ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

বিস্ময়ের নাম মুস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০৩:২৫, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

বিস্ময়ের নাম মুস্তাফিজ

বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে কটাক্ষ কম হয়নি। অবহেলাও করা হয়েছে অনেক। কিন্তু কেউ কেউ থাকে যার কারণে বিশ্ব দরবারে মর্যাদা উন্নত হয় কোন একটি দেশ বা জাতির। বাঁ-হাতি তরুণ পেসার মুস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ দলে আসার পর থেকে ঠিক সেটাই হয়েছে। একের পর এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে নিজে যেমন আলোচনায় থেকেছেন তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেটও এখন সারাবিশ্বে বিশ্লেষণের কারণ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণের প্রথম বছরেই কয়েকটি বিশ্বরেকর্ড গড়ার পাশাপাশি গত বছর বর্ষসেরা আইসিসি একাদশে জায়গা করে নেন। ৯ ওয়ানডে খেলে ২৬ উইকেট নিয়ে বর্ষসেরা নবাগত ক্রিকেটারের স্বীকৃতি পান। সেই মুস্তাফিজ এখন জনপ্রিয় ক্রিকেট আসর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগও (আইপিএল) মাতিয়ে চলেছেন। প্রতিটি ম্যাচেই আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা মুস্তাফিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান তারকা ক্রিকেটারসহ ক্রিকেট বিশ্লেষক ও ধারাভাষ্যকাররা। এমনকি এক সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে যারা কুৎসা রটিয়েছেন, সমালোচনা করেছেন তারাও মুস্তাফিজকে নিয়ে বন্দনায় ব্যস্ত। তার প্রশংসা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়েও এখন আশাবাদ তাদের কণ্ঠে। এমনকি ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এ নতুন গতিতারকার আবির্ভাবে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। ক্রমেই ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম আলোচনার কারণ হয়ে যাচ্ছেন মুস্তাফিজ। ভারতের মাটিতে খেলতে গিয়েও ভারতীয় ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকদের কণ্ঠে সেøাগান শুনেছেন ‘মুস্তাফিজ’ ‘মুস্তাফিজ’। আর এটাই প্রমাণ করে কোন উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন এ তরুণ পেসার। বিশ্বের যে কোন প্রান্তের ক্রিকেট ভক্তরাই এখন তার বোলিংয়ে মুগ্ধ। এবারই প্রথম অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সুপার লীগ (পিএসএল) টি২০ আসরে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি। নাহলে তখনই হয়তো মুস্তাফিজের বিশ্বায়নটা হয়ে যেত। ব্যাটসম্যানদের ধুম-ধারাক্কা ব্যাটিংয়ের দারুণ ক্ষেত্র টি২০ ক্রিকেট। তেমন ম্যাচেও ৪ ওভারে ১ মেডেনসহ মাত্র ৯ রানে ২ উইকেট নিয়ে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের জয়ে ভূমিকা রেখেছেন। সে কারণেই রাজিব গান্ধী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে মুস্তাফিজ নামে সেøাগান দিলেন ভারতীয় দর্শকরা। সেটা ম্যাচশেষে যখন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিতে এসেছেন তখনও করেছেন ক্রিকেট সমর্থকরা। পুরো ম্যাচজুড়েই ধারাভাষ্যকার, ক্রিকেট বিশ্লেষক এবং নিজ দলের অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের প্রশংসায় ভেসেছেন মুস্তাফিজ। তাঁর বোলিংয়ের ক্যারিশমায় অভিভূত সবার কণ্ঠেই বিস্ময় প্রকাশ পেয়েছে। কারণ, ক্রমেই ব্যাটসম্যানদের জন্য দুর্বোধ্য হয়ে উঠছেন মুস্তাফিজ। এবি ডি ভিলিয়ার্স, ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম, শেন ওয়াটসন, ডেভিড মিলার, ফাফ ডু প্লেসিস, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, বিরাট কোহলি, শন মার্শ- কেউ বাদ পড়েননি। সবার কাছেই সমীহ আদায় করে নিয়েছেন বাঁ-হাতি মুস্তাফিজ। সতীর্থরা এখন তাঁকে সংক্ষিপ্ত করে ডাকেন ‘ফিজ’ বলে। ইংরেজী শব্দ ‘ফিজ’ অর্থ হিসহিস করা! মৌখিকভাবে সেটা কখনও করেন না, উইকেট পেয়ে গেলেও বাড়তি উল্লাস প্রকাশ করেন না; কিন্তু গতিময় মুস্তাফিজ প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের জন্য হয়ে গেছেন মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি বোলিং করতে আসলেই যে কোন ব্যাটসম্যান যেন বিষাক্ত সর্পের ‘হিসহিস’ শুনতে পান, কারণ প্রতিটি বলেই ভিন্ন মাত্রার বিষ ছড়িয়ে দিতে পারঙ্গম মুস্তাফিজ। ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে আছে নিখুঁত ছদ্মবেশে দেয়া ‘সেøায়ার’ এবং কাটার। এর সঙ্গে সুইং এবং নানাবিধ বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ মুস্তাফিজের বোলিং। সেটার ভয়ানক শিকার হচ্ছে দলগুলো। পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে ম্যাচে ৪ ওভারে মাত্র ৯ রান দিয়ে অভিভূত করেন সবাইকে। মুস্তাফিজ ১৭ বলই করেন ডট। এ কারণেই ম্যাচ চলার সময় বাংলাদেশ বিদ্বেষী দুই ধারাভাষ্যকার নভজ্যোত সিং সিধু এবং রমিজ রাজার কণ্ঠেও প্রশংসা ও বিস্ময় ঝরে পড়ে। রমিজ বলেন, ‘মুস্তাফিজ মানেই জাদু।’ পুরো ম্যাচজুড়ে ধারাভাষ্যকারদের প্রশংসায় ভেসেছেন মুস্তাফিজ। সুনিল গাভাস্কারও বিশেষণ হারিয়ে কেবল বার বার বলেছেন, ‘মুস্তাফিজের বোলিং মানেই জাদু! শেষ ওভারে নিখিল নায়েককে আউট করার পর বড় স্ক্রিনেও ভেসে উঠে ‘ম্যাজিক্যাল মুস্তাফিজুর’। আইপিএলে সেরা বাঁ-হাতি বোলারকে এমন জরিপের একতরফা জয়ী মুস্তাফিজ। ৭১% ভোট গেল মুস্তাফিজের পক্ষে, ধারে কাছেও থাকলেন না বাকি তিনজনের কেউ। এই পরিসংখ্যান দেখে রমিজ বললেন,‘কোন বাঁ-হাতি-ডানহাতি নয়, সে বিশ্বের সেরা বোলার।’ অথচ বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়েই কটাক্ষ করেছেন রমিজ। চলতি আসরে শুরু থেকেই ভীতি ছড়ানো মুস্তাফিজ এদিন হলেন ম্যাচসেরা। প্রথমবার ম্যাচজয়ী নায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আরও প্রশংসিত হয়েছেন। ম্যাচ শেষে দলের আনন্দ উদ্যাপনে তাঁকে কেন্দ্র করেই হয়েছে অনুষ্ঠান। দলের মেনটর ভিভিএস লক্ষণ কেক কাটার পর মুস্তাফিজকে নিজ হাতে কেক খাইয়েছেন। এরপর বাংলা শেখার চেষ্টা করা লক্ষণ টুইটও করেন বাংলায়। হায়দরাবাদ কোচ টম মুুডিও সেই একই চেষ্টা করেছেন। সাবেক এ অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডারও বাংলা শিখছেন। তিনি টুইট করেন, ‘কেক উৎসব ফিজের জন্য, ম্যাচসেরা হওয়ার জন্য অভিনন্দন (ইংরেজীতে)। আমাদের ফিজ অনেক উজ্জ্বল (বাংলায়)।’ সনি টিভির ইনিংস বিরতির টক শো-তে নভোজ্যোত সিং সিধু’র মুস্তাফিজ বন্দনায় ছিলেন পঞ্চমুখ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঘোরতরো বিরোধী সিধু তো সরাসরি ঘোষণাই দিয়ে দিলেন ‘মুস্তাফিজ এই টুর্নামেন্টের সেরা। মুস্তাফিজ নিজেই ইতিহাস লিখেন!’ আইপিএলের এবারের আসরের সবচেয়ে ‘কিপটে’ বোলিং করা মুস্তাফিজকে সম্মান জানাতে ভোলেননি হায়দরাবাদ অধিনায়ক ওয়ার্নার। চলতি আইপিএলে ৫ ম্যাচ খেলে ১৬.৪২ গড়ে ৭ উইকেট নিয়ে তিন নম্বরে মুস্তাফিজ। ওভার প্রতি রান দেয়ার ক্ষেত্রে তিনিই সবচেয়ে মিতব্যয়ী। এ পর্যন্ত ওভারপ্রতি মাত্র ৫.৭৫ করে রান দিয়েছেন তিনি। এ কারণেই হায়দরাবাদের ‘সুপারহিরো’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ইয়ান ও’ব্রায়ান, মেলিন্ডা ফ্যারেল ও অজিত আগারকাররা তাদের আলোচনায়। মুস্তাফিজের এমন পারফর্মেন্সে খুশি কাউন্টি ক্লাব সাসেক্সও! কিছুদিন পরই যে তাদের হয়ে মাঠ মাতাবেন ‘দ্য ফিজ’। টুইটারে সে উচ্ছ্বাসই প্রকাশ করলেন সাসেক্সের ইংলিশ খেলোয়াড় লুক রাইট। তিনি টুইট করেন, ‘৪ ওভারে ৯ রান দিয়ে ২ উইকেট! অবিশ্বাস্য! নিশ্চিতভাবে সাসেক্স ভক্তরা তাকে দেখতে মুখিয়ে আছেন।’ এমন নৈপুণ্য দেখানোর জন্যই এমনকি আইসিসিতেও আলোচনায় ছিলেন মুস্তাফিজ। এ বিষয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানান, ‘এখন ক্রিকেট নিয়ে কথা বললে সবাই মুস্তাফিজকে নিয়ে কথা বলে। এবার আইসিসি সাভাতেও তাই হয়েছে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রেসিডেন্ট আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথা থেকে এই ছেলেটিকে পেয়েছি।’
×