ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বাতাসে এখনও কান্নার ধ্বনি

প্রকাশিত: ০৩:২০, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

বাতাসে এখনও কান্নার ধ্বনি

রানা প্লাজার ঘটনার পর মানুষ ভেবেছিল আইন আদালতের জটিলতা যতই থাক এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের আসল দায় যাদের তাদের বিচার হবেই হবে। দু’হাজার তের সালের চব্বিশ এপ্রিল ও তার পরের কয়েকদিন গোটা দেশের মানুষের অনুভূতিতে একযোগে এমন আশাই আলোড়ন তুলেছিল। মনে হয়েছিল অন্তত এবার মালিক শ্রমিকের শ্রেণীদূরত্ব ঘুচে মানবিকতার অবিচ্ছিন্ন বৃত্ত তৈরি হবে। কিন্তু না, ‘সবার ওপর মানুষ সত্য’র কাব্যিক ভাবালুতা তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে মালিক রয়েছেন মালিকের জায়গায়, শ্রমিক শ্রমিকের জায়গায়। শ্রেণী বিভক্ত সমাজের এই হচ্ছে আসল সত্য। রানা প্লাজার মালিক রানা সাহেব জেলখানায় নিরাপদ জীবন যাপন এই উপলব্ধিকে দৃঢ় করে। নিহত ও আহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের নানা তথ্য খবরের কাগজ সূত্রে আমরা পাই। কিন্তু অপরাধের মূল নায়ক রানা সাহেবের বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতির খবর পাই না। শুনতে পাই জেলখানায় তিনি ভিআইপি মর্যাদায় আছেন। অনেকে এও বলছেন, একদিন তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বীর বেশে ঘরে ফিরবেন। ক্ষতিপূরণের যে মামলা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন থেকে করা হয়েছিল এবং উচ্চ আদালত স্বত:প্রণোদিত হয়ে যে রুল দিয়েছিলেন তার শুনানি এক বছর ধরে আটকে আছে। রুল শুনানির এক পর্যায়ে উচ্চ আদালত বলেছিলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনা কোন দুর্ঘটনা নয়, অপরাধ। এজন্য আইন অনুসারে দোষী ব্যক্তিদের যেমন ফৌজদারি অপরাধের বিচার হতে হবে, তেমনি দোষী ব্যক্তিদের অপরাধের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে’ (প্রথম আলো ২৩ এপ্রিল ২০১৬)। গত তিন বছরে এর একটির বাস্তবায়নও দেখা যায়নি। ক্ষতিপূরণের নামে শ্রমিকরা আসলে সাহায্য পেয়েছেন দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। শ্রমিক নেতারা বলেছেনও সেকথা– মূলত যাদের কারণে শ্রমিকের ক্ষতি হয়, ক্ষতিপূরণ তাদেরই দিতে হয়, হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত সেজন্যই দরকার। দরকার এজন্যও যে, সিদ্ধান্ত না এলে ভবিষ্যতে এরকম আরও দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাবেন না। যে কারণে আইনের জন্য শ্রমিকদের আগ্রহ ঠিক সে কারণেই অনাগ্রহ বিজিএমইএ নেতাদের। তারা এ বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত চান না। ॥ দুই ॥ সাভারের ‘উলাইল’ গ্রামে যে বছর দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার জন্মেছিলেন (১৮৭৭ সাল) তার প্রায় এক শ’ বছর আগে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছে। সামন্ত ভূস্বামীদের পিছু হটিয়ে শিল্পপুঁজির বিকাশের পালে দুরন্ত হাওয়া লেগেছে। দক্ষিণারঞ্জনের গ্রামটি যে তখন নিছকই অন্ধকারে ডুবে থাকা ভুতুড়ে গ-গ্রাম তা সহজে কল্পনা করা যায়। কারণ তাঁর জন্মের ঠিক এক শ’ বছর পরের সাভার যখন শহর ঢাকার উপকণ্ঠে এক থানা ‘শহর’ তখনও আসলে গ্রামই সে। শিল্পের ছোঁয়া দূরে থাক নগরায়ণের প্রক্রিয়াই বলতে গেলে শুরু হয়নি। সামন্ত সমাজের প্রায় সব লক্ষণ নিয়ে সাভার থানার প্রাণকেন্দ্র বাজার স্ট্যান্ড, থানা রোড, গেন্ডা, কাতলাপুর, উলাইল তখন অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শান্ত-স্নিগ্ধ নিবাস। