ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কি মধুচন্দ্রিমায় গড়াবে

প্রকাশিত: ০৩:২১, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কি মধুচন্দ্রিমায় গড়াবে

ভারত ও আমেরিকা এই দুটি দেশকে জুটি হিসেবে বেশ সম্ভাবনাময় মনে হয়। বৃহৎ গণতন্ত্রের এই দেশ দুটি ভাষা ও রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। সাড়ে ১২ কোটি ভারতীয় ইংরেজী ভাষায় কথা বলে। ৩০ লাখেরও বেশি আমেরিকান নিজেদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। দুই দেশের জনগণ আইনের শাসন ও ফ্রি এন্টারপ্রাইজ নীতিতে বিশ্বাসী। ইসলামী সন্ত্রাস ও চীনের উত্থানের মতো আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা ও উদ্বেগ অভিন্ন। বিশ্বজুড়ে আজ বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্কগত ও জোটগত পুনর্বিন্যাস ঘটে চলেছে। আমেরিকার মূলদৃষ্টি এখন ইউরোপ ছেড়ে এশিয়ার দিকে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কার্যকালে ভারতের সঙ্গে এ দেশটি যেমন নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তেমনি চেষ্টা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। তথাপি বৃহত্তর মঞ্চে ভারতকে নিয়ে আরও বড় ধরনের উচ্চাভিলাষ পূরণে আমেরিকার উদ্যোগের মধ্যে কোথায় যেন কিসের একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। পাত্র আছে, পাত্রীও আছে। তথাপি কেন জানি সেটা বর-কনের রূপধারণ করছে না। অদূর ভবিষ্যতেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে নাÑ মধুচন্দ্রিমা তো দূরের কথা। তবে যে জিনিসটার উদ্ভব ঘটছে তা হলো নীরব ও সতর্কতার সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ চরিতার্থ করা। আমেরিকান কর্মকর্তারা এটাকে বলছেন স্ট্র্যাটেজিক করমর্দন। আর ভারতীয় কর্মকর্তাদের ভাষায় এটা হলো স্ট্র্যাটেজিক অংশীদারিত্ব। কেউ ‘জোট’ শব্দটা একবারের জন্যও উচ্চারণ করছেন না। তবে সম্পর্কটা যদি ক্রমাগত গাঢ় হতে থাকে তাহলে কোন একপর্যায়ে তা এমনই রূপ ধারণ করতে পারে। এদিক দিয়ে সর্বশেষ ঘটনাটা ছোট, তবে তাৎপর্যপূর্ণ। গত ১০ থেকে ১২ এপ্রিল মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ্যাশটন কার্টারের ভারত সফরকালে দুই দেশ তাদের সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহায়তা সহজতর করার লক্ষ্যে দ্রুত লজিটিক্স চুক্তি স্বাক্ষরের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। যোগাযোগ ও ডিজিটাল ম্যাপিংয়ের প্রটোকল সংক্রান্ত আরও দুটি চুক্তিও সম্পন্ন হওয়ার পথে। এতে দুই সশস্ত্রবাহিনীর সহযোগিতার পথ যেমন সুগম হবে তেমনি ভারত অনেক ব্যাপকতর পরিসরে মার্কিন সাজ-সরঞ্জাম লাভের সুযোগ পাবে। বিশ্বের কয়েক ডজন দেশের সঙ্গে আমেরিকার এ ধরনের চুক্তি আছে। তবে ভারতের সঙ্গে এমন চুক্তিতে উপনীত হতে আমেরিকার এক দশক সময় লেগে গেছে। চুক্তির নামও ভারতীয়দের চাপে বদলাতে হচ্ছে। কারণ আমেরিকার সঙ্গে খুব বেশি মাখামাখি না করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীতে জোর অভিমত বিদ্যমান। এর পেছনেও কারণ আছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে এসেছে। তবে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য সোভিয়েতের মুখাপেক্ষী ছিল। ভারত দেখেছে কিভাবে আমেরিকা ভিয়েতনাম এবং পরে ইরাক ও আফগানিস্তানে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সীমান্ত যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাও ভারতের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। এই বৃহৎ প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে উস্কানি সৃষ্টি হতে পারে এমন কিছু করার ব্যাপারে ভারত যথেষ্ট সতর্ক। ভারত দেখাতে চায় না যে সে মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটা গ্যাংয়ের অংশ। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলায় মদদ দিয়েছে এবং আমেরিকার নেতৃত্বে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নস্যাতের চেষ্টা করেছে এই মর্মে তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সাহায্য অব্যাহত থাকায় ভারত ক্ষুব্ধ। তথাপি আমেরিকার প্রতি ভারতের এ বিরক্তি বা অসন্তুষ্টি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সর্বশেষ চুক্তিগুলো তারই প্রমাণ। এগুলো প্রতিরক্ষা সহযোগিতার গ-িকে ছাড়িয়ে গেছে, যার ফল হলো ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত এশিয়ার জন্য যৌথ স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিকল্প। আমেরিকা এখন অন্য যে কোন দেশের চাইতে ভারতের সঙ্গেই অধিক যৌথ মহড়া করছে। দু’বছর আগে ভারত মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রের ক্রেতা হিসেবে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এখন মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রে নিজেকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করতে চায়। দুটো দেশই আজ ভারত মহাসাগরে আরও ব্যাপক পরিসরে নিজেদের শক্তি জাহির করতে চায়। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর এজন্য প্রয়োজন দূরপাল্লার টহল বিমান ও ড্রোন, সামুদ্রিক হেলিকপ্টার। বিমানবাহী রণতরীর প্রযুক্তি এবং ও সাবমেরিন বিধ্বংসী অস্ত্র। আমেরিকাও তার নিজের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য ভারতীয় পরিকল্পনার প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে এসেছে। দুই দেশের মধ্যে জেট-ইঞ্জিন ডিজাইন ও এভিওনিক্সের মতো ক্ষেত্রে অর্ধডজন অংশীদারিত্বের ব্যবস্থা বলবত আছে। সেগুলো ছাড়াও দুই পক্ষ যৌথভাবে জঙ্গীবিমান, সম্ভবত এফ-১৮ এর ভারতীয় সংস্করণ তৈরির প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে। এসব কিছুর পেছনে যে তাগাদা কাজ করেছে তাহলো চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি। চীনের জিডিপি ভারতের ৫ গুণ, এমন অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশটি সাহায্য সহায়তা যুগিয়ে ভারতের প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশের মনোরঞ্জনের দ্বারা তাদের কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করেছে। চীনের যুদ্ধজাহাজ এখন নিয়মিত ভারত মহাসাগরে ঢু মারছে। চীন মিয়ানমার থেকে পাকিস্তান হয়ে জিবুতি পর্যন্ত ঘাঁটি অর্থাত অন্ততপক্ষে বন্ধুপ্রতীম বন্দরের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই চীনকে মোকাবেলা করা নিয়েই ভারত ও আমেরিকার স্বার্থ সর্বাধিক অভিন্নতা লাভ করেছে। আমেরিকা চায় ভারত এ ব্যাপারে আরও বেশি সামর্থ্য অর্জন করুক এবং বৃহত্তর দায়িত্ব কাঁধে নিক। ব্যাপারটা ভারতের কাছে প্রলুব্ধকর সন্দেহ নেই। কিন্তু ভারতের বিরোধী দলের কাছ থেকে এ ব্যাপারে প্রবল বিরোধিতা আসবে। আর ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পেলেও এটা এতই ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ যে, এখনও এরা দাম্পত্য জীবনের চেয়ে ব্যাচেলর জীবনকেই বাঞ্ছনীয় মনে করে। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট
×