ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাসযোগ্য রাজধানী

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

বাসযোগ্য রাজধানী

চারশ’ বছর আগেও সেই মুঘল যুগে ঢাকা ছিল বাংলার রাজধানী। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে তখন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল রাজধানী শহরটি। লোকসংখ্যার আধিক্য ছিল না। তারপর এক সময় রাজধানী স্থানান্তরিত হল মুর্শিদাবাদে, ঢাকা হয়ে পড়ে অনেকটাই ম্লান। ইংরেজ শাসনামলে ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল গোড়াতে কলকাতা। এক সময় রাজধানী চলে যায় দিল্লীতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানীতে উন্নীত হয়। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকা একুশ শতকে এসে অনেকটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছেÑ এমন খেদোক্তি প্রায়শই শোনা যায়। বিশ্বে বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান নগরবাসীর জন্য পীড়াদায়ক বৈকি। কিন্তু বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। ঢাকাকে বলা হয় বস্তির শহর, কংক্রিটের নগর, যানজট, জনজট স্বাভাবিক তার জীবনজুড়ে, কোলাহলে পূর্ণ তথা শব্দদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বায়ুদূষণ পরিবেশদূষণ, বর্জ্যদূষণ মিলিয়ে এক নারকীয় অবস্থা বৈকি। বসবাসের অযোগ্য হিসেবে বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারির তালিকায় থাকা ঢাকা নাগরিক সুযোগ সুবিধাগুলোর বিধান না রেখেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তার নগরায়ন হচ্ছে জঞ্জালপূর্ণতায়। তিলোত্তমা নগরীর স্বপ্ন তবু এরই মাঝে দেখানো হয়, শেখানো হয়। কিন্তু আদতে দুঃস্বপ্নের ভারে ডাস্টবিনের গন্ধে ভরপুর থাকে নগরী। ঢাকা এখন শিল্প-বাণিজ্য, প্রশাসনিক ও শিক্ষার শহর হিসেবেও খ্যাত। কিন্তু নগরীর পুরনো অংশ তার ঐহিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। ঘিঞ্জি অবস্থা আর অধিক জনসংখ্যার চাপে পুরান ঢাকা আধুনিকতার স্পর্শে রঞ্জিত হয়ে উঠতে পারছে না। প্রায় এলাকাজুড়ে ছোট ছোট শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় একটা দূষিত পরিবেশ বিরাজ করছে। রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস যেমন ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, তেমনি অগ্নিকা-ের ঘটনাও কম নয়। এসব কলকারখানার শব্দদূষণ সহ্যাতীত হলেও অধিবাসীরা তা মেনে নিয়েছে বলা যায়। স্বাধীনতাপূর্ব ঢাকা শহরে বসবাস করত কয়েক লাখ লোক। তাদের চাহিদানুপাতে পানি, বিদ্যুতের সরবরাহ করা সম্ভব হতো না। একুশ শতকে এসে লোকসংখ্যা দু’কোটি ছাড়িয়ে গেছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দূরে থাক, স্বাভাবিক চাহিদাটুকু মেটানোও সম্ভব হয় না, এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য। তাই দেখা যায় আবাসিক এলাকাগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চলে পরিণত হতে। রাস্তাঘাটে মানুষ আর মানুষ। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে হরেক কিসিমের যানবাহন। দৃষ্টিসীমা যতদূর যায়, দেখা যায়। সবখানেই হাট-বাজার এমনকি ফুটপাথ ও প্রধান সড়কজুড়ে দোকানপাট আর প্রায় এলাকায় বিপণিবিতানে সয়লাব। আবাসিক ভবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কারখানা পর্যন্ত চলছে। পোশাকশিল্প, খুচরা যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানার সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। বাসাবাড়িতে বিষাক্ত রাসায়নিক গুদাম, চামড়ার কারখানা, বর্জ্যরে ডিপো, গুদামঘর। যেখানে সেখানে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন, যেখানে নেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ রাজধানী ঢাকার সঙ্কট নানাদিকে পূর্ণ, সড়ক দখল করে ভবন নির্মাণ হয় যে শহরে, ফুটপাথগুলো পথচারীদের চলাচলের অযোগ্য, খানাখন্দপূর্ণ সড়ক আর ধুলোবালির সম্প্রসারণ স্বাভাবিক বিষয়। ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর মতো অবস্থা বুঝি আজ সুদূরপরাহত। বাসযোগ্য যদি না হয় রাজধানী তবে তো বিপদ বাড়ে। রাজধানীকে রাজধানীর মর্যাদা দিতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সব ধরনের শিল্পকারখানা পর্যায়ক্রমে সরিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নেয়া। বিশেষ করে চামড়া ও চামড়া প্রক্রিয়াজাত শিল্প, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা নির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত বা অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। এছাড়া রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের খালবিল ও নিম্নভূমি জলাধার সংরক্ষণের লক্ষ্যে জরুরীভিত্তিতে পরিকল্পিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক। এসব স্থানান্তর হলে শহরে জনসংখ্যার চাপ যেমন কমবে, তেমনি একে কেন্দ্র করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনাসমূহও দূরীভূত হবে। এতে বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার পথে অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। জনগণের জন্য বসবাসোপযোগী হোক ঢাকা- এমন প্রত্যাশা চিরকালের।
×