ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

বৈশাখে চায়ের হালখাতা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

বৈশাখে চায়ের হালখাতা

নতুন বাংলা বছরের প্রথম দিনটি কেমন কাটল? এর উত্তরে একদল বলবেন ভাল। আরেক দল বলবেন খারাপ। মধ্যপথাবলম্বী বলবেন, মোটামুটি, মিশ্রফলপ্রদ। শেষোক্ত শব্দটি পাঁজিকার তথা পঞ্জিকা লেখকদের খুব প্রিয়। পুরনো বছরের শেষে এবং নতুন বছরের শুরুতে বাজারে অসংখ্য পঞ্জিকা বেরিয়েছে- লোকনাথ, নবযুগ, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্ত বাগীশ; ফুল, হাফ, পকেটসাইজ ইত্যাদি বিবিধ রকমের দামী ও সুলভ সংস্করণ। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ- উভয় অংশেই পঞ্জিকার আধিক্য ও প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য গোটা উপমহাদেশেই এর প্রভাব দুর্দমনীয়। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, সিকিম এমনকি পাকিস্তানেও পঞ্জিকার সবিশেষ কদর। লাহোর-করাচিতেও আমরা জ্যোতিষালয় দেখেছি। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের লোকজন বেশ মেনে থাকে পঞ্জিকাকে। বিশ্বে বামপন্থী ঘরানার দেশ বলে পরিচিত চীনের লোকজনও অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণ করে থাকে পঞ্জিকার নির্দেশনা। এমন যে শক্তিমান ও তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, তিনি পর্যন্ত এই একবিংশ শতাব্দীতে বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিষেক-ঐশ্বরিয়ার বিয়ে দিলেন পঞ্জিকার যাবতীয় দিন-ক্ষণ, শুভ-অশুভ খুঁটিনাটি মেনে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও অনুরূপ করা হয় কিনা, জানি না। তবে সেসব দেশেও জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতিষালয় এক শ্রেণীর মানুষের অতীব আগ্রহ ও কৌতূহলের বিষয়। পাঁজিকাররা দাবি করেন, তারা মহাশূন্যে ভাসমান গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহ, চন্দ্র-সূর্য, রাহু-কেতু-শনি-মঙ্গল ইত্যাদির প্রভাব-প্রতিপত্তি-প্রকোপ মিলিয়ে মানুষ ও রাষ্ট্রের ব্যক্তিগত দিনলিপি ও বর্ষফল নির্ণয় করে থাকেন। জানি না, তাদের গবেষণাগার তথা মানমন্দির ঠিক কোথায়? ঠিক কোথায় তারা বসে আকাশভরা সূর্য-তারা. গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেন? একদা আর্যভট্ট, বরাহ মিহির, খনা প্রমুখ ঐতিহাসিক জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞদের কিন্তু মানমন্দির ও পর্যবেক্ষণগার সত্যি সত্যিই ছিল। এমনকি উপমহাদেশের বর্তমান পঞ্জিকা ও দিনপঞ্জির বর্তমান যে আধুনিক রূপ আমরা দেখে থাকি, তার অন্যতম সংস্কারক মেঘনাদ সাহা ছিলেন একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। ঠিক জানি না, একেবারে হাল আমলের বর্তমান পঞ্জিকা প্রকাশনার ধারায় সেই রীতি আদৌ অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা! তবে অধিকাংশ পঞ্জিকার ভাষা ও রচনারীতি দেখি প্রায়শই একরকম, গৎবাঁধা ও গতানুগতিক। মানুষের ব্যক্তিগত অথবা রাষ্ট্রের রাশিফল যা-ই বলা হোক না কেন, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের। ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভ, আগডুম-বাগডুম মিলিয়ে কিছু মন হরণকারী, কিছু চিত্ত বিক্ষেপকারী কথা বলার চেষ্টা আর কী! মানে সেই যে শুরুতেই বলেছি, মিশ্রফলপ্রদ। যথার্থই একটি হেয়ালিপূর্ণ শব্দ বটে। চরম খামখেয়ালী পরিলক্ষিত হচ্ছে আবহাওয়ার আচার-আচরণেও। বছরের শেষে অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু মৃদু ঝঞ্ঝাবাত ও বৃষ্টি ঝরে পড়ার কারণে চৈত্রের দাবদাহ তেমন অনুভূত হয়নি। সেই হিসেবে বলা যায়, বসন্ত কেটেছে ভালোয় ভালোয়। তবে প্রকৃতই গ্রীষ্মের দাবদাহ দেখা দিয়েছে বৈশাখের শুরু থেকেই। সিলেটসহ দেশের দু’একটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ঝড়-বজ্রবৃষ্টি হলেও, মোটের ওপর সারাদেশের আবহাওয়া শুকনো, খরতপ্ত। অসহনীয় গরম ও ঘামে মানুষ জেরবার। আকাশে ছন্নছড়া কিছু হাল্কা-পাতলা মেঘ দেখা দিলেও মোটের ওপর বলা যায় বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, হে রুদ্র বৈশাখ! হায়, চিরায়ত অমলিন প্রেম ও প্রকৃতির এই অবিস্মরণীয় কবি জন্মেছিলের এহেন নিদাঘতপ্ত বৈশাখে! তাই বলে নিছক বৈশাখ বন্দনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র নানা রং-বেরঙের অনুষ্ঠানের আদৌ কোন কমতি না থাকলেও এবারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সময় নিয়ন্ত্রণসহ কিছু বিধিনিষেধ থাকায় সেসবে সহজ-স্বাভাবিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা পরিলক্ষিত হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। বেঁধে দেয়া সময়ের আগে পরে জনসমাগমের, বিশেষ করে মহিলাদের আনাগোনা তেমন চোখে পড়েনি। অনেক গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সময়সীমাজনিত বিধিনিষেধের কারণে ঐতিহ্যবাহী অনেক গ্রামের মেলাও জমেনি তেমন। এরপরও বলতেই হয় স্বাগত নববর্ষ, পুরনোকে বিদায় জানিয়ে। সর্বস্তরের মানুষ সবসময়ই প্রত্যাশা করে, যা কিছু জরাজীর্ণ, কলুষিত, সেসবকে ঝেটিয়ে বিদায় দিয়ে নতুন কিছু, নতুন দিনকে বরণ করে নিতে। রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিনই চলছে নানা আয়োজন, নানা প্রদর্শনী, সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা এমনকি শোকসভা। ধানম-ির দৃক গ্যালারিতে চা-শ্রমিকদের জীবন নিয়ে প্রদর্শনী নজর কেড়েছে অনেকের, শিরোনাম ছিল ‘প্রান্তের জাতিসত্তা’। ‘চা শ্রমিক ও স্বল্প পরিচিত জাতিসত্তার পরিচয়, মানচিত্র ও অধিকার’ বিষয়ে পুনর্ভাবনাবিষয়ক জাতীয় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর পরিচয়, অবস্থান ও তাদের অধিকার বিষয়ে পর্যালোচনা’ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত হয়েছে নাগরিক সংলাপ। রাজধানীর সিবিসিবি সেন্টারে এই সংলাপের আয়োজন করে পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর এনভারবনমেন্ট এ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড)। এসব তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণাভিত্তিক আলাপ-আলোচনা ও প্রদর্শনীতে চা শ্রমিকদের অন্তহীন বেদনা ও বঞ্চনার যে মর্মন্তুদ চিত্র উঠে এসেছে, তা এক কথায় অসহনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। প্রধানত রাজধানীকেন্দ্রিক ও শিল্পাঞ্চলভিত্তিক হওয়ার কারণে বার বার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বিদেশীদের অব্যাহত চাপের কারণে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি এবং সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। অবশ্য এখনও এসব পর্যাপ্ত ও সন্তোষজনক নয় বলে চাপা অসন্তোষও বিদ্যমান। অন্যদিকে সম্প্রতি খুলনা অঞ্চলের সরকারী পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আহূত