ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ

সমস্ত সঙ্কটের মূলে নব্য উদারতাবাদ

প্রকাশিত: ০৩:২২, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

সমস্ত সঙ্কটের মূলে নব্য উদারতাবাদ

আমাদের যাবতীয় সমস্যার মূলে রয়েছে একটি মতাদর্শ যার নাম নিওলিবারেলিজম বা নব্যউদারতাবাদ। বড় ধরনের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টিতে এটা মস্ত ভূমিকা পালন করেছে। যেমন ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা, অফশোরে সম্পদ ও ক্ষমতা পঞ্জীভূত করা যার ছিটেফোঁটা দেখতে পাওয়া যাবে পানামা পেপারসে, সরকারী স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধসে পড়া, শিশু দারিদ্র্যের পুনরুত্থান, মহামারী আকারে নিঃসঙ্গতাবোধ, বাস্তুতন্দ্রের বিপর্যয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ইত্যাদি। এসব সঙ্কটে আমরা যেভাবে সাড়া দেই তাতে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই যে এগুলো যেন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আবির্ভূত। আমরা জানিই না যে, এসব সমস্যার সবই সেই একই দর্শনের কারণে অনুঘটিত বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। নব্যউদারতাবাদ এতই সর্বব্যাপী রূপ ধারণ করেছে যে আমরা কদাচিৎ সেটাকে মতাদর্শ হিসেবে স্বীকার করি। মানুষের জীবনকে নতুন করে নির্ধারণ এবং ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পরিবর্তনের এক সচেতন প্রয়াস হিসেবে এই দর্শনের আবির্ভাব। নব্যউদারতাবাদ প্রতিযোগিতাকে মানব সম্পর্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখে। এই দর্শন নাগরিকদের নতুনভাবে সংজ্ঞাায়িত করেছে কনজিউমার বা ভোক্তা হিসেবে যাদের কেনা-বেচার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বাছবিচারের ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালভাবে প্রয়োগ করা হয়। কেনা-বেচার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মেধার পুরস্কার জোটে এবং অদক্ষতার জোটে শাস্তি। নব্য উদারতাবাদ বলে যে বাজার-ই কল্যাণ বা লাভ বয়ে আনতে পারে যা পরিকল্পনার দ্বারা কখনই অর্জন করা যায় না। এই দর্শনে প্রতিযোগিতা সীমিত করার চেষ্টাকে স্বাধীনতার পরিপন্থী হিসেবে দেখা হয় এবং বলা হয় যে কর ও নিয়ন্ত্রণ যতদূর সম্ভব কমাতে হবে, সরকারী সার্ভিসগুলোকে বেসরকারী খাতে দিতে হবে। শ্রমিক সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নের দরকষাকষিকে বাজারের বিকৃতি হিসেবে দেখা হয়, যা বিজয়ী ও পরাজিতের স্বাভাবিক স্তরবিন্যাস গঠন ব্যাহত করে। অসাম্যকে একটা ধর্ম বা গুণ হিসেবে তথা উপযোগিতার পুরস্কার ও সম্পদ সৃষ্টিকারক হিসেবে দেখা হয় যা উপর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে সবাইকেই সমৃদ্ধ করে। আরও বেশি সুষম সমাজ গঠনের চেষ্টা তাই হিতেবিপরীতই শুধু নয়, উপরন্তু নৈতিক দিক দিয়েও ক্ষতিকর। প্রত্যেকে তার প্রাপ্যটুকু যেন পায় বাজার তা নিশ্চিত করে তোলে। এই নব্য উদারতাবাদই আমাদের সমগ্র জীবন ও সমগ্র চেতনাকে আচ্ছন্ন করে থাকে। তাই ধনীরা নিজেদের বুঝায় যে তারা সম্পদ করায়ত্ত করেছে তাদের মেধার মাধ্যমে। তারা শিক্ষা, উত্তরাধিকার ও শ্রেণী অর্থাৎ যে সুবিধাগুলোর বদৌলতে এই সম্পদ করায়ত্ত করেছে সেগুলো দেখেও দেখে না। গরিবরা তাদের ব্যর্থতার জন্য নিজেদের দায়ী