ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাশিমপুরে কারা ফটকের সামনে সাবেক কারা রক্ষী খুন

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

কাশিমপুরে কারা ফটকের সামনে সাবেক কারা  রক্ষী খুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার কমপ্লেক্সের মূল ফটকের ২০০ গজ সামনে একটি ওষুধের দোকানের ভেতরে অবসরোত্তর ছুটি ভোগরত (পিআরএল) কারা সার্জেন্ট ইনস্টাক্ট্রর রুস্তম আলী হাওলাদারকে (৬০) গুলি করে হত্যা করেছে অজ্ঞাত বন্ধুকধারী সন্ত্রাসীরা। তারা নিহত রুস্তমের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে গুলি করে। এ সময় গুলি ফেরাতে বাধা দিলে বাঁ হাতে গুলি করে সন্ত্রাসীরা একটি আঙ্গুল উড়িয়ে দেয়। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে আহমেদ মেডিক্যাল সেন্টারের সামনে এ হত্যাকা- ঘটে। হত্যার সময় একটি মোটরসাইকেলে ৩ সন্ত্রাসী কারা ফটকে এসে গুলি করেই সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ রস্তম আলীকে দ্রুত শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হত্যা-ের পরপরই দেশের সকল কারাগারের ও কারা কম্পাউন্ড এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষকে সতর্কতা জারি করে চিঠি দিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক। এ ঘটনায় মেয়ের জামাতাসহ ৩ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মোঃ আব্দুস সালাম সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, রুস্তমকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। তার বুকের বাঁ পাশে, গালে ও বাঁ হাতে গুলির ক্ষত রয়েছে। তার শরীরে মোট ৬টি গুলি করা হয়। এর মধ্যে একটি গুলি তার বুকের বামপাশ দিয়ে ঢুকে হৃৎপি- ভেদ করে ডানপাশ পর্যন্ত ও অপর একটি গুলি বাম গাল দিয়ে ঢুকে ডানপাশ পর্যন্ত চলে যায়। এছাড়াও তার বাম হাতের কুনুইয়ের নিচে, ডান হাতের তর্জনি, বাম কাঁধের নিচে এবং পেটের একপাশ দিয়ে অপর ৪টি গুলি বিদ্ধ হয়ে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ময়নাতদন্তকালে তার দেহ থেকে ২টি পিস্তলের গুলি বের করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুলিগুলো করা হয়েছে। একটি গুলি হৃৎপি- ভেদ হওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে। গাজীপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেন ও জয়দেবপুর থানার ওসি রেজাউল হাসান রেজা জনকণ্ঠকে জানান, এটা নিশ্চিত রুস্তম আলী খুনের বিষয়টি জঙ্গী সম্পৃক্ত হামলার কোন ঘটনা নয়। রুস্তম আলীর জমি ও সম্পত্তি নিয়ে সম্প্রতি তার পালিত মেয়ের স্বামীর (নিহতের জামাতা) সঙ্গে রুস্তমের বিরোধ চলছিল। এর জেরে খুনের এ ঘটনা ঘটেছে কিনা তা তদন্ত করা হচ্ছে। তবে রুস্তম আলীর খুনের এ ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে নিহতের জামাতা সোহেল রানাকে (৩৫) শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে ফার্মেসির মালিক সাইফুল ইসলাম ও রফিক নামের অপর দু’জনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খুনের এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী নাসরিন আক্তার বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গাজীপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেন জানান, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সোলাইমানকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-এএসপি মোঃ মনোয়ার হোসেন, গাজীপুর ডিবির ওসি মোঃ আমির হোসেন এবং জয়দেবপুর থানার ওসি (তদন্ত) মোঃ মাহফুজুর রহমান। তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। গাজীপুরের কোনাবাড়ি ফাঁড়ির এসআই মোঃ মোবারক হোসেন বলেন, ঘটনাস্থলে ২টি গুলির খোসা পাওয়া গেছে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় দোকানিরা তাদের সকল দোকান বন্ধ করে দেন। কারা কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তের জন্য ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স গোলাম হায়দারকে প্রধান করে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি প্রিজন্সের সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার দেওয়ান তারিকুল ইসলামকে নিয়ে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। নিহতের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার চড়গাছিয়া এলাকায়। প্রাথমিকভাবে হত্যার কোন কারণ খুঁজে পায়নি পুলিশ, গোয়েন্দা সদস্যরা কিংবা কারা বিভাগের কেউ। তবে তা অতি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। দুপুরে কাশিমপুরের ঘটনাস্থলে যান কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। পরে নিহতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। এর আগে তিনি লাশ দেখার জন্য গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন হাসপাতালে যান। এ ঘটনা তদন্তের জন্য কারা অধিদফতরের পক্ষ থেকে ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স গোলাম হায়দারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া গাজীপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ৪ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। নিহত রুস্তম আলী গত বছরের ৪ নবেম্বর থেকে অবসরোত্তর ছুটিতে ছিলেন। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই গাজীপুরের জেলা পুলিশ, র‌্যাব, পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিবিআই)সহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন। পরে রুস্তম আলীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য জয়দেবপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার স্ত্রী ও তাকে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়। জানা গেছে, পরিবার নিয়ে তিনি কারা কম্পাউন্ডেই বসবাস করতেন। তার কোন সন্তানাদি ছিল না। তবে একটি মেয়েকে দত্তক হিসেবে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। তার শরীরের মোট ৬টি স্থানে গুলি করা হয়। এর মধ্যে বুকের বাম দিকে, মুখের চোয়ালে ও দুই হাতে গুলি করা হয়। গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ সময় তিনি কারা ফটকের সামনের ডেঙ্গার বাজারের একটি ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন বলে স্থনীয় ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করেছেন। কারাসূত্রে জানা গেছে, গুলি করার কিছুক্ষণ আগেই তিনি স্ত্রীকে নিয়ে গাজীপুর কোনাবাড়ি থেকে পরিবারের জন্য বাজার করেন। এরপর তিনি কারা কম্পাউন্ডে তার কোয়ার্টারে স্ত্রীকে রেখে রান্নার জন্য চাল কিনতে ডেঙ্গার বাজারে আসেন। কারা গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কারা ফটকের সামনে আসতেই একজন লোক কথা আছে বলে তাকে একটু সামনে আসার জন্য অনুরোধ করেন। পরে তাদের অনুরোধে তিনি কম্পাউন্ড এলাকা থেকে সামনের একটি ওষুধের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ান। দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ার সময়ই একজন সন্ত্রাসী তার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পরপর ৬টি গুলি করে পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ভাঙ্গাড়ি দোকানের মালিক স্বপন মিয়া, ফাস্টফুড দোকান মালিক জামাল উদ্দিনসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, ৩ জন ব্যক্তি একটি মোটরসাইকেলে চড়ে কারা ফটকের সামনে আসেন। এরপর এদের একজন মোটরসাইকেল থেকে নামলেও বাকি দুজন একটু দূরেই মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। রুস্তম আলীকে গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ বুঝে উঠার আগেই হত্যাকারী ওই মোটরসাইকেলে চড়ে নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর স্থানীয় লোকজন নিহত রুস্তম আলীকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে দৌড়ে আসেন। গাজীপুর জেলার পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ আর এম আলিফ জনকণ্ঠকে জানান, প্রাথমিকভাবে হত্যার মোটিভ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে হত্যাকা-ের সময় ক্ষুদ্র অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। হত্যার কারণ খোঁজা হচ্ছে। আমরা জানতে পেরেছি উক্ত ব্যক্তির