ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার দিন ও রাত দিন দিন ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ছত্রিশের নিচে নামছে না পারদের তেজ। দিনে কড়া রোদের বিচ্ছুরণ থেকে শরীর বাঁচানোর চেষ্টা করছে রাজধানীবাসী। রোদের দিকে তাকালে গরম যেন আরও বেশি লাগে। যারা ভাবেন রাতে সূর্য থাকে না বলে রাত কিছুটা আরামদায়ক বা অপেক্ষাকৃত কম অসহনীয়- তারা নিশ্চিতভাবেই ধোঁকা খান। রাতের গুমোট গরম আরেক ধরনের যন্ত্রণা নিয়ে আসে। তবে সেক্ষেত্রে একমাত্র সান্ত¡না হলো হঠাৎ হাওয়ার উপস্থিতি। বলতে পারি আউলা বাতাস। গত সপ্তাহে সাত দিন না হলেও বেশ কয়েকটা দিন সন্ধের পর ছিল হাওয়ার মাতলামি। মাঝেমধ্যে তাতে ধুলোর বেসামাল ওড়াউড়ি সান্ত¡নার ভেতর অভিশাপ হয়ে বিরাজ করেছে বটে। শনিবার রাতে গুলশানে এরকম একটা ধুলোর তা-বের ভেতর পড়ে গিয়ে বুঝেছি বৈশাখের হাওয়া মানেই স্বস্তির সুবাতাস নয়। ধুলো থেকে বাঁচতে নাকে রুমাল না হয় গুঁজলেন, কিন্তু চোখ বাঁচাবেন কিভাবে? চশমা-টশমা কোন কাজে আসে না। ধুলোবহনকারী বাতাসকে ফাকি দেয়া কারও সাধ্য নয়। যা হোক, দিনের বেলা পশুপাখির কষ্ট চোখে পড়ে কার অনুসন্ধানী আলোকচিত্রী ছাড়া? হাঁসফাঁস গরমে মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, আশপাশের জীবদের দিকে তাকানোর সময় কোথায় তার? সেদিন হঠাৎ রাস্তায় ঝপাৎ শব্দ কানে এলো। তাকিয়ে দেখি একটি কুকুর রাস্তার পাশের নর্দমায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে গরম সহ্য না করতে পেরে। অগভীর অপ্রশস্ত নর্দমার ময়লা পানিতে কি দেহ পুরোপুরি ডোবে! বেচারা সারমেয়র সে কী করুণ অবস্থা। গ্রামের কুকুরগুলো বরং ভাগ্যবান। পল্লীর অবারিত অঙ্গনে তারা কোথাও না কোথাও জলাশয় খুঁজে নিতে পারে। এই নিষ্ঠুর মহানগরীতে বুঝি নোংরা ড্রেনই ভরসা। ইলেকট্রিকের তারে বসা দু’ঠোঁট ফাঁক করে তৃষ্ণাকাতর পাখিদের কষ্ট কার আর চোখে পড়ে? অবশ্য খবরের কাগজের প্রথম পাতায় গরমে ধ্বস্ত বিপন্ন পশুপাখির ছবি ছাপা হচ্ছে হররোজ। সাহিত্য ও ব্যাংক সাহিত্য করে এদেশে ব্যাংক-ব্যালেন্স হয় না। এ কথা যারা বলেন তারা নিশ্চয়ই সত্যের পুরোটা দেখেন না। বই বিক্রির প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ জানতে চাইলে দেশের বাঘা বাঘা লেখক লজ্জিত হবেন, এটা মিথ্যে নয়। কারণ দুয়েকজন বাদে কোন সৃষ্টিশীল লেখকের পক্ষেই সেই অঙ্ক বলবার মতো নয়। তবে লজ্জিত হওয়ার কথা তো সমাজের শিক্ষিত অংশের। কেননা তারা বই পড়েন না। বই পড়লে বই কিনতেন। তাহলে লেখকরা নিদেনপক্ষে সম্মানজনক অঙ্কে রয়্যালটির টাকা পেতেন। অর্থাৎ ব্যাংক ব্যালেন্স হতো। এখন ঢাকার বেশ ক’টি ব্যাংক এগিয়ে আসছে লেখকদের পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করতে; বলাবাহুল্য তাতে ‘ব্যালান্স’ও থাকছে। উল্লেখ করার মতোই সেটি। একসময় স্বাধীন দেশে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার সাড়া জাগিয়েছিল। কারণ পুরস্কারের অর্থমূল্য। তারা ৫০ হাজার টাকা দিত। সে আমলে (আশির দশকে) এই টাকা উল্লেখ করার মতো ছিল। এখন পাঁচ লাখ টাকা দিলে হয়তো ওটার সমান হবে। যাহোক দেখতে দেখতে বিগত এক দশকে বেশ কটি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার দিতে শুরু করেছে। এই তালিকায় নতুন যুক্ত হলো বোধকরি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। সমাজে ও রাষ্ট্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার চালু থাকলেও এবার সাহিত্য ক্ষেত্রেও পুরস্কার দেয়া হলো। পেলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। প্রসঙ্গত এই ব্যাংকে সম্প্রতি ডিএমডি হিসেবে যোগ দিয়েছেন লেখক জাবেদ আমিন। উপন্যাস লিখেছেন কিছু, কাব্যগ্রন্থও রয়েছে তার। আমরা জানি, জীবন উপন্যাসের চাইতেও অভাবিত ঘটনাবহুল হয়ে উঠতে পারে। আবার জীবনের বাস্তবতার শাঁস থেকেই উপন্যাসের রসদ সংগৃহীত হয়ে থাকে। লেখক জাবেদ আমিন জীবনকে দেখেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। উপন্যাসের উপাদান, উৎস ও গন্তব্য এবং তার মধ্যকার উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা সম্পর্কে যথোচিত জ্ঞান রাখেন। আকস্মিকভাবে মাসের শুরুতে জাবেদ ফোন করলেন। সেলিনা হোসেনের নাম্বার জানতে চাইলেন। অভিপ্রায়ের বিষয়টিও জানালেন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি বেশ জাঁকজমকপূর্ণই হলো। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সঙ্গীত দল এসেছিল। বক্তৃতায় সেলিনা হোসেন আশা প্রকাশ করলেন এই সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি অব্যাহত থাকুক। শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে ‘করুণ কোমলগান্ধার’ ঢাকা দেশের রাজধানী বলেই দেশের কোন প্রান্তে বড় ধরনের অন্যায় সংঘটিত হলে তার বিরাট প্রভাব পড়ে এই মহানগরেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী মৌলবাদীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু ক্ষোভ ও প্রতিবাদেই ফেটে পড়েনি তরুণ প্রজন্ম, তাদের উদ্যোগে শাহবাগে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিবাদী সমাবেশ, চলছে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ভেতর দিয়ে প্রতিবাদ জানানো। ঢাকা যে এখনও তার প্রতিবাদী সত্তা সমুন্নত রেখেছে, এসব তারই উজ্জ্বল উদাহরণ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এভাবে : ‘রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আজ সকালে চাপাতির আঘাতে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। আরকে স্যার অভিজিৎ-নিলয়-রাজীব-দীপন-বাবু এদের মতো ‘অপরাধী’ ছিলেন না। তার কোন ব্লগ বা ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ছিল না। অল্প কিছু কবিতা, ছোটগল্প আর চলচ্চিত্র রিভিউ লিখেছেন। বিশেষ কোন পত্রিকাতে সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। তার কোন লেখা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক না। সামাজিক বক্তব্যধর্মী লেখা লিখতেন। আর সিটিজেন কেইন, বাইসাইকেল থিফ, পথেরপাঁচালি-চোখের বালি-মেঘে ঢাকা তারা, অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, সিনডার লিস্ট- এসব ক্লাসিক ছবি নিয়ে লিখেছেন। তাহলে এভাবে নির্মমভাবে খুন করা হলো কেন? অন্তত আমার কোন উত্তর জানা নেই। রেজাউল করিম স্যারের মোটাদাগে দুটি সমস্যা ছিল। আমাদের সমাজে ‘চিহ্নিত’ সমস্যা। এক. তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করতেন না। ডিপার্টমেন্টে অনেক সময় ‘উপরি’ টাকা ভাগ হলে তিনি তার অংশ নেবেন না বলে জানিয়ে দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল স্যার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে অনেক টাকা কামান। ইংরেজীর শিক্ষকদের কদর এমনিতেই বেশি। রেজাউল করিম স্যার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একবার কথা বললেন। তারা যখন বলল, ছাত্ররা যাই লিখুক মার্কস দিতে হবে; তিনি আর রাজি হলেন না। স্যার এভাবে টাকা পয়সার কাছে বিক্রি হননি। এ কারণে অল্প আয় করতেন বলে পরিবারে খুব চাপের ভেতর থাকতেন। আমি সততার প্রশ্নে এমন একগুঁয়ে-জেদি-স্পষ্টবাদী মানুষ কম দেখেছি। দুই. তিনি খুব সংস্কৃতিমনা ছিলেন। আমাদের ইংরেজী বিভাগে এটা ছিল একেবারেই বেমানান। রাবির ইংরেজী বিভাগের স্যাররা যেখানে কর্পোরেট মাইন্ডেড, উনি সেখানে বছরে একটা লিটলম্যাগ প্রকাশ করতেন। নাম দিলেন কোমলগান্ধার। ঋত্বিক ঘটকের ছবির নামে। ঋত্বিক ঘটকের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন তিনি। সেই ম্যাগে তরুণদের লেখা ছাপা হতো। আমি একবার পরিচিত এক লেখকের লেখা সংগ্রহ করে দিলাম। উনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘এখানে নতুনরাই লিখুক। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পত্রিকা করি। কারও তো কাজে লাগতে হবে?’ কোমলগান্ধার থেকে ইংরেজী বিভাগে নানা সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বিভাগের গানবাজনা-নাচ পারা ছেলেমেয়েরা স্যারের অনুষ্ঠানে অংশ নিত। স্যার ভীষণভাবে চলচ্চিত্রপ্রেমী ছিলেন। ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র নিয়ে লিখতেনও। একবার বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ছবি দেখানোর প্রকল্প হাতে নিলেন। অফিস থেকে প্রজেক্টর কেনার অর্থ না পেয়ে নিজের টাকায় প্রজেক্টর কিনলেন। বিকেলে দু’চারজন ছাত্রছাত্রীকে জোর করে বসিয়ে প্রিয় সিনেমাটা দেখাতেন। তখন তার চোখে-মুখে কি যে তৃপ্তি লেগে থাকত, তা বলে বোঝানো যাবে না! পরে গ্রামের বাড়ি বাগমারায় শিশুদের জন্য একটি গানবাজনার স্কুল করেছিলেন বলে শুনেছি। গ্রামে গিয়ে ঘুড়ি উৎসব, ঘোড়দৌড়সহ বিভিন্ন খেলার আয়োজন করতেন। বিজয়ীদের পুরস্কারও দিতেন নিজের টাকায়। এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভিডিও করে রাখবেন বলে নিজের টাকা খরচ করে দামী ক্যামেরাও কিনেছিলেন। অনুষ্ঠান চলত আর তিনি ভিডিও করতেন। সখ ছিল সেতারের। কলকাতা থেকে হাজার পঞ্চাশেক টাকা খরচ করে ভালমানের সেতার আনালেন। বেশ কষ্ট করে রপ্ত করেছিলেন। সুযোগ পেলেই বাজাতেন। ভালবাসতেন খেলাধুলাও। ইংরেজী বিভাগের সবধরনের খেলাধুলায় তার মাঠে থাকা চাই। আমাদের বিভাগ ঐতিহাসিকভাবে খারাপ খেলত। তিনি জানতেন হেরে যাবে তবুও ছেলেদের সাহস যোগাতে মাঠে যেতেন। বিরক্ত হয়ে গালিগালাজ করতেন, কিন্তু উঠে পড়তেন না। শেষটা জেনেও মাঠে বসে থাকতেন। তার এসব আচরণের কারণে আমরা তাকে আড়ালে ‘ম্যাড’ বলে ডাকতাম।...’ ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের ধৃষ্টতা এই ধৃষ্টতার তথ্যটি প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ফেসবুকে। শেখ ইরফান তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করলেন একটি ছবি যাতে রয়েছে ওই স্কুলে বাংলা ভাষায় কথা বলার ব্যাপারে সতর্কতা। আদেশ অমান্য করা হলে শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ঘোষণা। এই দেশের নাম বাংলাদেশ, এই দেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যই ’৫২ তে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে নিজের জীবন বিসর্জন দেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ এই বাংলা ভাষা ব্যবহারের উপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো এই বাংলাদেশেরই একটি বিদ্যালয়ে! (ছবিতে দেখুন সেই নোটিশটি) নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ছবিটি আপলোড দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘গুলশানস্থ একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ক্যাম্পাসে ঝুলছে এমন নোটিশ : মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে শোনা গেলে পত্রপাঠ বহিষ্কার!! শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, অবিলম্বে এই স্কুলকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক।’ ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল’ ঢাকা শহরের একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল যা ১৯৮৩ সাল থেকে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ৩২ বছর ধরে শিক্ষা দিয়ে যাওয়া এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত অনেককেই চমকে দিয়েছে, সবচাইতে অবাক করা যে বিষয় তা হলো এই ছবিতে নোটিশের নিচে যার নাম দেয়া, তিনি আর কেউ নন বরং এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ! ২৫ এপ্রিল ২০১৬ [email protected]
×