ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মু. আবদুল্লাহ আল আমিন

৯০ পেরোলেন রানী ॥ ‘রানী এলিজাবেথ আমার প্রেরণার উৎস’ ॥ ওবামা

প্রকাশিত: ০৩:২৪, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

৯০ পেরোলেন রানী ॥ ‘রানী এলিজাবেথ আমার প্রেরণার উৎস’ ॥ ওবামা

ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এক জীবন্ত কিংবদন্তি। বৃহস্পতিবার ছিল তার ৯১তম জন্মদিন। ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সিংহাসনে থাকার রেকর্ডটি বর্তমান রানীরই। অন্যসব ব্রিটিশ রাজন্যের চেয়ে তিনি বেশি দেশ সফর করেছেন এবং বেশিসংখ্যক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। শুক্রবার ব্রিটেন সফরে আসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাকিংহাম প্যালেসে রানীর সঙ্গে দেখা করে একটি ফটো এ্যালবাম উপহার দেন যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে রানীর সাক্ষাতের ছবিগুলো রয়েছে। এ্যালবামের প্রথম ছবিটি ১৯৫১ সালে তৎকালীন ডাচেস অব এডিনবরা প্রিন্সেস এলিজাবেথের যুক্তরাষ্ট্র সফরের। তিনি ওই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন। ওবামার আট বছর প্রেসিডেন্ট থাকাকালে রানী অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র যাননি। পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনকালে ওবামা বলেন, ‘রানী এলিজাবেথ সব সময়ই আমার প্রেরণার উৎস। তিনি আমার প্রিয় ব্যক্তিদের অন্যতম।’ রানীর পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর, তার অফিসিয়াল পদবি এলিজাবেথ দি সেকেন্ড বাই দি গ্রেস অব গড অব ইউনাইটেড কিংডম এ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এ্যান্ড হার আদার রিলমস এ্যান্ড টেরিটরিস’ কুইন, হেড অব কমন ওয়েলথ এ্যান্ড ডিফেন্ডার অব ফেইথ। জন্ম ১৯২৬ সালে। সন্তানের সংখ্যা চার, নাতি নাতনি আটজন। ব্রিটেন ছাড়াও তিনি ৫৩ সদস্য কমনওয়েলথের ১৬টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২৫ বছর বয়সে তার সিংহাসনে অভিষেক ঘটে। তার রানী হওয়ার কথা ছিল না। বাবার (প্রিন্স আলবার্ট, পরে নাম ষষ্ঠ জর্জ) বড় ভাই অষ্টম এডওয়ার্ড দুইবারের বিচ্ছেদ ঘটা আমেরিকান নারী উয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করার জন্য ১৯৩৬ সালে সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হলে সিংহাসনে বসেন ষষ্ঠ জর্জ। তার উত্তরাধিকারী হন প্রিন্সেস এলিজাবেথ। হাজার বছরের পুরনো ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনে সবচেয়ে বেশি সময় থাকার রেকর্ড ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ বিকেল সাড়ে ৫টায় ভিক্টোরিয়ার ৬৩ বছর ৭ মাস ২ দিন ১৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিটের ঐতিহাসিক মাইলফলকটি অতিক্রম করেন এলিজাবেথ। রানী এলিজাবেথকে এখনও সিংহাসন ছেড়ে দেয়ার কথা মুখে আনেননি। দুয়েক বছর আগে তার স্বাস্থ্যের হঠাৎ অবনতি ঘটলে এ নিয়ে গুঞ্জরন শুরু হয়েছিল। গত নবেম্বরে কমনওয়েলথ সম্মেলন উদ্বোধন করতে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপদেশ মাল্টা গেলে সবাই ধরে নিয়েছিল এটাই সম্ভবত তার শেষ রাষ্ট্রীয় বিদেশ সফর। কিন্তু রাজ পরিবার থেকে এখনও সে রকম কোন ঘোষণা আসেনি। তিনি দূরপাল্লার বিদেশ যাত্রা বাদ দিয়েছেন বটে কিন্তু এ বয়সেও তিনি রাজকীয় এস্টেটের মধ্যে ঘোড়ায় চড়তে পছন্দ করেন। এই বয়সেও তিনি রাজকীয় দায়িত্ব বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই পালন করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ভারত সফরে আসা তার নাতি প্রিন্স উইলিয়াম এমনটাই জানিয়েছেন। উইলিয়াম বলছেন, এখনও পারিবারিক বিষয়গুলো রানীর নির্দেশ মতো পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, ‘কিভাবে এ বয়সেও তিনি শক্ত সমর্থ ও কর্মঠ রয়েছেন সে রহস্য জানার জন্য তাকে আমি অনেকবারই জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু তিনি আমাকে কিছুই বলেননি।’ উইলিয়াম শুধু নয় তার স্ত্রী ক্যাথেরিন ও ভাই হ্যারিরও এ ব্যাপারে কৌতূহল রয়েছে, এই বয়সে এত শক্তি তিনি কোথা থেকে পান। রানী যেন ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপের মতোই নিজের কাজের প্রতি আত্মনিবেদিত। রাজ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, পিতার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ২১ বছরে প্রিন্স এলিজাবেথ পিতার উদ্দেশে শপথ করেছিলেন যে, ‘অল্পদিন বা দীর্ঘদিন বাঁচি আমি আপনার এবং আমাদের মহান রাজকীয় পরিবারের প্রতি নিষ্ঠার সঙ্গে আমার দায়িত্ব পালন করে যাব’। এর পাঁচ বছর পর তার পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা যান। রাজ সিংহাসনের প্রথম উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস মনে করেন, ওই শপথ তার পরবর্তী জীবনের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিল। এলিজাবেথ ব্রিটেনে ১২ জন প্রধানমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রে ১২ জন প্রেসিডেন্ট ও ভ্যাটিকানে পোপের ৭ জন পোপের পালাবদল দেখেছেন। এলিজাবেথ ব্রিটেনের ৪০তম রাজন্য, তার আগে ৩৪ জন রাজা ও ৫ জন রানী সিংহাসনে বসেছিলেন। অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময়ের বিশ্ব নেতাদের মধ্যে খুব কমই আছেন যার সঙ্গে রানীর সাক্ষাত হয়নি। এলিজাবেথ রানী হিসেবে ৭০ বছর পার করবেন এই প্রত্যাশায় তাকে এখন থেকে দেখা হচ্ছে প্লাটিনাম কুইন হিসেবে। রাজপরিবারের ইতিহাসে একাধিক কেলেঙ্কারি ছাড়াও ব্যক্তি জীবনে অনেক উত্থান-পতন তিনি প্রত্যক্ষ করেন। ১৯৯২ সালে তার প্রথম তিন সন্তান চার্লস, এ্যান ও এ্যান্ড্রূর বিয়ে ভেঙ্গে যায়। ১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস ডায়ানার দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ইতিহাসের সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল রাজপরিবারকে। এলিজাবেথ সবচেয়ে বেশি দেশ সফর করা ব্রিটিশ রাজন্য। তিনি ১৯৬১ ও ৮৩ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। ৬৩ বছরে ১৩২টি দেশে তিনি ২৭০ বার সফর করেন। ভিক্টোরিয়া ইউরোপের বাইরে কোন দেশ সফর করেননি। এলিজাবেথ যেমন বার্লিন প্রাচীন তৈরি ও এর সম্প্রসারণ দেখেছেন তেমনি দেখেছেন প্রাচীরটির পতন। ব্রিটেনে এক সময় বিশ্বের এক বড় অংশ শাসন করেছে। কমনওয়েলথের মাধ্যমে সাবেক শাসিত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে রানীর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। তিনি সিংহাসনে আরোহণকালে ব্রিটেন একটি খ্রীস্টান ও শ্বেতাঙ্গ দেশ। সেখান থেকে বহু বর্ণ ও বহু সংস্কৃতিতে দেশটির উত্তরণে পরোক্ষভাবে হলেও রানীর ভূমিকা রয়েছে। উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড যুগ যুগ ধরে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখে এলেও রানীকে ঐক্যের প্রতীক বিবেচনায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের মধ্যেই রয়ে গেছে।
×