ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শফিক রেহমান জয় হত্যা ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন, জড়িত নন

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

শফিক রেহমান জয় হত্যা ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন, জড়িত নন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা ষড়যন্ত্রের মামলায় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদু রহমানের জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিমান্ডে থাকা সাংবাদিক শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান সোমবার তার বাড়িতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেছেন, তার স্বামী সাংবাদিক শফিক রেহমান জয় অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন, জয় অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনা চলছিল, তখন শফিক রেহমান ঘটনা জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন, শফিক রেহমান এফবিআইয়ের ল্যাস্টিকের সঙ্গে কথা বলেছেন, বৈঠক করেছেন, কিন্তু তিনি কোনভাবেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। সাংবাদিক শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমানের সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে তার স্বামীর বিষয়ে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেয়ার ফলে জয় অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের ঘটনায় বিএনপির হাইকমান্ড বা শীর্ষস্থানীয় আরও অনেক নেতারা যে জড়িত তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ডিবি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিবি সূত্র জানান, কারাবন্দী আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুরকে গত সপ্তাহে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সোমবার আদালতে এ বিষয়ে শুনানিতে তার জামিনের আবেদন করে রিমান্ডের বিরোধিতা করেন তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। আদালতে শুনানি শেষে জামিন নাকচ করে মাহমুদুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি দেন ঢাকার মহানগর হাকিম গোলাম নবী। গত ১৮ এপ্রিল এ মামলায় মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার দেখান তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার হাসান আরাফাত। সেদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিলেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তবে আদালত শুনানির জন্য আজ ২৫ এপ্রিল সোমবার দিন ধার্য করেছিলেন। সোমবার নির্ধারিত তারিখে মাহমুদুর রহমানকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। জয় অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের এই একই মামলায় এর আগে যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমানকেও গ্রেফতার করে বর্তমানে দ্বিতীয় দফায় ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জয়ের ব্যক্তিগত তথ্য পেতে ওই দেশে থাকা এক বিএনপি নেতার ছেলে রিজভী আহমেদ সিজার এফবিআইর এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছিলেন বলে প্রমাণিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রমাণিত হওয়ার পর তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের নথিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ক্ষতি করার লক্ষ্যে তার ব্যক্তিগত তথ্য পেতে আসামি এফবিআইয়ের এক এজেন্টকে ঘুষ দিয়েছিলেন। ঘুষ দিয়ে তথ্য পাওয়ার পর তা সিজার বাংলাদেশী ‘একজন সাংবাদিককে’ তা সরবরাহ করেছিলেন এবং বিনিময়ে ‘প্রায় ৩০ হাজার ডলার’ পেয়েছিলেন বলেও যুক্তরাষ্ট্রের নথিতেই উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়ের পর জয়কে অপহরণের চক্রান্তের অভিযোগ তুলে ঢাকার পল্টন থানায় পুলিশ একটি মামলা করে, যাতে সিজারের বাবা প্রবাসী বিএনপি নেতা মেহম্মদ উল্লাহ মামুনসহ দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেও আসামি করা হয়। সেই মামলাতেই গত ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার হন সাংবাদিক শফিক রেহমান। মাহমুদুর রহমানকেও যে এ মামলায় গেফতার দেখানো হবে, তা ওই সময়ই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান আমার দেশ পত্রিকার মালিকানা কিনে সম্পাদক বনে যান। ২০১৩ সালে ধর্মীয় উসকানি ও রাত্রদ্রোহের মামলায় গেফতার হওয়ার পর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। স্ত্রী তালেয়া রহমানের স্বীকারোক্তি, ‘শফিক রেহমান জানতেন’॥ সাংবাদিক শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান স্বীকার করেছেন, এফবিআই এজেন্ট রবার্ট ল্যাস্টিকের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়টি শফিক রেহমান জানতেন এবং তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছিল। জয়কে অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনা চলছিল, তখন শফিক রেহমান ঘটনা জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন। এফবিআইয়ের ল্যাস্টিকের সঙ্গে কথাও বলেছেন শফিক রেহমান। শফিক রেহমান জয়ের বিষয়টি আগেই জানলেও তিনি (তালেয়া রেহমান) পরে জেনেছেন বলে জানান তালেয়া রেহমান। সোমবার ইস্কাটনের বাড়িতে শফিক রেহমানের অফিসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বামী শফিক রেহমানের বিষয়ে এই স্বীকারোক্তি দেন স্ত্রী তালেয়া রেহমান। ঢাকার ইস্কাটনে তাদের বাসায় পুলিশের তল্লাশিতে নথি জব্দের বিষয়টিও সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেছেন তিনি। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেমোক্রেসিওয়াচের নির্বাহী প্রধান তালেয়ার দাবি, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিক’ হিসেবে নিবন্ধ লেখার জন্যই শফিক রেহমান ওই নথি সংগ্রহ করেছিলেন। একই কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এফবিআই এজেন্ট ল্যাস্টিকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নথি পাওয়া গেছে সেটা ঠিক। বাসায় এসেছিলেন উনারা (পুলিশ)। উনি (শফিক রেহমান) অত্যন্ত গোছানো মানুষ। যত লেখা লিখেছেন, সে সম্পর্কে তথ্য তিনি ফাইল করে রেখেছেন, এটাও ফাইল করা ছিল। এটা তিনি ওদের দিয়েছেন।’ তালেয়া রেহমান বলেছেন, জয়কে অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের কথা সাংবাদিক শফিক রেহমান হয়ত জানতেন, কিন্তু তিনি কোনভাবেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন বলে জানিয়ে বলেন, সাংবাদিক শফিক রেহমান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের নানা মন্তব্যে শঙ্কিত। এইসব বক্তব্যকে ‘একপেশে, অসত্য ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপন’ বলে দাবি করেন তিনি। এ ধরনের বক্তব্যে আমি শঙ্কিত যে এ মামলার তদন্ত কাজ সঠিক পথে এগোবে কি না এবং আমরা ন্যায়বিচার পাব কি না ? তালেয়া রেহমান দাবি করেন, শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুক পেজে একের পর এক মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন। এতে শফিক রেহমানের মানহানি ঘটছে, অন্যদিকে মামলার তদন্ত কাজকে প্রভাবিত করছে। জয় সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই এ সংশয় জাগা অমূলক নয় যে, উদ্দেশ্যমূলক এ মামলাটির তদন্ত কাজও উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এগোচ্ছে। তালেয়া রেহমান তার স্বামী সাংবাদিক শফিক রেহমানকে দেশপ্রেমিক সাংবাদিক উল্লেখ করে তাঁর বিরুদ্ধে দেয়া মামলা প্রত্যাহার, রিমান্ড বাতিল ও মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার স্বামী শফিক রেহমান গুরুতর অসুস্থ, তা জানানোর পরও গ্রেফতারের পর থেকে তাঁকে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়নি। তার বয়স, অসুস্থতা ও রিমান্ডে নির্যাতনের ফলে তাঁর জীবনহানির আশঙ্কা করছি বলে তালেহা রহমানের দাবি। আমেরিকার আদালতে মামলাটি এক বছরেরও আগে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সেই মামলার সূত্র ধরে শফিক রেহমানের মতো একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার ও রিমান্ড শুধু অমানবিকই নয়, অসভ্যতাও বলে দাবি করেন তালেয়া রেহমান। তিনি বলেন, প্রথম দফা রিমান্ডের পর শফিক রেহমানের সঙ্গে কথা হয়েছে আদালতে। জোর করে তাঁর কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি নেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি । আদালতে শফিক রেহমানকে বিষণœ ও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। মশার কামড়ে তিনি ঘুমাতে পারেননি। তাঁর হাতের কয়েক জায়গায় ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে। তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন হয়েছে বলে অনুমান করছি। শফিক রেহমান ভয়ে অনেক কথাই তিনি আমার সঙ্গে শেয়ার করতে চাননি বলে তালেয়া রেহমানের দাবি। একজনের নাম শুনেছেন ॥ জয় অপহরণ ও ষড়যন্ত্রের ঘটনায় আরও কয়েকজন বাংলাদেশীর জড়িত থাকার যে দাবি পুলিশের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে, সে বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তার জবাবে তালেয়া রেহমান বলেন, স্বামীর কাছ থেকে তিনি ‘একজনের’ নাম শুনেছেন। স্বামীর কর্মকা-ের ব্যাখ্যায় তালেয়া বলেন, ‘এই যে কিছু তথ্যের আদান-প্রদান হয়েছে, সেই তথ্যটা ছিল একজন বিশেষ পারসন সম্পর্কে...। নিশ্চয়ই ঘটনার সময় জানতেন বলেই আমেরিকায় গিয়েছিলেন। ওই সময়ই, ‘সম্ভবত ২০১২ সালে’ ল্যাস্টিকের সঙ্গে শফিক রেহমানের দেখা হয় বলে তালেয়ার ভাষ্য। শফিক রেহমানও স্বীকার করেছেন ॥ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়ার পর গত ১৯ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, জয় সম্পর্কে তথ্য পেতে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় দ-িতদের সঙ্গে ‘একাধিক বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন’ শফিক রেহমান। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ সেদিন বলেন, ‘শফিক রেহমানের নিজের হেফাজতে রাখা সজীব ওয়াজেদ জয় সংক্রান্ত প্রাথমিক কিছু তথ্য, বাড়ি, গাড়ির নম্বর, কোথায় থাকেন, এসব... আর গোপনীয় কিছু নথিপত্র পাওয়া গেছে। তিনি এসব সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।’ স্বীকার করেছেন ছেলে সুমিত রেহমানও ॥ সাংবাদিক শফিক রেহমানের ছেলে সুমিত রেহমানও স্বীকার করেছেন, ‘আমার বাবা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, তিনি হয়ত প্রধানমন্ত্রীপুত্রের আয় ও সম্পদের অনুসন্ধান করছিলেন, তিনি হয়ত এক্ষেত্রে অনেক দূর গিয়েছেন। গত সপ্তাহে লন্ডনে শফিক রেহমানের মুক্তির দাবিতে এক সমাবেশে এই দাবি করেছেন তার ছেলে সুমিত রেহমান। শফিক রেহমানের ‘মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, রিমান্ড বাতিল ও মামলা প্রত্যাহারের’ দাবিতে সোমবার ইস্কাটনের সংবাদ সম্মেলনে তালেয়া রেহমানও স্বামীর কর্মকা- সম্পর্কে স্বীকার করলেন।
×