ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব

দিনের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন সব পাখিই নীড়ে ফিরে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিকূল বিশেষ করে যারা দলবদ্ধ থাকতে পছন্দ তারাও ফিরে যায় যার যার ঘরে। তেমনি মানুষও সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পরে একটি নিরাপদ আশ্রয় স্থলে ফিরে আসে। এই নিরাপদ আশ্রয়স্থলের নাম হলো সংসার বা পরিবার। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দুনিয়াতে যত নিয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো ঘর- সংসার। মানব জীবনের মূল গ্রথিত থাকে এই সংসারে। সংসারে ভালবাসার জন্ম হয়, ভালবাসার পরিচর্যা হয়। সংসারে মানুষ নিরাপত্তা লাভ করে, স্বাধীনতা ভোগ করে। এই সংসারের ছায়াতলেই মানুষ পবিত্রতা, মহৎজীবন ও শালীনতা লাভ করে। সংসারে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা বড় হয়। আত্মীয়তার সম্পর্ক বিস্তৃত হয়। ফলে পারস্পরিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সংসারে নারী-পুরুষ একজনের সঙ্গে আরেকজনের আত্মার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। সংসারের প্রতিটি সদস্য একে অপরের ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিষয়ে পবিত্র কোরানে সূরা বাকারায় ১৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘তারা তোমাদের পোশাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোশাকস্বরূপ।’ পোশাক যেমন শরীরকে আগলে রাখে, তেমনি নারী পুরুষ উভয়ই সংসারকে আগলে রাখে সব ধরনের বিপদ-আপদ ও সমস্যা থেকে। এটাই হলো একটি প্রকৃত সুখী পরিবারের চিত্র। কিন্তু সংসার কি সব সময় এই রূপে থাকে? থাকে না। উল্টো চিত্রও দেখা যায়। সংসারে বিভিন্ন কারণে অশান্তি দেখা দিতে পারে। তবে সংসারের প্রধান কর্তা বা কর্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হলে সংসারের সকলের ওপর তার প্রভাব পড়ে। সাধারণত একজোড়া নারী-পুরুষ সংসারের মূল নিয়ন্ত্রক হয়। তা সে বাবা-মা বা স্বামী-স্ত্রী যে নামেই পরিচিত হোক। ঝগড়া-মনোমালিন্য দাম্পত্য জীবনের খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। আলাদা চিন্তার আলাদা দর্শনের আলাদা পরিবেশের দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকতে গেলে খুঁটিনাটি বিষয়ে মতভিন্নতা আসতেই পারে। যা দিনে দিনে চরম আকারও ধারণ করতে পারে। এ ছাড়া সন্দেহ, অবিশ্বাস, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, চারিত্রিক বিপর্যয়, মাদকাসক্তি ইত্যাদি নানা কারণে সংসারে অশান্তি হতে পারে। কিন্তু সংসারে ভাল থাকার সকল উপকরণ থাকা সত্ত্বেও সংসারে অশান্তি হয়। এই অশান্তির মূলে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব। সাধারণত চাকরিজীবী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি শিক্ষিত পরিবারে এ ধরনের অশান্তি বেশি হয়ে থাকে। স্ত্রী যদি স্বামীর চেয়ে মানে জ্ঞানে প্রভাবে বা পদবিতে বড় হয় বা সমমানের হয় তখনই শুরু হয় এই সমস্যা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীটি হীনম্মন্যতায় ভোগে। সামাজিক বা অফিসিয়াল কোন অনুষ্ঠানে স্ত্রী সঙ্গে থাকলে সে নিজেই নিজেকে ছোট মনে করে। সবাই স্ত্রীকে সমীহ বা গুরুত্ব দেয়ায় প্রায়ই সে ভেতরে ভেতরে ঈর্ষান্বিত হয়। তার এই মানসিকতা তার আচার-আচরণে বহির্প্রকাশ ঘটে। কারও কারও ক্ষেত্রে এই বহির্প্রকাশ প্রকট আবার কেউবা নিজেই ¯œায়ুচাপে ভোগে। না পারে কইতে, না পারে সইতে। দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবেগের আদান-প্রদান কমে যাওয়ায় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ছোটখাটো বিষয়েই শুরু হয় সংসারের অশান্তি। যার প্রভাব পড়ে সংসারের অন্য সদস্যদের মধ্যে। এই ধরনের সংসারে পারিবারিক কোন বিষয়ে স্ত্রীর পরামর্শ স্বামী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ভাবে, অনাকাক্সিক্ষত মনে করে। কথায় কথায় বলে অফিসের বসগিরি বাসায় দেখাবে না। মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষের মতো থাকবে। মেয়ে মানুষের মতো থাকা মানে স্বামী যা বলবে ভাল হোক মন্দ হোক তা মেনে নেয়া। এর উল্টোটাও