ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নানা আয়োজনে স্মরণ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির নিহতদের

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

নানা আয়োজনে স্মরণ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির নিহতদের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা, মানববন্ধন, মানব প্রাচীর, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয়েছে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির নিহতদের। রবিবার সকাল থেকেই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিজনরা ভিড় জমায় বিশ্বের ইতিহাসের ভয়াবহতম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত রানা প্লাজার সামনে। তারা সেখানে নির্মিত বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। একই সঙ্গে নিখোঁজ শ্রমিকদের সন্ধান, ক্ষতিপূরণ ও দায়ীদের বিচারের দাবি তুলেন। দুর্ঘটনার তিন বছর পরেও অভিশপ্ত রানা প্লাজার সামনে নিখোঁজ শ্রমিকদের ছবি হাতে প্রিয় স্বজনদের খোঁজে ভিড় করছেন হতভাগ্য অনেকে। যেখানে রানা প্লাজা ছিল তার সামনে স্বজনদের আহাজারি সৃষ্টি করে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। হারিয়ে যাওয়া স্বজনের খোঁজে বুক চাপরিয়ে কেঁদেছেন অনেকেই। এদিন জুরাইন কবরস্থানে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন পোশাক মালিকরা। ভবন ধসের তিন বছর বার্ষিকী উপলক্ষে রবিবার সকাল থেকেই রানা প্লাজার সামনে জড়ো হতে থাকে আহত শ্রমিক, নিহত ও নিখোঁজের স্বজনরা। দিনটিকে ঘিরে নানা কর্মসূচী পালন করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলো। সকালে রানা প্লাজার সামনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি কালোবেজ ধারণ করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সময় নিহত ও আহত শ্রমিকদের স্বজনরা রানা প্লাজার সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে শ্রমিকরা রানা প্লাজার সামনে মালিক সোহেল রানার ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। এ সময় রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। প্রচ- গরমে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ে। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের স্বজনরা বলেন, ভবন ধসের তিন বছর পার হয়ে গেছে। এখনও অনেক নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পায়নি। ফলে, অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিতে না পারায় অনেক আহত শ্রমিক স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা অবিলম্বে ভবন মালিক রানার ফাঁসি দাবি করে বলেন, ভবন ধসের আগের দিন ভবনে ফাটল দেখা দেয়ায় শ্রমিকরা কারখানায় থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও ওই ভবনের মালিক সোহেল রানা শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কারাখানায় জোরপূর্বক প্রবেশ করাতে বাধ্য করেছেন। সেদিন যদি সোহল রানা শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে কারখানায় প্রবেশ না করাত, তা হলে আজ হয়ত এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। তাই, তারা অবিলম্বে সোহেল রানার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি জানান। এদিন ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় নিহতদের স্মরণে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর। নিহত, আহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের স্বজনসহ দর্শনার্থীরা ভিড় জমায় প্রদর্শনীতে। প্রিয় স্বজনের ছবি ও স্মৃতি তুলে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে অনেক স্বজন। বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি বিজিএমএই’র ॥ রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হওয়া তিনটি মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছেন তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। রবিবার রানা প্লাজা ধসের তৃতীয় বার্ষিকীতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিন বছর পার হয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কারও কাম্য নয়। আমরাও বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানাচ্ছি। এদিন জুরাইন কবরস্থানে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর মামলার নিষ্পত্তি ও ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন বিজিএমইএ সভাপতি। হতাহত শ্রমিক পরিবারগুলোকে ‘ঠিকভাবে’ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে দাবি করে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এখনও কেউ ক্ষতিপূরণ চাইলে তা মেটানোর ব্যবস্থা করা হবে। ক্ষতিপূরণ ঠিকভাবে দেয়া হয়েছে; যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেভাবেই দেয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ পায়নি এমন অভিযোগ নিয়ে আর কেউ বিজিএমইএর কাছে আসেনি। দোষীদের বিচারের দাবিতে মোমবাতি প্রজ্বলন ॥ সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে নিহত ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক হত্যাকারীদের শাস্তি ও বিচারের দাবিতে বাবা-মা হারানো এতিম শিশুরাও রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ দোষীদের বিচারের দাবিতে মোমবাতি প্রজ্বলন করে। সাভার ট্র্যাজেডি স্মরণে রবিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, মানব প্রাচীর ও সমাবেশের আয়োজন করে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতি। মা সাবিনা হত্যার বিচার চেয়ে গাইবান্ধার শিশু কোরবান, বাবা বাবলু মিয়া হত্যার বিচার চেয়ে কুমিল্লার শিশু মিথিলা ও মা পারভিনা খাতুন হত্যার বিচারের দাবি চেয়ে সাভারের শিশু পারভেজ মোমবাতি হাতে নিয়ে স্মরণ বন্ধনে অংশ নেয়। ‘আমার বাবা-মায়ের মতো কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু-আর নয়’ লিখিত প্ল্যাকার্ড বুকে নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেয় মাকে হারানো শিশু পারভেজ। শ্রমিক হত্যার বিচার ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সহায়তা চেয়ে মানববন্ধনে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- রানা প্লাজার শ্রমিক হত্যার জন্য সকলের বিচার ও শাস্তি, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, রানা প্লাজার মতো আর কোন ঘটনা যাতে না ঘটে সে লক্ষ্যে বিজিএমইএ, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, সরকারসহ সকলকে একযোগে কাজ করা। এছাড়া রয়েছে- মরদেহ, দরিদ্র, শ্রম দাসত্ব আর নয়, নিরাপদ কর্মস্থল, জীবন যাপন উপযোগী মজুরি ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করা এবং ব্যবসার মুনাফায় গুরুত্বসহ শ্রমিকদের জীবনকে গুরুত্ব দেয়া। এসব কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন, যুব মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক সাব্বাহ আলী খান কলিন্স, একতা গার্মেন্টেসের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান প্রমুখ। নিহতদের স্মরণে ফায়ার সার্ভিসের শ্রদ্ধা ॥ রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পূর্তিতে নিহতদের স্মরণে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ ফায়ার সাভিস ও সিভিল ডিফেন্স। রবিবার সাভারের রানা প্লাজার সামনে নির্মিত স্থায়ী শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাংলাদেশ ফায়ার সাভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, দিনটি আমাদের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। রানা প্লাজা ধসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভুক্তভোগীদের পাশে ছিল। শ্রদ্ধা নিবেদনকালে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফায়ার সাভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মামুন মাহমুদ, ইনস্পেক্টর সাইদুল ইসলামসহ ফায়ারম্যান ও অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ সময় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার প্রটোকল অফিসার, উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবক হাবিবুল ইসলাম সুমনের নেতৃত্বে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী ফুল দিয়ে নিহত শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ, জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এদিন জুরাইনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ওই ভবনের মালিকসহ গার্মেন্টস মালিকদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন। একই সঙ্গে দিনটিকে শোক দিবস এবং কারখানাগুলোতে ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। রবিবার রাজধানীর প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক মানববন্ধনে সংগঠনটির নেতারা এ দাবি জানান। আজও শেষ হয়নি শেরপুরের নিহত ৯ শ্রমিকের স্বজনদের বিলাপ ॥ সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৩ বছর পূর্তির পরও শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নিহত ৯ শ্রমিকের স্বজনদের বিলাপ আজও থামেনি। সাভারে রানা প্লাজা ধসে শুধু আব্দুল মুন্না নন, নালিতাবাড়ী উপজেলার অনেকেই হারিয়েছেন মা, বাবা ও সন্তান। রবিবার বিকেলে সরেজমিনে নালিতাবাড়ী পৌর শহরের চকপাড়া মহল্লায় গিয়ে রানা প্লাজা ধসে নিহতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেকেই প্রিয়জনের মুখটাও দেখতে পারেননি। স্বজন হারানোর বেদনার পাশাপাশি তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ওই ঘটনায় এলাকার এমনই এক স্বজন হারা বাবা আব্দুল মুন্না। তিনি হারিয়েছেন ছেলে, মেয়ে ও ছেলের বউকে। তিনি জানান, ভয়াবহ ওই ভবন ধসের ঘটনায় তিনি তার মেয়ের লাশটা পর্যন্ত পাননি। এখন তার পরিবার জুড়ে শুধু হাহাকার। আব্দুল মুন্না জানান, সংসারে একটু স্বচ্ছলতার আশায় ২ ছেলে ৩ মেয়ে ও ছেলে বউকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাভারে। সেখানে তিনি কুলিগিরি করতেন। আর ছেলে সেলিম রানা, ছেলের বউ রহিমা ও মেয়ে মনিরা কাজ করত রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় নিউ বটম গার্মেন্টেসে সুইং অপারেটর ও হেলপার হিসেবে। তিনি আরও জানান, ধসের ঘটনার ৩ দিন পর অধর চন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে ছেলের বউ রহিমা ও এর দু’দিন পর ছেলে সেলিম রানার লাশ পেলাম। মেয়ে মুনিরার লাশ তো পেলামই না। ১০ মাসের নাতি রনিকে নিয়ে চলে এলাম নালিতাবাড়ীর নিজের ঠিকানায়। মাত্র ৮ মাসের মাথায় বাবা-মার স্নেহ বঞ্চিত নাতিটিও একদিনের ডায়রিয়ায় মারা গেল। ছেলে শাহীনুরকে দিয়েছিলাম স্থানীয় একটা লেদ মেশিন কারখানায় কাজ করতে। সেখানে দুর্ঘটনায় তার ডান হাতের কবজি হারিয়ে বাড়িতে বসে আছে। এখন মেয়ে শুক্কুরি, মাঞ্জুরা আর তার স্ত্রীকে নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার। বিভিন্ন সংস্থা থেকে দেয়া ছেলে-মেয়ে ও নাতির জন্য দেয়া ৪ লাখ টাকায় জমি এগ্রিমেন্ট নিয়ে চাষাবাদ করে কোন মতে চলছেন। একই মহল্লার আঃ রফিক ও আনোয়ার বেগম কন্যা রোকসানা আক্তার রনি ছেলে রাসেলকে নিয়ে অভাবের তাড়নায় সাভারে গিয়েছিলেন। সেখানে রফিক আনোয়ারা রানা প্লাজার পাশে হোটেল চালাতেন আর মেয়ে রোকসানা রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় কাজ করতেন। একই সঙ্গে কাজ করতেন রোকসানার স্বামী ইমরান হোসেন। ঘটনার ৩ দিন পর মেয়ে ও ৫ দিন পর মেয়ের লাশ পান তারা। এখন তাদের রেখে যাওয়া সন্তান রনিকে নিয়ে তারা চকপাড়া মহল্লায় কোনমতে বেঁচে আছেন। তাদের জীর্ণ টিনের ঘরটিতে ঢুকতেই নজরে পড়ল রোকসানা ইমরানের ছবি। নিহত বাবা মায়ের ছবি আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছিল তাদের আদরের সন্তান সাড়ে ৫ বছরের সিয়াম। এখন ওই ছবিটাই তার সম্বল। আর ওই এলাকার হারেজ আলী জানান, রানা প্লাজা ধসে তার বড় ছেলে আব্দুল হালিম ছন্দা নামে ৩ বছরের এক কন্যা রেখে মারা গেছে। সেই ছিল তার ৫ সদস্যের পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছেলের মৃত্যুর পর বিভিন্ন জায়গা থেকে যেটুকু আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল, তার সিংহভাগ নিয়ে ছেলের বউ হেলেনা নাতিকে ফেলে রেখে অন্য স্বামীর ঘরে চলে গেছে। ফলে এক দুর্বিষহ জীবন কাটছে হারেজ আলীর। বাবা হাবিবুর রহমান ও মা রুবি বেগম তাদের দুই সন্তান আবু জাফর সেন্টু ও সেকান্দরকে হারিয়ে এখন পাগল প্রায়। রুবি বেগম জানান, এক ছেলের লাশ পেলেও, আরেক ছেলের লাশ পাইনি। একই মহল্লার মন্নাফ মিয়ার কন্যা মানছুরা আক্তার মুন্নি (১৮) ভবন ধসের এক ঘণ্টা পর উদ্ধার হয়ে সাভার সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে জীবনটা ফিরে পেয়েছেন। তবে এখন বেঁচে আছেন জীবন্মৃত হয়ে। মানছুরা জানান, মাত্র ৩ মাস আগে তিনি কাজ নিয়েছিলেন রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় নিউ ওয়েভ বটমে। ভবন ধসের ঘটনায় নিচে নামতে গিয়ে দোতলার সিঁড়িতে আটকা পড়েন। মাথায় এবং শরীরে প্রচ- আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভার সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১১ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর