ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে কাজ করছে বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনা কমিটি

এসডিজি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

এসডিজি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে চায় বাংলাদেশ। যদিও এর ব্যাপকতা ও গভীরতা পূর্বের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও এমডিজিতে অর্জিত সাফল্য ধরে রেখে এসডিজি বাস্তবায়নে ১৫ বছরের রোডম্যাপ করা হচ্ছে। সে অনুযায়ীই বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি পরিকল্পিত ও বাস্তবসম্মতভাবে আগামীর লক্ষ্য পূরণে কাজ করবে সরকার। সেজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। রোডম্যাপ তৈরির কাজ করছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। সংস্থাটি সবগুলো মন্ত্রণালয়সহ বেসরকারী খাতকে যুক্ত করে এই রোডম্যাপের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে ১৯৩টি সদস্য দেশ ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা হিসেবে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি অনুমোদন করেছে। এতে ১৭টি গোল এবং ১৬৯টি টার্গেট রয়েছে। অন্যদিকে এমডিজিতে ৮ মূল অর্জনের জন্য ২১টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যাতে অগ্রগতি পরিমাপকের জন্য ৬০টি সূচক নির্ধারণ করা ছিল। এসডিজি অর্জনের রোডম্যাপ বিষয়ে জিইডির সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে এসডিজি বাস্তবায়ন কর্মপরিকল্পনা তৈরিকে সর্বোচ্চ প্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এসডিজি বাস্তবায়নে দেশজ ও বৈদেশিক সহায়তা কত প্রয়োজন হবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে এজন্য স্টাডি পরিচালনা করা হচ্ছে। তাছাড়া এসডিজি বাস্তবায়নে সব মন্ত্রণালয় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। কারণ এমডিজিতে ভাল করায় বাংলাদেশ চারটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। এজন্য এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশের মধ্যে আমরা স্থান করে নিতে চাই। সে লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ সূত্র জানায়, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই যেসব কার্যক্রম করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, ২০১৫ সালের ২৫ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক চিঠিতে মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদকে আহ্বায়ক করে ১২ সদস্য বিশিষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনা সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হয়। যার সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছে পরিকল্পনা কমিশনের জিইডি। পরবর্তীতে চার থেকে সাত ডিসেম্বর পর্যন্ত জিইডির উদ্যোগে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৬-২০) এর তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয় এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মন্ত্রণালয় বা বিভাগভিত্তিক ম্যাপিংয়ের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করা হয়। চলতি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যাপিং সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জিইডি। এছাড়া চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি জিইডি থেকে ডিও লেটারের (উপ-আনুষ্ঠানিক পত্র) এসডিজি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিবদের কাছে এসডিজি ম্যাপিং পাঠানো হয়। সেই সঙ্গে ম্যাপিং বিষয়ক মতামত প্রদানও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলোর সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কর্মকৌশল (এ্যাকশন প্ল্যান) চূড়ান্তকরণের জন্য ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইনপুট দিতে বলা হয়। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের বিশেষ দূত লুইস ফার্নান্দো কারিরা ক্যাস্ত্রোর উপস্থিতিতে এবং মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে এসডিজির পরিকল্পনা ও পর্যালোচনা সংক্রান্ত একটি কর্মশালার আয়াজন করে। এসডিজি বাস্তবায়নে বেসরকারী খাতের করণীয় বিষয়ে ইউনাইটেড নেশনস রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটর এবং জিইডি যৌথভাবে গত ৩০ মার্চ উন্নয়নসহযোগী, এনজিও, সিএসও, গণমাধ্যম ও জাতীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এসডিজির বিষয়ে মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ এর আগে বলেন, অধিকাংশ মানুষ মনে করে এসডিজির লক্ষ্য উচ্চাভিলাসী। কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমি বরং মনে করি এটি চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ নয় মাসে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে এখন এসডিজির চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে পারবে। তিনি জানান, এসডিজি বাস্তবায়নের কৌশল বিষয়ে কাজ চলছে। সূত্র জানায়, তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি)। এগুলো হচ্ছে চলমান সপ্তম, এর পরবর্তী অষ্টম এবং নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। আর এজন্য শুরু থেকেই দীর্ঘ মেয়াদী রোডম্যাপ তৈরিতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে এসডিজি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। এসডিজি বাস্তবায়নে প্রথমে নেতৃস্থানীয় মন্ত্রণালয় ঠিক করা হয়েছে। তারপর নির্ধারণ করা হয়েছে কোন মন্ত্রণালয় কোন কোন গোল বাস্তবায়নে কাজ করবে বা কৌশল প্রণয়ন করতে পারবে। চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজির ১৪টি প্রধান লক্ষ্যের (গোল) ৮২ শতাংশ সরাসরি কভারেজ হবে। আর ১নং ১৬নং এবং ১৭ নম্বর গোলের ১৮ শতাংশ মিল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ ৪৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সরাসরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত। সেই সঙ্গে ছয়টি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও জড়িত রয়েছে এসডিসি বাস্তবায়নের সঙ্গে। এগুলো হচ্ছে, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, কন্ট্রোলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেল, নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তাছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগসহ (জিইডি) বাকি ছয়টি বিভাগকেও যুক্ত করা হয়েছে এসডিজি বাস্তবায়নের সঙ্গে। অন্যদিকে এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিতে সন্তষ্ট প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় জাতিসংঘের বিশেষ দূত লুইস ফারনান্দো কারিরা কাস্ট্রো বলেন, বাংলাদেশ সঠিক সময়ই রোডম্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেছে। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছেন তিনি। এগুলো হচ্ছে, শক্তিশালী সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং বৈদেশিক সহায়তা নির্ভরতা। এগুলো মোকাবেলা করা গেলে এসডিজির বাস্তবায়ন সম্ভব। আমরা বিশ্বব্যাপী এসডিজি বাস্তবায়নে একটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিশ্চিত করতে কাজ করছি। এসডিজি বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পক্ষে মত দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধাক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান। তিনি বলেন, এসডিজির পরিকল্পনাগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগে স্থানীয় সরকারগুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব থেকে বেরিয়ে সঠিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে হবে। এমডিজির বাস্তবায়ন সম্পর্কে যা শোনা যাচ্ছে তার বিপরীতটাও সত্য। আমরা অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে পেরেছি সত্য। কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু এখনও বাকি রয়ে গেছে। এমডিজির উন্নত রূপ এসডিজি বাস্তবায়ন কর্মপরিকল্পনায় স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু বিপত্তির কথাও উল্লেখ করেন ড. আকবর আলী খান। তিনি বলেন, বাস্তবে আমাদের দেশে কোন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নেই। কারণ স্থানীয় সরকার কখনও কেন্দ্রীয় সরকারের অংশ হতে পারে না। কেদ্রীয় সরকারের প্রভাবাধীন হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে তো আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি। এর আগে ব্র্যাক ও হাঙ্গার প্রজেক্ট আয়োজিত ‘এসডিজির স্থানীয়করণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেছিলেন।
×