ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে কুপিয়ে দুজনকে হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে কুপিয়ে  দুজনকে হত্যা

স্টাফ রিপোর্টার। রাজধানীর কলাবাগানে দিন দুপুরে বাসায় ঢুকে ফিল্মি স্টাইলে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই ও তার এক বন্ধুকে। হাতে পার্সেলের প্যাকেট নিয়ে হত্যাকারীরা বাসায় ঢুকে ব্লগার হত্যার স্টাইলে ঘাড়ে কুপিয়ে হত্যাকা-টি ঘটায়। হত্যাকারীদের চাপাতির আঘাতে আহত হয়েছেন বাড়ির এক নিরাপত্তাকর্মী, এক পুলিশ কর্মকর্তা ও এক কলেজ ছাত্র। হত্যা শেষে পিস্তল উঁচিয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যায়। জঙ্গীরা হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত তদন্তকারী সংস্থাগুলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লোম বার্নিকাট হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ৩৫ নম্বর লেক সার্কাস কলাবাগানের আছিয়া নিবাস নামের সাততলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ঘটনাটি ঘটে। নিহত জুলহাস মান্নান (৩৫) আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাত ভাই। জুলহাস বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লোম বার্নিকাটের প্রটোকল অফিসার ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইউএস এইডে কর্মরত। তার পিতা সাবেক উপ-সচিব আব্দুল মান্নান (মৃত)। মা সখিনা খাতুন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে জুলহাস ছোট ছিলেন। তার আরেক ভাইয়ের নাম ইমন। তিনি গুলশানে বসবাস করেন। বাড়ি চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার নরিনপুরে। ব্যক্তি জীবনে জুলহাস সমকামীদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। তিনি রূপবান নামের একটি সাময়িকীর সম্পাদনা করতেন। সাময়িকীটিতে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে নানা লেখালেখি প্রকাশিত হতো। নিহত অপরজন জুলহাসের বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় (২৬) বলে জানা গেছে। তিনি লোকনাট্য দলের কর্মী ছিলেন। তিনি পিটিএ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ‘শিশু নাট্য প্রশিক্ষক’ হিসেবে কাজ করতেন বলে তার টুইটার এ্যাকাউন্টে বলা হয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, যুবকরা হাতে পার্সেল নিয়ে বাসায় ঢুকতে গেলে নিরাপত্তা প্রহরী পারভেজ তাদের পরিচয় জানতে চান। তারা নিজেদের একটি কুরিয়ার সার্ভিসের লোক বলে পরিচয় দেয়। তারা পার্সেলগুলো জুলহাস সাহেবের বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য এসেছে বলে জানায়। পারভেজ মোল্লা দোতলায় জুলহাস মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার নামে কোন পার্সেল আসার কথা নয় বলে জানান। এরপর একজন কথা বলতে বলতেই অন্যরা উপরে চলে যায়। এ সময় পারভেজও পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যায়। জুলহাস যুবকদের বলেন, স্যার যেহেতু আপনাদের আসতে বলেননি, তাই আপনারা ভেতরে ঢুকবেন না। পারভেজ তাদের সঙ্গে না ঢুকতে পীড়াপীড়ি শুরু করেন। এ সময় যুবকরা পার্সেলের প্যাকেট থেকে চাপাতি বের করে পারভেজের কপালে ও হাতে আঘাত করে। পারভেজ চিৎকার দিয়ে পড়ে যায়। ততক্ষণে কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেন জুলহাস। রক্তাক্ত পারভেজকে পড়ে থাকতে দেখে জুলহাস আবার দরজা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু হত্যাকারীরা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই জুলহাসের ঘাড়ে কোপাতে থাকে। ওই সময় বাসায় বৃদ্ধ মা ও শারীরিক প্রতিবন্ধী এক গৃহপরিচারিকা ছিলেন। এরপর তনয়কে ভেতরে ঢুকে একই কায়দায় হত্যা করে। ভেতরের রুমে থাকা গৃহকর্মী ও বৃদ্ধ মা বের হওয়ার আগেই হত্যাকা- ঘটিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে। পারভেজ মোল্লা (২০) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রত্যক্ষদর্শী এক স্কুলছাত্র জানায়, সে বাড়িটির অদূরে তেঁতুলতলা মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল। মাঠটি রাস্তা লাগোয়া। এ সময় ৫ যুবক একই ড্রেস পরে হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের সবার পিঠে কালো ব্যাগ। তাদের বয়স আনুমানিক বিশ থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে। প্রথমে তাদের দেখে মনে হচ্ছিল কোন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এদের মধ্যে ৩ জনের হাতে পার্সেলের বাক্স ছিল। পার্সেল দেখে মনে হচ্ছিল তারা