সে বেঁচে উঠে। তারপর চলে আসে বাড়িতে। ৩ বছর পার হলেও সেই ভয়াবহ ঘটনার আতঙ্ক এখনও কাটেনি। সে জানায়, এক বছর পর আবার একটি গার্মেন্টেসে কাজ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গার্মেন্টেসে ঢুকলেই আমার চোখের সামনে সেদিনের দৃশ্য ভেসে উঠে। এ ছাড়াও মাঝে মাঝেই মাথায় প্রচ- ব্যথা হয়। তাই এখন বাবার বোঝা হয়ে আছি। আহত হওয়ার পর ৪ বারে বিকাশের মাধ্যমে ৯৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। সে টাকা আমার ওষুধ কিনতেই শেষ হয়ে গেছে। শ্রমিক অধিকারে প্রাধান্য দেয়ার আহ্বান ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ॥ পোশাক খাতে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছে তারা। রবিবার ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন দূতাবাস থেকে পৃথক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রমিক ইউনিয়ন বিরোধী বৈষম্যের সকল কর্মকা-ে অবিলম্বে তদন্ত ও বিচারেরও দাবি জানিয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার তৃতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে ইউরোপীয় কমিশনের এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন স্বচ্ছ হতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ মানদ-ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দ্রুত নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে হবে অন্যায় শ্রম চর্চা। বাংলাদেশ সরকার দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় রেখেছে। কিন্তু শ্রম পর্যবেক্ষণসহ অনেক কাজ এখনও বাকি। সকল কারখানায় মেরামত ও প্রতিকারমূলক পরিকল্পনাগুলো এখনও কার্যকর বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এ লক্ষ্যে ইইউ ও অন্য দাতারা তহবিল গঠন করেছে, যেখান থেকে আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা নিতে পারবে। ইইউ, বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট অন্য অংশীদারদের সক্রিয় অংশগ্রহণেরর মধ্য দিয়ে মাঠপর্যায়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশে এখন অনেক জায়গায় শ্রমিক অধিকার দু’বছর আগের তুলনায় অধিক সুরক্ষিত। ভবন ও কর্মপরিবেশ নিরাপত্তারও উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ সাস্টেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট ইইউ ও বাংলাদেশের ট্রেড ইউনয়ন, চাকরিদাতা, বায়ার ও এনজিওসহ অন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সংলাপের সুযোগ করে দিয়েছে। তারপরও পোশাক খাতে শ্রমিকদের উন্নত ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান এবং সত্যিকারের সামাজিক সংলাপের প্রচারণায় কার্যকর সংস্কার এখনও প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের নিবিড় পারস্পরিক সহযোগিতাই হলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সব থেকে কার্যকর উপায়। অগ্রগতির পথে তাদের সংকল্প বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল এবং থাকবে। বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য মানসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রত্যেককে একত্রে কাজ করা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের যৌথ কাজ দীর্ঘমেয়াদে চালিয়ে যেতে হবে। এদিকে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার তৃতীয় বার্ষিকীতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট এক বিবৃতিতে বলেছেন, গত তিন বছর ধরে ৩৬শ’রও বেশি কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন করা হয়েছে। ৩৯টি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২শ’রও বেশি পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। হাজারও কারখানা তাদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ৩১টি কারখানা সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এই সকল কিছুই চমৎকার অর্জন যা জীবন রক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, আমরা আরও বিশ্বাস করি, শ্রমিকদের জোরালো ও শক্তিশালী মতামত প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে তারা বলতে পারবে, ‘আমরা এমন ফেটে যাওয়া দেয়ালযুক্ত ভবনে কাজ করব না’। তাদের সেই মতামত যেন শোনা হয় ও সম্মান করা হয়। বাংলাদেশ সরকারও ইতোমধ্যে শত শত নতুন ইউনিয়নের নিবন্ধন দিয়েছে।
×