কোন সন্তান নেই। তবে একটি পালক কন্যা সন্তান রয়েছে। তাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্পত্তির কারণে কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে কি না তা খোঁজা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও কয়েকজনকে আটক করা হতে পারে। বিষয়টি আমরা অতি গুরুত্বেও সঙ্গে দেখছি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা গেছে গুলি করার সময় তেমন শব্দ হয়নি। এ বিষয়ে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গুলি করায় আশপাশের কেউ এ সম্পর্কে বুঝতে পারেননি। পরে তারা বুঝতে পেরে দৌড়ে কাছে ছুটে যান। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হত্যা-ের কারণ হিসেবে তেমন কোন ক্লু না পাওয়া গেলেও নিহতের জমি ও স্থাবর অস্থাবর সম্পদই এ হত্যা-ের প্রধান কারণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর বাইরে কারাগারে দীর্ঘ বছর দায়িত্ব পালন করায় কোন সন্ত্রাসী বা জঙ্গী গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ব্যক্তি জীবনে রুস্তম আলী সবার সঙ্গে অত্যন্ত হাসিমুখে চলতেন বলে জানা গেছে। দায়িত্ব পালনকালীন সন্ত্রাসী বা জঙ্গীদের সঙ্গে তার কঠোর ব্যবহারের কথা সবার জানা রয়েছে। এছাড়া তিনি খেলাধুলার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। অবসর গ্রহণের মাত্র ১৫ দিন আগে তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সর্বপ্রধান কারারক্ষী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে কারা ইনস্ট্রাক্টর পদে যোগ দেন। সেখান থেকেই তিনি পিআরএলে যান। হত্যাকা-ে গোয়েন্দারা জঙ্গী সংশ্লিষ্টতাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। জানা গেছে, নিহত রুস্তম আলী পিরোজপুরে জন্মগ্রহণকারী হলেও কুমিল্লা জেলায় বড় হয়েছেন ও কুমিল্লার ঠিকানায় চাকরিতে যোগদান করেছেন। বিকেল সোয়া ৫টার সময় কারা কম্পাউন্ড মসজিদে নিহতের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। রাতে তার ক্রয়কৃত জমি দেউলিয়া বাড়িতেই দাফন করা হবে বলে নিকটাত্মীয়রা জানান। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কাশিমপুর এলাকায় রুস্তম আলীর প্রায় ১ বিঘা জমি রয়েছে। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি কাশিমপুর দেউলিয়াপাড়া এলাকায় একটি বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। উক্ত বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বে তার চাচাত ভাই রয়েছেন। কারা কোয়ার্টার ছেড়ে তিনি আগামী জুন মাসে উক্ত বাড়িতে ওঠার কথা ছিল। নিহতের দত্তক মেয়ে সন্তান সম্ভাবা বিধায় চিকিৎসার জন্য স্বামীর বাড়ি থেকে বেশ কিছুদিন যাবত মেয়েকে কাশিমপুর কারা কোয়ার্টারে এনে রেখেছেন। সূত্র আরও জানায়, উক্ত মেয়ের স্বামী মাদকাসক্ত। গত ৫ দিন যাবত উক্ত মেয়ের স্বামীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হত্যাকা-ের পর সে হাসপাতালে লাশ দেখতে আসেন। এছাড়া দত্তক মেয়েকে তার স্বামী বাবার ক্রয়কৃত কাশিমপুরের এক বিঘা জমি থেকে বেশ কিছু সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য বারবার চাপ দিচ্ছিলেন কিন্তু রুস্তম রাজি হচ্ছিলেন না। এ কারণেও হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, সকাল ১১টা ১০ মিনিটে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারা কমপ্লেক্সের সামনের ডেঙ্গার বাজারের একটি দোকানের সামনে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। অবসরোত্তর ছুটি ভোগকারী উক্ত কারা ইনস্ট্রাক্টর রুস্তম আলীকে যে বা যারাই হত্যা করুক তাদের ধরতে আমরা সর্বোচ্চ আইনী কার্যক্রম চালিয়ে যাব। সন্ত্রাসী যেই বা যত ক্ষমতাবান হউক অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিশেষভাবে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। কারা ও পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে ২টি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত দুই কমিটির রিপোর্ট প্রাপ্তির পরই কেবল হত্যাকা-ের সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে।
×