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে অল্প ঘরদোর। মানুষজন প্রায় চোখেই পড়ে না। ঘাসে ছাওয়া লালমাটিতে ঘন বুনটের কাঁঠালগাছের গাঢ় সবুজ রং, সন্ধ্যায় ধলেশ্বরীপারের আলো-আঁধারীতে পাখিদের কিচিরমিচির, আম-পেয়ারা-অরবড়ই-করমচার বাগানে উদাস দুপুর আর যতদূর চোখ যায় খোলা মাঠের ওপর ঝকঝকে আকাশ। সাভার মানেই যেন জলরঙে আঁকা নিখুঁত এক ল্যান্ডস্কেপ। যে সৌন্দর্য বাঁধা পড়ে আছে রূপালী পর্দার অসংখ্য দৃশ্যে। বাংলা চলচ্চিত্রের দৃশ্য নির্মাণ এক সময় এখানে ছিল নিয়মিত। এ সৌন্দর্যের টানেই সম্ভবত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের সূত্রে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই জমি কিনে এখানেই স্থায়ী হয়েছেন। শৌখিন বাড়িঘর বানিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে ছন্দময় জীবন যাপন করেছেন। যে প্রক্রিয়ায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানারা মাটি ফুঁড়ে শূন্যে হাত বাড়ায় তার সঙ্গে সাভারের তখনও পরিচয় হয়নি। পরিচয় হয়নি দেশী পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্ত হওয়া ও নতুন এক শ্রমিকশ্রেণী উদ্ভবের প্রক্রিয়ার সঙ্গে। এসবই হয়েছে আশির দশকে। একাত্তরে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে যে নতুন রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছিল শাসকশ্রেণী হিসেবে বাঙালীর সেখানেই প্রথম আত্মপ্রকাশ। আগে এ অভিজ্ঞতা না থাকায় হঠাৎই যেন ঘটে গেল অনেক কিছু। অনেক ধরনের সুবিধা এলো। বিত্তবৈভবে শ্রেণীউত্তরণ ঘটল। কয়েক বছরের মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ার হার যেমন দ্রুতগতিতে হলো তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রের চরিত্রেও দ্রুত পরিবর্তন এলো। সন্ত্রাস, নিপীড়ন, সামরিক শাসন আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এক সঙ্গে শুরু হলো। সামরিক শাসকদের আমলে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের সীমাহীন সুযোগ, ভূমি দখল, বিদেশী সাহায্য ও কমিশন ভোগের সুবাদে যে গোষ্ঠীটি দ্রুত সম্পদশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল শাসক শ্রেণীর দলগুলোতে এখন তাদের অবস্থান দৃঢ়। নিজেদের সম্পদ, প্রতিপত্তি বাড়াতে দেশ-বিদেশের নানা শক্তির সঙ্গে আপোস ও সুবিধাবাদের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া তাঁরা পাড়ি দিয়ে এসেছেন সামরিক শাসন অবসানের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হলেও সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি বরং বাজারঅর্থনীতি ও তথ্যপ্রবাহের ব্যাপক বিস্তারের সঙ্গে তা আরও বহুমাত্রিক রূপ পেয়েছে। এ পথের নানা অলিগলিতে জন্ম নিয়েছে হাজার-কোটি সোহেল রানা। সোহেল রানাদের জন্ম এমনি এমনি হয় না। লুটেরা, দখলবাজ, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার শীর্ষে যাওয়ার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে তাদের জন্ম ও বৃদ্ধি। ক্ষমতার লেবাস সামরিক কি বেসামরিক তা বড় কথা নয়, এখানে তাদের চরিত্র অভিন্ন। যে প্রক্রিয়ায় সোহেল রানারা ভূমিমালিক বা বহুতল ভবনমালিক হন সে প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিউলি, রেশমা, পাখি, শেফালি, রমজানরা ভূমিহীন হয়ে সেলাইকলে নিজেদের ঠিকানা খোঁজেন। তাদের আগমনে বদলে যায় সাভারের চিত্র। স্নিগ্ধ গ্রামীণ আবহে লাগে শিল্পের ছোঁয়া। তবে কারখানার সাইরেনে সাভারের বাতাস কেঁপে উঠলেও মালিক-শ্রমিক আর উদ্বৃত্ত মূল্যের দ্বন্দ্বে সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ স্বাভাবিক পথে এগোয় না। শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সমাজ বিকাশের যে ব্যাকরণ শিখিয়েছে তার সঙ্গে মেলে না বাংলাদেশের শিল্প বিকাশের বাস্তবতা। এদেশে পোশাক শ্রমিকদের নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞতা যতখানি মালিক শ্রেণীর পেশাদারিত্বের অভাবও সম্ভবত ততখানি। নইলে যাদের ওপর ভর করে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের এত সুখ্যাতি বা গ্রহণযোগ্যতা তাদেরকে এমন অমানবিক পর্যায়ের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রেখে কাজ করাতেন না। পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকের সম্পর্ক অনেকটাই কৃত্রিম। রাষ্ট্রের সহায়তায় রফতানিমুখী শিল্পের বিকাশ ঘটেছে, প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে অন্যান্য উৎপাদনশীল খাত ভেঙ্গে পড়েছে। আশির দশক থেকেই এদিকে সরকারী মনোযোগ নিম্নমুখী, ব্যক্তি উদ্যোক্তাদেরও তেমন আগ্রহ নেই। আগ্রহ বেড়েছে মার্কেট, সুপার মার্কেট বা বহুতল ভবন নির্মাণের