কোন ডেলিভারিসপে কর্মরত। অনেকটা হোম ডেলিভারিম্যানদের মতো। ওই স্কুলছাত্র আরও জানায়, তারা যথারীতি খেলছিল। খানিক পরেই তাদের পিস্তল হাতে দৌড়ে যেতে দেখা যায়। সবাইকে সরে যেতে বলছিল তারা। সরে না গেলে গুলি চালিয়ে দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছি। আমরা ভয়ে মসজিদের ভেতরে ঢুকে পড়ি। এ সময় অনেক মানুষকে ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করতে শুনি। তাদেরও পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল। তারা ডলফিন গলির দিকে চলে যায়। অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় এক ছাত্র ডাকাত ভেবে তাদের পিছু নেয়। ওই ছাত্র ইট হাতে নিয়ে তাদের আঘাত করার চেষ্টা করে। এ সময় একজন চাপাতি দিয়ে ওই ছাত্রের বাম হাতে ও মাথায় আঘাত করে। ওই ছাত্রের নাম আনোয়ার হোসেন লিংক (১৮) বলে জানান তার মা আনোয়ারা বেগম আনু। তিনি ছেলেকে নিয়ে কলাবাগান পোড়া বস্তিতে বসবাস করেন। লিংকন এবার আইডিয়াল কমার্স থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আনোয়ারকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কলেজছাত্রকে আহত করার পর হত্যাকারীরা মূল রাস্তার দিকে যেতে থাকে। এ সময় সেখানে পুলিশের একটি টহল টিম দায়িত্বরত ছিল। পুলিশ ওই যুবকদের পিছু নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন চাপাতি দিয়ে সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মমতাজ হোসেনকে আহত করে। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে ও হত্যাকারীরাও গুলি চালাতে চালাতে পালিয়ে যায়। পুলিশ কর্মকর্তা মমতাজ এক হত্যাকারীর কাছ থেকে একটি ব্যাগ রেখে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যাগে গুরুত্বপূর্ণ আলামত পাওয়া গেছে বলে দাবি করছে পুলিশ। যাওয়ার সময় তাদের আটকাতে গিয়ে এএসআই মমতাজ জখম হন বলে জানান ডিএমপির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান। তিনি বলেন, এএসআই মমতাজ হামলাকারীদের একজনের কাছ থেকে একটি ব্যাগ ছিনিয়ে রাখেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ খুনীদের একটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ আলামত পাওয়া গেছে। ওই ব্যাগে মোবাইল ফোনসহ কিছু জিনিস পাওয়া গেছে বলে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে বিস্তারিত কিছু কোন কর্মকর্তাই বলতে চাননি। ঘটনার পর পরই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এবং কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম, রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক আব্দুল বাতেন, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিনসহ পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে হাজির হন। এছাড়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন, ডিবি, র‌্যাব, পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকা-ের আলামত সংগ্রহ করে। রাত নয়টার দিকে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, হত্যাকা-ের ঘটনা সংঘটিত করতে কোন গুলি চালায়নি হত্যাকারীরা। হত্যাকারীদের শনাক্তসহ হত্যাকা-ের মোটিভ জানতে গভীর তদন্ত চলছে। রাতে লাশ দুটি উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, হত্যাকা-ের সঙ্গে জঙ্গীরা জড়িত বলে অনেকটাই নিশ্চিত। প্রসঙ্গত, গত ৬ এপ্রিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক নাজিম উদ্দিন সামাদকে পুরনো ঢাকার রাস্তায় সন্ধ্যায় একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গত শনিবার রাজশাহী নগরীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সোমবার সকালে গাজীপুরের কাশিমপুরের কারাফটকের কাছে সাবেক কারারক্ষী রুস্তম আলীকে হত্যা করা হয়। এমন ঘটনায় বাংলাদেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লোম বার্নিকাট নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। তিনি দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেফতার করার দাবি জানান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, অর্থহীন এই সহিংসতার কঠোর নিন্দা জানাই আমরা। এই বর্ববর হত্যাকা-ে আমি হতবাক। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে আমাদের যারা জুলহাসের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদের কাছে সে ছিল সহকর্মীর চেয়েও বেশি কিছু। সে ছিল আমাদের প্রিয় বন্ধুর মতো। জুলহাস ও তার বন্ধুর জন্য এবং হামলায় যারা আহত হয়েছেন, তাদের সবার জন্য আমার প্রার্থনা রইল।
×