করে। নব্যউদারতাবাদ শেখায় যে আপনি যদি চাকরি না পান তাহলে বুঝতে হবে আপনি উদ্যমহীন। প্রতিযোগিতারই প্রাধান্য এমন এক জগতে যারা পিছিয়ে পড়ে থাকে তারা হলো হেরে যাওয়ার দল। নব্য উদারতাবাদ শব্দটা প্রথম ব্যবহৃত হয় প্যারিসে ১৯৩৮ সালে। এই মতাদর্শের জনক দু’জন অস্ট্রীয়Ñ লুডভিক ভন মাইসেস ও ফ্রেডাবিক হায়েক। তাদের দুটি বই যথাক্রমে ‘বুরোক্রেসি’ এবং ‘রোড টু সার্ভিসে’ এই মতাদর্শ বর্ণিত। বই দুটি বহুল পঠিত হয়েছিল। বই দুটো অতি ধনাঢ্য কিছু ব্যবসায়ীর দৃষ্টিতে পড়ে। তারা এই দর্শনের মধ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও করের হাত থেকে মুক্ত করার সুযোগ দেখতে পান। বিলিয়নিয়ার ও তাদের ফাউন্ডেশনগুলো এই মতাদর্শ প্রসারের জন্য গঠিত সংগঠনের পিছনে বিপুল অর্থ চেয়েছিলেন, তাদের সহায়তায় এই দর্শনের সমর্থক শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক প্রভৃতির একটি ট্রান্সলান্টিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, মতাদর্শটিকে আরও পরিশীলিত ও প্রসারের জন্য এই ধনকুবেররা বেশকিছু থিঙ্কট্যাঙ্ক গঠনেও অর্থ যোগায়। ফলে হায়েক যা বলতে চেয়েছিলেন এসব থিঙ্কট্যাঙ্ক সেটাকে ধনিকের স্বার্থে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয়। যেমন হায়েকের মত ছিল এই যে, মনোপলির আবির্ভাবরোধে সরকারের উচিত প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করা। সেটাকেই এমন ধারণায় পর্যবসিত করা হয় মনোপলির শক্তিকে দক্ষতার পুরস্কার হিসেবে দেখতে হবে। ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে নব্য উদারতাবাদ শব্দটা হারিয়ে যেতে থাকে। সেটি অন্তরালে চলে যায়। যুদ্ধোত্তর যুগে জন কীনিসের অর্থনৈতিক দাবাই ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে। নব্য উদারতাবাদ একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু সত্তুরের দশকে কীনিসের নীতি ব্যর্থ হয়ে যেতে শুরু করলে এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট আটলান্টিকের উভয় তীরে আঘাত হানতে থাকলে নব্য উদারতাবাদী ধ্যানধারণা আবার মূলধারায় ফিরে আসতে থাকে। আমেরিকায় কার্টার প্রশাসন ও ব্রিটেনে কালাহান সরকার কতকাংশে এই ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করে। মার্গারেট থ্যাচার ও রিগ্যানের আমলে তা ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়। ধনীদের জন্য বড় ধরনের কর হ্রাস, ট্রেড ইউনিয়ন দমন, সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিল ও বিরাষ্ট্রীয়করণ, সরকারী চাকরিতে আউট সোর্সিং ও প্রতিযোগিতার সূচনা হয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে নব্য উদার নীতিগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়। এর ফল হয় বিষময়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লক্ষণীয়ভাবে মন্থর হয়ে পড়ে। আয় ও সম্পদ বণ্টনে অসাম্য ৬০ বছর ধরে হ্রাস পেয়ে চলার পর এই অধ্যায়ে দ্রুত বেড়ে যায়। কর্পোরেশনগুলো একচেটিয়াভাবে মুনাফা করে চলে। বেসরকারী ও আধাবেসরকারী সার্ভিসগুলো অকল্পনীয় বিত্ত কবলও করে। গরিব আরও গরিব হয় এবং ধনী আরও ধনী। ব্যাংকগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। সাধারণ মানুষ দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। সর্বত্র সংকটের অভিশাপ দেখা যেতে থাকে।
×