগানিস্তানেরও নিচে অবস্থান করছে। এ কথাগুলো লেখার অর্থ হচ্ছে, ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে পাঠকের সম্যক ধারণা দেয়া। সে যাই হোক, মূল আলোচনায় ফিরে আসি। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে আলোচনায় যাব না। কেননা, যেখানে সাফল্য বেশি থাকে তা নিয়ে লেখাও হয় বেশি। আর টেস্ট ক্রিকেট? সেটা নিয়ে না হয় আরেকদিন কথা বলা যাবে। সুতরাং আজকের আলোচনা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ছোট সংস্করণ টি২০ ক্রিকেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড ম্যাচের মধ্যে দিয়ে টি২০ ক্রিকেটের অভিষেক ঘটে। অভিষেক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ২০ ওভারে ২১৪ রানের জবাবে নিউজিল্যান্ডের ইনিংস শেষ হয় ১৭০ রানে। ফলে অভিষেক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জেতে ৪৪ রানে। পুরনো কাসুন্দি ঘাটলে দেখা যায়, টেস্ট এবং একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচেও এই অস্ট্রেলিয়াই জিতেছিল। টেস্ট ক্রিকেটের এক ’শ বছর পূর্তি ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়াই জেতে। টি২০ ক্রিকেটে বদলেছে শুধু প্রতিপক্ষ। ইংল্যান্ডের জায়গায় নিউজিল্যান্ড। ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি টি২০ ক্রিকেটের অভিষেক হলেও বাংলাদেশ খেলছে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে। আর এই ১০ বছরে বাংলাদেশ খেলেছে ২৭টি ম্যাচ। যা থেকে তারা সংগ্রহ করেছে ৭৪ পয়েন্ট। সাফল্যের দিক দিয়ে যা আশানুরূপ নয়। এ বছর এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ফাইনালে উঠে আশা জাগালেও শেষ পর্যন্ত আশার গুড়ে বালি পড়ে। আশা ভঙ্গ হয় বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। তারপরও সদ্য শেষ হওয়া টি২০ ক্রিকেটে আবার নতুন করে আশায় বুক বাঁধে। সবার ধারণা ছিল, টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ ভাল করবে। এ বছরের এশিয়া কাপের ফাইনালিস্ট দল অন্তত টি২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বাংলাদেশ ২টি জয় ও ১টি ড্র নিয়ে সুপার টেন-এ পৌঁছালেও চূড়ান্ত পর্বে আর জয়ের দেখা মেলেনি। সুপার টেনের বি গ্রুপে পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে গোটা বাঙালী জাতিকে আরও একবার হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করে বাংলাদেশের ছেলেরা। পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের সাথে তেমন কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে না পারলেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩ উইকেটে ও ভারতের কাছে মাত্র ১ রানের হার অনেকেই এখনও মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষ করে ভারতের সাথে শেষ ৩ বলে ২ রান করতে না পারা। সবার মনে আছে, ভারতের বিপক্ষের ম্যাচে শেষ ওভারে দরকার ছিল ১১ রানের। মুশফিক প্রথম ৩ বলে ৯ রান নিয়ে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেও বাকি ৩ বলে মাত্র ২ রান করতে পারেনি বাংলাদেশের ছেলেরা। হার্ডিক পান্ডিয়ার ফুলটস বল তুলে মারতে গিয়ে ডিপ-মিড উইকেটে তালুবন্দী হন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তার পথ ধরে পরের বলে মুশফিকও একই কাজ করেন। শেষ বলে মুস্তাফিজ রান আউট হলে বাংলাদেশের পরাজয় নিশ্চিত হয়। প্রথম ৩ বলে এলো ৯ রান আর শেষ ৩ বলে ৩ উইকেট। এটা প্রমাণ যে, বাংলাদেশ এখনও বড় দলের কাতারে নাম লেখাতে পারেনি। কেননা, বড় দলের প্রধান মন্ত্র হচ্ছে মাথা ঠা- রেখে খেলা। এখানে টিম ম্যানেজমেন্টেরও একটা দায়িত্ব ছিল। তারা ‘টুয়েলভম্যান’কে দিয়ে একটা নির্দেশনা পাঠাতে পারত। তাতে করে রিয়াদ বা মুশফিক বুঝতে পারত কীভাবে শেষ ৩ বল মোকাবেলা করতে হবে। এই দুই ম্যাচে জিততে পারলে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকত। আমরা ক্যারিবীয় ক্রিকেটের দিকে তাকাতে পারি। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ ওভারে দরকার ছিল ১১ রানের। সেখানে এবারের টি২০ ক্রিকেটের ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ১৯ রানের। যেটা কেবল অসম্ভবই ছিল না, অকল্পনীয়ও বটে। বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে এক নয় সেটার প্রমাণ করে তারা। শেষ ওভারে যেখানে ১৯ রান দরকার সেখানে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান কার্লোস ব্রাফেট ইংলিশ বোলার বেন স্টেকসকে হতবাক করে দিয়ে টানা ৪ বলে ৪টি ছক্কা মেরে জয় ছিনিয়ে নেন। অথচ কার্লোস ব্রাফেট কোন বড় মাপের ব্যাটসম্যান নন। এ ম্যাচে ১০ বলে অপরাজিত ৩৪ রান করার আগে ৭ ম্যাচের ৪ ইনিংসে তার রান ছিল ২৫। এ কথা বলছি রান করতে হলে যে স্টার হওয়া লাগে তা নয়। নৈপুণ্য দেখিয়েও স্টার হওয়ার সুযোগ সবার সামনেই থাকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেটা পারে, আমরা সেটা পারি না। এখন আর বাংলাদেশ ক্রিকেটের শিশুটি নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪০ বছর পার করে ফেলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর কথা সবার জানা। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড তাদের খেলোয়াড়দের ঠিক মতো বেতনভাতা দিতে পারে না। ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের আর একটু বাড়তি সচ্ছলতার জন্য মুখিয়ে থাকতে হয় বিগব্যাশ, আইপিএল, বিপিএল-এর মতো লীগের দিকে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সেসব ক্রিকেটাররা কেবল মনের জোরে ক্যালিপসো ক্রিকেটের চালচিত্র আমূল বদলে দিয়েছে। একসময় যাদের বলতে শোনা গেছে, ক্যালিপসো ক্রিকেট আর কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আজ তাদের কণ্ঠেই উল্টো সুর। তারাই গলা ছেড়ে গাইছে ক্যালিপসো ক্রিকেট বন্দনা। কিন্তু কেন? উত্তরটা খুবই সোজা। ক্যারিবিয়ানরা এ বছরেই বিশ্বকাপের তিন তিনটে শিরোপা জিতেছে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ ১৯-এর শিরোপা ছাড়াও টি২০ বিশ্বকাপ ও মেয়েদের টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। বিশেষ করে একই সঙ্গে একইদিনে ছেলেদের টি২০ বিশ্বকাপ ও মেয়েদের টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের ঘটনা ঘটেছে এবারই প্রথম। আর এ কারণে ক্যালিপসো ক্রিকেট বন্দনা না করে উপায় নেই! ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে। বকেয়া পাওনার দাবিতে খেলোয়াড়রা লাগাতার ধর্মঘটে যায়। দল থেকে বাদ পড়া ড্যারেন সামিকে ফিরিয়ে এনে তার কাঁধে নেতৃত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে একটা ভাঙ্গাচোরা দল নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সে দলের বিপক্ষে জিতেই আমাদের সে কি উল্লাস! বাংলাদেশের কাছে সেদিন টেস্ট ও একদিনের ক্রিকেটে হোয়াইট ওয়াশ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ড্যারেন সামি এখনও দলের ক্যাপ্টেন। দলকে তিনি আমূল বদলে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে। আর আমরা এখনও ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর বন্দনায় মেতে আছি। এক্কেবারে তলানি থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ উঠে আসতে পেরেছে কিন্তু আমরা এখনও ‘নবীন’ বলে পারছি না। আমি জানি না আর কতকাল আমরা নবীনের কাতারে থাকব। ওদের দলে নাম্বার ওয়ান তারকা নেই। তারপরও ওদের স্যামুয়েলস, গেইল, ব্রাভো, ব্রাফেটরা প্রয়োজনের সময় জ্বলে উঠছে। কিন্তু আমাদের বিশ্বসেরা সাকিব আছেন, আছেন তামিম, মুশফিক, রিয়াদদের মতো তারকা ক্রিকেটার। তারপরও আমরা পারছি না। ফলে আমরা দু’একটি জয় পেয়ে খুশি হচ্ছি বটে কিন্তু চূড়ান্ত জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছি না। আর এই না পারার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে, ব্যর্থতার জবাবদিহিতা না থাকা। খেলোয়াড়, কোচ, ম্যানেজার সকলের জবাবদিহিতা থাকা দরকার। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক e-mail : [email protected]
×