দিকে। একদিকে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে সুপার মার্কেট, বেসরকারী ব্যাংক-বীমা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বেসরকারী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল। উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে পরিষেবা খাত দেশের অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেয়ার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বিকশিত হয়েছে মৌলবাদী রাজনীতি। দেশের শিল্পকারখানা ধ্বংস করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেপুটে খাওয়ার যে সুযোগ স্বৈরাচারী এরশাদ করে দিয়েছিল সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মূল ভূমিকা রাখছে। তারপরও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। এক সঙ্গে এগারো শ’ পঁচিশ শ্রমিক অপঘাতে মারা যান। অঙ্গহানি হয়ে বেঁচে থাকেন অসংখ্য। শুধু রানা প্লাজাই তো নয়, স্মার্ট, তাজরীনের মতো ঘটনাও নিয়মিত ঘটেছে- যা এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের দায়িত্বহীনতাকেই মূলত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। চার হাজারের বেশি পোশাক কারখানায় কাজ করছে ছত্রিশ লাখের বেশি শ্রমিক, যাদের শ্রমে দেশ পাচ্ছে সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা তাদের জীবনই সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। শিল্পমালিকরা উৎপাদন উপকরণের বীমা করান খুবই গুরুত্বের সঙ্গে; কিন্তু এগুলো সচল রাখেন যারা তাদের জীবনবীমা করার তাগিদ অনুভব করেন না। অথচ এ বিষয়ে আইন আছে। আইনে স্পষ্ট উল্লেখও আছে যে, কোন কারখানায় দু’শ’র বেশি শ্রমিক থাকলে তাদের প্রত্যেককে গ্রুপবীমার আওতায় আনতে হবে। সম্প্রতি সংশোধিত এ আইনে এখন এক শ’ শ্রমিক কর্মরত থাকলেই গ্রুপবীমা করার কথা বলা হয়েছে। চমৎকার সব আইন, আইনের যুগোপযোগী সংস্কার সবই আমাদের আছে। কিন্তু শ্রমিক বা সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ওপর আইনের সেসব ধারা কাজ করে খুবই কম। আইন ভেঙ্গে সহজে পার পান ক্ষমতাবানরা। যে কোন অপরাধের সাজা এড়ানোর ম্যাকানিজম তারা জানেন। কারণ সব সরকারের সময় তারা থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত যতই থাক, এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। শ্রেণীস্বার্থের বেলায় প্রশ্নহীন আপোসে তারা অনায়াসে এক পঙ্ক্তিতে বসে একই সুরে কথা বলেন। বর্তমান সংসদের অনেক সদস্য পোশাক শিল্পের মালিক। তারা জানেন দুর্নীতির যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতি এ পর্যন্ত এসেছে তারা তার উত্তরাধিকার বহন করছেন। সুতরাং যত ভয়ঙ্কর ঘটনাই ঘটুক তারা সব কিছুর উর্ধে। এই আত্মবিশ্বাস এগারো শ’ পঁচিশ জন মানুষকে বিকৃত লাশে পরিণত করবেই। গোঁজামিল দেয়া স্থাপনা রানা প্লাজাকে ঝুরঝুরে বালিতে পরিণত করবেই। রানা প্লাজা বাংলাদেশের রাজনৈতিক হঠকারিতা ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নির্মম ও নৃশংস প্রতীক হয়ে থাকবে। যে সাভারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক সময় সম্পন্ন মানুষদের ঘর-গৃহস্থালি করে স্থায়ী হওয়ার আকাক্সক্ষা জাগিয়েছিল সেই শান্ত-স্নিগ্ধ সাভারের ঘাসে ঢাকা নরম মাটি রক্তাক্ত হয়েছে ক্ষমতাহীন শ্রমিকের রক্তে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথার রাক্ষসদের একফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লে তা থেকে শত শত রাক্ষস জন্ম নিয়ে হাউ মাউ খাউ করে তেড়ে আসত ‘বীর’ রাজপুত্রের দিকে। ওদের শক্তির কাছে রাজপুত্র এক ফুঁয়ে উড়ে যাওয়ার মতো অসহায়। শক্তিতে নয়, ছলচাতুরি প্রয়োগ করে রাক্ষস মেরে বীরের মর্যাদা পেতেন রাজপুত্র। রানা প্লাজায় মৃত শ্রমিকের রক্ত কি হাজার হাজার শ্রমিক হয়ে তেড়ে আসবে কোনদিন? অতীতে যতবার আসতে চেয়েছে ততবারই ‘বীর রাজপুত্ররা’ ছলচাতুরিতে বশ করেছে তাদের। যেদিন সব বশ্যতা ভেঙ্গে দলে দলে শ্রমিক এসে নিজেদের পাওনা কড়ায়-গ-ায় বুঝে নেয়ার কৌশল রপ্ত করতে পারবেন সেদিন বন্ধ হবে পোশাক কারখানার রক্তের ধারা। নইলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
×