ধর্মঘটেরও সুষ্ঠু ও সমন্বিত মীমাংসা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায়। তবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার কারণে চা শ্রমিকদের ভাগ্যের আদৌ কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আর কবে তা ঘটবে অথবা আদৌ কোনদিন ঘটবে কিনা, তা জানে না কেউ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেড বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশের সিলেট ও চট্টগ্রামের ১৫৬টি চা বাগানে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওপর জরিপ চালিয়েছে। সেডের হিসাবে, বাগানগুলোতে থাকা শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৬ হাজার বাঙালী। বাদ বাকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। বাগানে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৮০টি। সরকারীভাবে তাদের কোন স্বীকৃতি নেই। অসহায় এসব মানুষের অবস্থান সম্পর্কে জানানো এবং তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা ছিল নাগরিক সংলাপের উদ্দেশ্য। চা শ্রমিকদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে সেড পরিচালক ফিলিপ গাইন বলেন, এখনও চা শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ৮৫ টাকা। ২০০৯ সালে তা ছিল ৩২ টাকা ৫০ পয়সা। চা বাগানে স্কুলের চেয়ে শিক্ষক কম। পরিবার নিয়ে ৭ লাখ শ্রমিক জনগোষ্ঠী পুরোপুরি ভূমিহীন। এটা খুবই সুবিদিত ইতিহাস যে, প্রায় ৫ হাজার বছর আগে স্বাস্থ্যমনস্ক চৈনিক সম্রাট শেননং পানি ফুটিয়ে পান করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে চা আবিষ্কার করেন। ফুটানো গরম পানিতে অজ্ঞাত কিছু বনজপাতা উড়ে এসে পড়লে পানি হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে। সম্রাট তা পান করে প্রীত হন এবং শরীর ও মনে চনমনে আস্বাদের অনুভূতি পান। সেই থেকে শুরু চায়ের অগ্রযাত্রা। চীনা ভাষায় টি-এর উচ্চারণ চি। ইংরেজী টি-এর নামকরণ হয় গ্রিক দেবী থিয়ার নামানুসারে। বিজ্ঞানীদের দেয়া নাম ক্যামেলিয়া সাইনেসিস। চীনা মনীষী লাওৎসে চাকে বলতেন মহৌষধ ও পরশমণি। বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশেরও বটে, বিখ্যাত সুপ-িত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর ১০৪০ সালে তিব্বত ভ্রমণকালে আপ্যায়িত হন চা দিয়ে। চায়ের প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদন তথা চাষাবাদও শুরু হয় চীনে। তবে খুব বেশিদিন নয়, মাত্র ৩৬৬ বছর আগে ১৬৫০ সালে, সম্ভবত ব্রিটিশদের হাত ধরে। ভারতবর্ষেও চা চাষের প্রচলন করে ব্রিটিশরা প্রধানত ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে। প্রথমে গঠিত হয় অসম টি কোম্পানি; পরে টি সেলস কমিটি ও টি এক্সপানশন বোর্ড। অচিরেই ‘টি নিউজ এ্যান্ড ভিউজ’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে দৈনিক বুলেটিন। সবকিছুর মূলে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-সম্প্রসারণ ও বাণিজ্যিক স্বার্থ। হাট-বাজার, রেলস্টেশন, স্টিমার ঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয় চায়ের স্টল। আকর্ষণীয় এনামেল বোর্ডে দেখানো হয়, শাশ্বত বাংলার বধূ চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে লেখা, যাহাতে নাহিক মাদকতা দোষ, কিন্তু পানে করে চিত্ত পরিতোষ। সত্যি বলতে কী, একেবারে আসমুদ্রহিমাচলÑ চট্টগ্রাম, মাদ্রাজ, লাহোর, কলকাতা, দিল্লী, বোম্বাই, করাচী