ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মো. আব্দুল কুদ্দুস

আমাদের শিক্ষাগুরু রেজাউল করিম সিদ্দিকী

প্রকাশিত: ০৩:১৮, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

আমাদের শিক্ষাগুরু রেজাউল করিম সিদ্দিকী

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী দেশের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদের নাম। যাঁর মুখে সর্বদাই সদালাপি হাসি লেগে থাকত। তাঁর নিজ হাতে গড়া শিষ্য রয়েছে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে। উচ্চশিক্ষা বিস্তারে তাঁর দীপ্ত পদক্ষেপ ছিল দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও। সেই পথ চলায় গড়েছেন তিনি হাজারো সোনার মানুষ। মহান শিক্ষাগুরু এবং সংস্কৃতিমনা ও মুক্তচিন্তার অধিকারী এই মহান পুরুষের গ্রামের বাড়ি আমার ইউনিয়নেই। তাঁর জন্মস্থান দরগামাড়িয়া গ্রামের নামানুসারেই আমাদের ইউনিয়নের নাম দশ নম্বর মাড়িয়া। দরগামাড়িয়া গ্রাম সবুজে ঘেরা এক নিভৃত পল্লী। এই গ্রামের খুব কাছ দিয়ে বয়ে গেছে বাগমারার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাণ ‘রানী’ নদী। এই নদী ও স্যারকে ঘিরে একবার আমার ছেলেবেলায় স্কুলের একজন প্রিয় শিক্ষকের কাছে একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি শুনেছিলাম আমার হাইস্কুল জীবনে। গল্পটি এমন : রেজাউল করিম স্যার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার কিছু সময় অতিবাহিত হবার পরে গ্রামে গিয়েছিলেন (তিনি মৃত্যুর আগেও অবশ্য বেশি বেশি গ্রামের বাড়িতে যেতেন)। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও তখন খুব একটা ভাল ছিল না। একদিন প্রবল বৃষ্টিপাতের পর ‘রানী’ নদী থেকে বন্যার পানি এসে ভবানীগঞ্জ-তাহেরপুর লিংক সড়ক ভেঙ্গে পানির স্রোত দিগি¦দিক বয়ে চলছিল। স্যার সে স্রোতের কোন একটিতে মাছ ধরার যন্ত্র ‘খলসন’ পেতে বসে আছেন। স্যারের পরনে ছিল স্যান্ডু গেঞ্জি ও লুঙ্গি। একই রাস্তা দিয়ে তখন থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা মোটরসাইকেল করে যাচ্ছিলেন। স্যারের মাছ ধরার ওই দৃশ্য দেখে স্যারকে কিছু না বলেই ওই কর্মকর্তা রাস্তায় মাছ ধরার অপরাধে স্যারকে ইংরেজী-বাংলায় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিলেন। এমনিতেই স্যার ছোটখাটো পাতলা দেহের মানুষ, তার মধ্যে আবার পোশাক-আশাকে একেবারে গ্রাম্য মানুষের ভাব ছিল তখন। পুলিশ কর্মকর্তার গালমন্দ শুনে স্যার উত্তরে শুধু একটি কথাই বলেছিলেন, ইন্সপেক্টর সাহেব... আমি শিক্ষক, আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক। সেখান থেকে ফিরে স্যার তাঁর গ্রামের মানুষের কাছে গল্প করেছেন। এরপর সেই পুলিশ কর্মকর্তা কী বুঝেছিল জানি না। তবে কথাটি শোনার পর ওই পুলিশ কর্মকর্তা স্যারকে অনেকবার স্যালুট করেছেন। মনে হয় স্যার তাঁর ওই গালভরা হাসিমুখে কথাটি এমন রস দিয়ে বলেছিলেন যে, তাতেই ওই কর্মকর্তা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। স্যারের মৃত্যুর আগে যদি ওই ঘাতক খুনীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন তবে ওই পিশাচ খুনীরা কখনও তাঁকে খুন করতে পারত না। ওদের হাত কেঁপে উঠত। পাষ- হৃদয়ও মুহূর্তের মধ্যে ঠা-া বরফ স্তূপে পরিণত হতো। কারণ স্যার মানুষকে ভালবাসতেন। কথার জাদু দিয়ে মানুষের মন জয় করার এক অদম্য শক্তি ছিল তাঁর মধ্যে। কিন্তু সেটি করার সুযোগ আর স্যারের ভাগ্যে হলো না! অভাগা দেশ! অভাগা দেশের মানুষ! হারালাম আমরা স্যারকে। রেজাউল করিম স্যারকে অনেকে বলছেন যে উনি নাকি নাস্তিকের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। আমি এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করি। তিনি যে নাস্তিক ছিলেন না তার সপক্ষে আমি সম্প্রতি তাঁর ধর্মভীরুতার