হয়। স্ত্রী কর্মস্থলে অধীনস্থদের ওপর প্রভাব খাটানোর ফলে সংসারের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী থাকে। ধরে নেয় সংসারে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তার হাবভাবে সব সময় থাকে কর্তৃত্ব। এমনিতে নারীদের সংসারে কর্তৃত্ব ফলানোর প্রবণতা থাকে। কথায় বলে, রাজা করে রাজ্য শাসন, আর রানী করে রাজা শাসন। আর সেই রানী যদি হয় রাজার চেয়ে প্রভাবশালী তা হলে তো কথাই নেই। তবে সংসারে এই অশান্তির জন্য সমাজবিজ্ঞানীগণ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকেই দায়ী করেন। পুরুষরা যতই নারী স্বাধীনতার কথা, সমধিকারের কথা বলুক না কেন পুরুষের ভেতরে যে পুরুষ সত্তা আছে সে কিন্তু নারীকে ছোট বা অনুগত দেখতেই পছন্দ করে। কেউ কেউ বলে থাকেন প্রাকৃতিক, শারীরিক, ধর্মীয় সকল ভাবেই নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শৈশব-কৈশরে বাবার অধীনে, বাবা মারা গেলে বড় ভাইয়ের অধীনে, বিয়ের পর স্বামীর অধীনে এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলের অধীনে এভাবেই নারীর জীবনচক্র দেখতে অভ্যস্ত সমাজ। তাই তো স্বামীর চেয়ে স্ত্রী পদবিতে-সম্মানে বড় হলে স্বামীর তা মেনে নিতে কষ্ট হয়। এটা অনেকটা অবচেতন মনেই ঘটে। এ ধরনের অনেক পুরুষকে নারীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলতে শোনা যায়, ‘জামার চেয়ে গেঞ্জি বড় হলে বেমানান লাগে। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি মোটা হলে তা কেটে সাইজ করতে হয়। ভাষায় প্রকাশ না করার মতো বা লেখার অযোগ্য এ ধরনের অপ্রকাশিত অনেক কিছু নারীকে শুনতে হয়। এমনও দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জন এক সঙ্গে পড়াশোনা করে একই পদে চাকরিতে যোগদান করেছে। কিন্তু কোন কারণে স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর পদোন্নতি আগে হলো। সেক্ষেত্রে স্বামী পদোন্নতি না পাওয়ার যন্ত্রণায় এমনভাবে ক্ষোভ ঝরাবে যেন স্ত্রী বেচারিরই সব দোষ। পদোন্নতি পাওয়ার আনন্দ কোথায় তার? অথচ স্ত্রীর পদোন্নতি না হয়ে যদি স্বামীর হতো, স্ত্রী কিন্তু সকল কষ্ট বুকে চেপে রেখে স্বামীর আনন্দে মেতে উঠত। একজন স্ত্রীর মানসিক যন্ত্রণার খবর কে রাখে, যেখানে পারিবারিক নির্যাতনকে স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয় মনে করা হয়। যা হোক ধরে নেয়া যাক এক হাতে তালি বাজে না। যে বিষয়টি নিয়ে সংসারে এত অশান্তি, ভেবে দেখুন একটু উদার হলেই তা কত গৌরবের হয়। আপনি এক সময় পদস্থ বাবার জন্য গর্বিত ছিলেন। এখন আপনাকে নিয়ে গর্ব করেন। তা হলে পদস্থ স্ত্রীকে নিয়ে গর্ব করতে এত কুণ্ঠা কেন? আপনার কথা না হয় বাদ দিন, সন্তানদের কথা ভাবুন। তারা পদস্থ বাবা-মা দুজনকে নিয়ে কত গর্ববোধ করতে পারে। স্ত্রীর উপার্জন কি আপনার সংসারে কোন কাজে আসছে না? বিয়ের সময় কবুল বলে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের যে ওয়াদা করেছিলেন তাতে তো সংসারের ঘানি আপনার একার টানারই কথা। স্ত্রী শিক্ষিত বলেই তো সন্তানেরা আপনার অগোচরেই শিক্ষিত হিসেবে, প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। সংসারের যে দায়িত্ব আপনি একা পালন করতেন সে কাজে একজন উপযুক্ত সহযোগী পেয়েছেন। স্ত্রীকে শুধুই নারী ভাবার দরকার কি? জীবন ও মনের অংশ ভাবুন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘নারীরা পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী।’ (তিরমিযি, আবু দাউদ)। পুরুষ-নারী উভয়েই একে অপরের মুখাপেক্ষী। সুতরাং এতে গৌরব, মর্যাদা কিংবা অপমান, ছোট হওয়া ইত্যাদির কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা একজন নারীকে যে কারণে সৃষ্টি করেছেন অথবা একজন নারীর যে দায়িত্ব তা একজন পুরুষের পক্ষে করা কখনই সম্ভব নয়। তাই নারীকে ছোট ভাবার কোন কারণ নেই। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্রচেষ্টায় একটি সংসার এবং একটি সমাজ সুন্দর হতে পারে। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী গল্পে নায়ক অপু যেমন বলেছিল, হৈমন্তী আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ। আপনিও তেমনি আপনার স্ত্রীকে সম্পদ ভাবুন। ছবি : নাসিফ শুভ’ মডেল : জীবন ও নীহারিকা
×