সর্বত্র টাঙিয়ে দেয়া হয় বিজ্ঞাপন। বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে পরিবেশিত হতে থাকে চা। অতঃপর বিনা পয়সায় মানুষ যদি আলকাতরা খেতে পারে, চা কেন খাবে না? বলা হলো, সম্পদ স্বাস্থ্য ও সুখ যা-ই চান, সবই পাবেন চায়ের পেয়ালায়। আরও বলা হলো নেশা নিবারণের অন্যতম পানীয় হলো চাÑ তা সে মদ, গাঁজা যা-ই হোক না কেন! বাংলাদেশে প্রথম চা চাষের সূত্রপাত ১৮৪০ সালে, বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাবের সন্নিহিত পাহাড়ী ঢালে। পরে আরও ব্যাপক ও বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়ায় ১৮৫৭ সালে। চা চাষের জন্য অতি সামান্য মজুরিতে দলে দলে শ্রমিক আনা শুরু হয় ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ ও অন্যান্য স্থান থেকে। অনেকটা জোর করে, অশিক্ষিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দুর্বলতাকে পুঁজি করে। শুরু হয় বন কেটে বসত ও চা চাষ। অসম, ডুয়ার্স, দার্জিলিং, সিলেট, চট্টগ্রাম ও অন্যত্র শুরু হলো সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। পানীয় হিসেবে পানির পরেই বিশ্বব্যাপী চাকে এতই আত্তীকরণ করা হয়েছে যে, আমরা এর পটভূমি ও প্রেক্ষাপটের বিশাল করুণ ও মর্মন্তুদ ক্যানভাসটির কথা প্রায়ই ভুলে যাই। চায়ের কাপে তুফান বর্তমানে নিছক একটি রাজনৈতিক বুলি বা প্রবচন। অথচ এই চা চাষ এবং বাণিজ্যিকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের ইতিহাসে সংঘটিত হয়েছে একাধিক গৃহযুদ্ধ। ব্রিটিশরা চীনাদের বঞ্চিত করে হাজার হাজার টন চা আমদানি শুরু করে। বিনিময়ে চীন ব্রিটিশ পণ্য নিতে আগ্রহী না হওয়ায় ঘটে প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩২-১৮৪২)। চায়ের বদলে আফিম কেনার চুক্তিতে আসতে ব্রিটিশ বেনিয়ারা বাধ্য করে চীনাদের। অন্যদিকে চায়ের আবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের উৎখাত করে শুরু হয় হতদরিদ্র বহিরাগত শ্রমিকদের জনবসতি অসম ও সেভেন সিস্টার্সে। এর ফলে প্রাচীন তীব্বতি-বর্মী সমাজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনুরূপ ঘটে শ্রীলঙ্কায়। ভারতবর্ষ থেকে আগত তামিল ও সিংহলীদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে অগণিত মানুষ প্রাণ হারায়। এখানেও শিখ-ির ভূমিকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের। এমনকি আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনাও চাকে কেন্দ্র করে। অতিরিক্ত শুল্কে চা কিনবে না বলে স্যামুয়েল এ্যাডামসের নেতৃত্বে বোস্টন বন্দরে চায়ের পেটিগুলো ফেলে দেয়া হয় সাগরে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেনে চা ছিল রাজভক্তির প্রকাশ। অন্যদিকে আমেরিকায় ছিল দেশদ্রোহীর পানীয়। অবশ্য চায়ে উচ্চশুল্ক আরোপের নেপথ্য কারণ ছিল পুঁজির আন্তর্জাতিক লড়াই। ফরাসী ও ইংরেজ উপনিবেশগুলো ধরে রাখাই ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। ১৬০৬ সালে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা প্রথম যখন চা নিয়ে যায় তখন এর বিশ্বায়নের রূপ তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পরে এক শতাব্দীর মধ্যেই চা হয়ে ওঠে একমাত্র ও অদ্বিতীয় বৈশ্বিক পানীয়। অনিবার্য প্রশ্ন উঠতে পারে, লড়াইটা কী এতদিনে শেষ হয়েছে? একশব্দে এর উত্তর, না। বরাক উপত্যকা, শ্রীলঙ্কার কান্ডি, বাংলাদেশের