কয়েকটি চাক্ষুষ প্রমাণ দিয়ে বুঝাতে পারি। একটি হলো, স্যার গত দু’বছর আগেও আমার নিজ গ্রাম সূর্যপাড়ার পাশের গ্রাম মধ্যঝিনা জামে মসজিদের এক বিরাট ইসলামী জলসার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শুধু উপস্থিত ছিলেন না, ওই মসজিদের নির্মাণ কাজের জন্য তিনি অনুদানও দিয়েছেন। যে মানুষটি ইসলামী জলসার পৃষ্ঠপোষকতা করেন, যিনি মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন, তিনি কিভাবে নাস্তিক হতে পারেন তা আমাদের বোধগম্য হয় না! জানাবেন কী ধর্মান্ধ কোন জনগোষ্ঠী? এছাড়া আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাগমারা শিক্ষা উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম (২০০৮-২০১১)। সে সুবাদে স্যারের সঙ্গে আমার একটি ভাল সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। ২০১০ সালের কোন একদিন এ সমিতির কাজে আমি ও আমার বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান রানা স্যারের শালবাগানস্থ বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন স্যার আমাদের সঙ্গে নানারকমের গল্পগুজব করেছেন। এদিন স্যার অনেক খোলা মনে বলেছিলেন তাঁর সাংস্কৃতিক চর্চার কথা। স্যারের বাসায় ব্যবহৃত হারমোনিয়াম, তবলা, একতারা-দো’তারা এনে আমাদের দেখালেন। বললেন, আমি কোন নোংরা রাজনীতি বুঝি না। আমি শিক্ষক। আমার দর্শন শিক্ষাদান। আমার দর্শন আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সোনার মানুষ করে গড়ে তোলা। আমার দর্শন আমার ধর্ম। আমার দর্শন আমার বাঙালী সংস্কৃতি। কথাগুলো বলতে বলতে নামাজের সময় হয়েছিল। স্যার আমাদের দোতলার অতিথি কক্ষে রেখে নামাজও আদায় করেছিলেন। এই মহান মানুষকে আমরা কোন অবস্থায় নাস্তিক আখ্যা দিতে পারি? এরপর কোন এক ফাঁকে স্যার আমাদের নিজের হাতে চা-নাস্তা এনে দিয়ে বললেন, নাও খেয়ে নাও। আমার বাড়িতে কোন কাজের বুয়া নেই। এগুলো আমি নিজেই করেছি। আমি ও আমার বন্ধু রানা সেদিন স্যারের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। মানুষ এত বড় মনের হতে পারে সেদিন শিখেছিলাম। এরকম গুণীমানুষকে আমরা এত কাছ থেকে দেখছি। ভেবে লজ্জাও পাচ্ছিলাম যে, স্যার আমাদের মতো এই তুচ্ছ মানুষ দুটোকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছেন! লজ্জাও যেমন পেয়েছিলাম তেমনি বিমুগ্ধও হয়েছিলাম। তাই আজ মনের কাছে, জাতির কাছে বারবার প্রশ্ন জাগছে, এরকম নিরীহ স্বভাবের একজন মানুষের কোন শত্রু পৃথিবীতে থাকতে পারে? ভাবতেই অবাক লাগে। রেজাউল করিম স্যার ছিলেন একজন ত্বরিতকর্মা ব্যক্তিত্ব। তিনি কথা বলতেন কম আর কাজ করতেন বেশি। যেটুকু কম কথা বলতেন তাও খুব দ্রুত বলে ফেলতেন। স্যার যখন হাঁটতেন তখন পা ফেলতেন খুবই বড় বড় ব্যবধান করে। মনে হয় যেন দৌড়াচ্ছেন। কর্মী এ মানুষটির যেন প্রতিটি সেকেন্ড অতিশয় মূল্যবান। গাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের লিচুতলায় নামার পর তাঁর কর্মস্থল শহীদুল্লা কলাভবনে পৌঁছাতে সময় নিতেন মাত্র এক-দেড় মিনিট। নিজের কক্ষে প্রবেশ করেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন কাজ নিয়ে। স্যার তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তাই নরপিশাচদের হাতে নির্মমভাবে খুন হবার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের আবেগঘন বর্ণনা করতে দেখেছি। তাঁকে সবাই যে কতটা ভালবাসতেন সেদিনের সেই স্ট্যাটাসগুলো পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম আরও বেশি। স্যারের অনেক ভক্ত ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে একজন লিখেছেন, “স্যার ক্লাসের পেছনের ছাত্র শুনতে পাবে না আশঙ্কায় আপনি রুমের ফ্যান চালাতেন না। ‘আর্ট ও লাইফ’-এর পার্থক্য এবং ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ একটি ইশারাতে কত সহজ করে বুঝালেন। স্যার একটু জোরে জোরে হাসতেন। আর শিক্ষার্থীদের তাতে শক্ত সমর্থন থাকত। শহীদুল্লা কলাভবনের ২০২ নং রুম হাসিতে ফেটে পড়ত। স্যার একটি লাইন মাঝে-মধ্যেই ক্লাসে বলতেন,“Then all smiles stopped together. সতি সত্যিই আজ স্যারের মুখের হাসি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে কাঁদিয়ে গেলেন তাঁর হাজারো প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীকে। স্যারের আরো একজন প্রিয় ছাত্রী লিখেছেন, “স্যার আমরা আজও মানব হতে পারিনি। আপনাকে বাঁচাতে পারলাম না স্যার। আমাদেরকে ক্ষমা করবেন স্যার প্লিজ!” তাঁর আরেক প্রিয় ছাত্র লিখেছেন, “Will miss this sweet face warm love he gave us best teacher, ur physical presence will be there in edru bt u will be alive in our heart forever.” স্যারের আরো একজন শুভাকাক্সক্ষী লিখেছেন, “সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে একি শুনছি! মকুল স্যারের মতো একজন নিরীহ মানুষকে ঘাতকরা খুন করেছে! আজ নিজেকে বিশ্বাস করতেই সন্দেহ হচ্ছে! তাঁর মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না! খুনীদের ক্ষমা করতে পারছি না! যদি ধরতে পারতাম তবে ওই ঘাতক খুনীদের কলিজা ছিঁড়ে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াতাম স্যার।“ সুতরাং সর্বোতভাবে আমার মনে হয় রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যারকে হত্যার মোটিভ সাধারণ কোন বিষয় নয়। এটি হতে পারে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে কোন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর একটি চাল। কারণ তাঁর হত্যার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জঙ্গী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইট থেকে তাঁর জঘন্য হত্যাকা-ের দায় স্বীকারের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ যখন বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে তখন দেশী-বিদেশী কিছু কুচক্রী মহল এদেশের নিরীহ অথচ এলিট শ্রেণীর মানুষকে হত্যা করে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত। তারা জানে যে, সমাজের নির্ভেজাল অথচ জনপ্রিয় কিছু মানুষ হত্যা করতে পারলে সরকারকে চাপে রাখা যাবে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। তাদের ক্ষমতার গদিতে বসবার সুযোগ তৈরি হবে। দেশের গুণীজনের রক্তের ওপর পা রেখে যারা ক্ষমতায় যাবার এ নির্লিপ্ত চেষ্টায় মগ্ন তাদের সে স্বপ্ন আমরা জীবিত বাঙালী কোনদিনও সফল হতে দেব না। এ ব্যাপারে আমি সরকারকেও সজাগ থাকতে অনুরোধ করছি। প্রিয় স্যার, আপনি এসে দেখে যান আপনার খুনীদের বিচারের দাবিতে সারাদেশ আজ কিভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আপনার প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ আজ প্রতিবাদী ব্যানার ফেস্টুন হাতে মিছিলে মিছিলে দেশের অনেক শহর, বিশ্ববিদ্যালয় জনসমুদ্রে পরিণত করেছে। আপনার প্রিয় ক্যাম্পাসের প্রতিটি রাস্তায় ওরা আপনার খুনীদের বিচারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছে। মিডিয়াতে আপনি হয়েছেন খবরের শিরোনাম। আমরা হয়ত আপনার সে চিরতরুণ প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারব না স্যার। কিন্তু আপনার খুনীদের বিচার এদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করেই ছাড়ব। স্যার, আপনার পবিত্র শরীর থেকে ঝরে পড়া তাজা লোহিত রক্তের ঝলকানি বুঝিয়ে দিচ্ছে আপনি নাস্তিক নন। আপনি একজন আদর্শ শিক্ষক। আপনি নীরব ফটোগ্রাফার। আপনি চলচ্চিত্র বিশ্লেষক। আপনি লেখক। আপনি সংস্কৃতিমনা নিরীহ মানুষ। আমরা আপনাকে কোনদিনও ভুলব না। লেখক : সহকারী প্রক্টর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
×