সিলেট-চট্টগ্রামের চাবাগানগুলোর ইতিহাস ক্রমাগত শোষণ ও বঞ্চনার, অবহেলা ও হাহাকারের। লাখ লাখ মানুষ, মূলত শ্রমিক অথবা কুলি দাসত্বের শিকলে বাঁধা ভিন দেশের বাগানগুলোতে। নিরাত্মীয়, নিঙ্করুণ পরিবেশে। ১৯২১ সালে ভারতজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন। এই ফাঁকে বিদ্রোহে ফেটে পড়লেন চা শ্রমিকরা। উদ্যোগ নেন নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু বরাক উপত্যকা থেকে বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ ও উত্তর প্রদেশে ফিরে যাওয়া আদৌ সহজ ছিল না। কুমিল্লার চাঁদপুর ঘাটে পুলিশ ঠেকিয়ে দেয় চা শ্রমিকদের। মারা যান শত শত আর আহত হাজার হাজার। বাকিদের জোর করে ফেরত পাঠানো হয়। সুলেখক মুলুকরাজ আনন্দ লেখেন বিখ্যাত ও কালজয়ী উপন্যাস ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’। গঠিত হয় একাধিক কমিশনÑ ১৯২১ সালে রয়েল কমিশন, ১৯৩৪ সালে দেশ কমিশন এবং জোন্স মিশন নামে মেডিক্যাল কমিশন। ভারত ভাগের আগে ১৯৪৬ সালে একটি সরকারী তদন্ত কমিশন সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করে, ‘চা বাগানের মজুরদের কোনরকমের স্বাধীনতা নেই। বাগানের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের কাজকর্ম চালানো সম্ভব নয়।’ বাংলাদেশে চা শিল্পে নিয়োজিত মূলধনের মোট পরিমাণ জানা না গেলেও মূলত ব্রিটিশ মূলধনের ওপর ভিত্তি করেই এ দেশে গড়ে ওঠে চা শিল্প। পাকিস্তান আমলের এক হিসাব থেকে জানা যায়, চা শিল্পের মুনাফা বাবদ বছরে প্রাপ্ত ২৮ থেকে ৩২ কোটি টাকা পাঠানো হতো লন্ডনে। চা শিল্পের জায়গা জমিও ছিল ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর। ১৯৮৩ সালের এক হিসাবে জানা যায়, দেশের ১৫৬টি চা বাগানের জমির পরিমাণ ২ লাখ ৮০ হাজার একর। আর শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার। এই দুর্দিনের বাজারেও দৈনিক মজুরি মাত্র ৮৫ টাকা। ভাবা যায়? রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলে এককাপ চায়ের দাম ন্যূনতম দু’শ’ টাকা। আর ফুটপাথে কমবেশি পাঁচ টাকা। সব রকম চার বাজারমূল্যও কম নয়। অথচ চা শ্রমিকদের ভাগ্য যে তিমিরে ছিল আজও সেই তিমিরেই রয়েছে। চা বাগানগুলোয় অমানিশার অন্ধকার ঘোচেনি আজও। ১৯৫৬ সালের ২৬ নবেম্বর তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে চা বাগানের হতভাগ্য শ্রমিকরা তাদের আহাজারি শুনিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য কিছু করার সময় পাননি। বর্তমানে ন্যূনতম ৩০০ টাকা মজুরি, পূর্ণাঙ্গ রেশন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মজুরি, এমবিবিএস ডাক্তার, মহিলা শ্রমিকদের জন্য মহিলা ডাক্তার, মন্দির-মসজিদ সংস্কার, শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি দাবিতে চা শ্রমিকরা সোচ্চার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ, মানবিক, হৃদয়বান ও দূরদর্শী। তিনি একটু সহৃদয় দৃষ্টি দিতে পারেন চা বাগান ও শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের দিকে। সারাদেশ রুদ্র বৈশাখ তথা গ্রীষ্মের প্রচ- দাবদাহে হাহাকার করলেও সিলেটের চাবাগানগুলোতে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টিপাত হচ্ছে, ঝড়ঝঞ্ঝাসহ। প্রকৃতপক্ষে তা হলো অকৃপণ দয়ালু প্রকৃতির দীর্ঘশ্বাস ও অশ্রুমোচন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে চা শ্রমিকদের জীবনমরণ।
×