ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ওআইসি সম্মেলন শূন্যতায় শোকসভা

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

ওআইসি সম্মেলন শূন্যতায় শোকসভা

‘মুসলিম উম্মাহ’ শব্দটা বেশ শ্রুতিমধুর। কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র মনে হবে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনমান সুরক্ষায় একটি বৃহত্তর ঐক্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র বিপরীত। ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার, শান্তি ও সাম্যের জন্য ইসলামী মূল্যবোধ অনুসরণ করার কথা যাদের, তারাই এর বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে কোথাও কোথাও। ‘শান্তির ললিত বাণী’ পরিণত হয়েছে ব্যর্থ পরিহাসে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা, শত্রুতা, হানাহানি, সংঘর্ষ, যুদ্ধ, বিবাদ-বিসংবাদ জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহ বৃহত্তর ঐক্যকে নিষ্পেষিত শুধু নয়, তাই প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর স্থিতিশীলতাও বিপন্ন প্রায় আজ। সেই সঙ্গে কোটি কোটি মুসলমানের জীবন ও সম্পদ আজ বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত এবং বিপন্ন প্রায়। পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি হয়ে গেছে সুদূর পরাহত। মানবতার দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কারও ছায়াটুকুও মাড়িয়ে যেতে চায় না। নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় আজ মধ্যপ্রাচ্য ল-ভ-। অবিশ্বাস, সন্দেহ আর প্রবলবিরোধিতায় আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলো। দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য নিরসন করা দুরূহ প্রায়। বিশ্বজুড়ে যখন ইসলামের লেবাসধারী জঙ্গীদের বিস্তার ঘটেছে, তখন মুসলিম দেশগুলো সম্মিলিতভাবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো মানসিকতায় উপনীত হতে পারছে না। এই দেশগুলোর কোন কোনটি জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটিয়ে আসছে। কোন কোন রাষ্ট্র তো জঙ্গীবাদের প্রশিক্ষক, এরা জঙ্গীবাদ রফতানি করে আসছে অন্যান্য মুসলিম দেশেও। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইসলামী বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণের পথজুড়ে নানা অন্তরায়, প্রতিবন্ধকতা সব সময় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এসব জঙ্গী কার্যক্রমের কারণে বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায় কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমানদের ভিন্ন চোখে দেখা হয়। নিগৃহীত হতে হয় নানাভাবে। অথচ এই জঙ্গীবাদের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানের কোন সম্পর্ক নেই, থাকার কথাও নয়। কারণ ইসলাম ধর্ম জঙ্গী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তি ও সাম্যের ধর্ম হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। ইসলামকে বিশ্বসভ্যতার মুখোমুখি দাঁড় করাতে পশ্চিমা প্ররোচনায় মুসলিম দেশগুলো যে পন্থা অবলম্বন করে আসছে, তাতে সভ্যতাও বিপন্ন প্রায়। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে আজ বিশ্বজুড়ে যে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো হচ্ছে, তার সঙ্গে ইসলামের লেবাসধারী একদল যেভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে, তার সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক না থাকলেও ধর্মকেই আজ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়গুলি। নিজস্ব মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যও সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে। তারা শুধু মুসলিম দেশ নয়, ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রগুলোতেও আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাচ্ছে। আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি এবং নিরীহ মানুষ হত্যা ছাড়া এখান থেকে প্রাপ্য কিছুই নেই জানার পরও মুসলিম জঙ্গীরা থেমে নেই। বরং আরও বেশি জোশে সশস্ত্র হামলা চালু রেখেছে। মুসলিম বিশ্বের সঙ্কটের এই কালে দিন দশেক আগে অনুষ্ঠিত হলো ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা তথা ওআইসির এয়োদশ শীর্ষ সম্মেলন। তুরস্কে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের ফলাফল এক কথায় বলা যায় শূন্য। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে মুসলানদের দুর্দশা, নির্যাতন, বঞ্চনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে সম্মেলনে। ২১৮ দফার ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে। এ সবই যে কাগজেই লিপিবদ্ধ ও সীমাবদ্ধ থাকবে তা বলাই বাহুল্য। যখন ইরাক সিরিয়া, লিবিয়া বিপর্যস্ত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে জঙ্গীদের ব্যাপক অবস্থান ও ঘৃণ্য তৎপরতা চলছে, তখন এই সম্মেলন এসবের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি। শিয়া ও সুন্নি দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠেছে, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে আসছে এবং শিয়া-সুন্নি মতবাদ প্রচার করে মুসলমানের মধ্যকার ঐক্যের মূলে ক্রমাগত আঘাত হানছে। ওআইসি সম্মেলনে আশা করা হয়েছিল মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদ নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো পুনর্গঠন, জঙ্গী ও সন্ত্রাসমুক্ত করা, রাজনৈতিক উন্নয়ন, অর্থনীতি, সামাজিক ও মানবিক বিষয়গুলো সামনে আনার কথা থাকলেও সেভাবে আসেনি। ধারণা করা হয়েছিল মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক ও গোত্রগত বিভক্তি দূর করতে একটি অবস্থানে উপনীত হবে। কিন্তু সে পথে কেউ হাঁটেনি। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ইরান ও সৌদি আরবকে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কোন উদ্যোগও দেখা যায়নি। সাম্প্রদায়িক মতভেদের কারণে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় মুসলিম দেশগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে একাট্টা হতে পারেনি। ঘোষিত ইশতেহারে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় ঠাঁই পেলেও এসব দফাসমূহ কার্যকর ও বাস্তবায়নের কোন প্রক্রিয়া বা দিক নির্দেশনার উল্লেখ নেই। জাতিসংঘের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগঠন ওআইসি। গোড়াতে এর নাম ছিল ইসলামী সম্মেলন সংস্থা বা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স বা ওআইসি। পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন বা ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা। এ সময় লোগোও পরিবর্তন করা হয়। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধের পর ইসরাইল জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদুল আকসায় অগ্নিসংযোগ করে। এতে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১৪টি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কায়রোতে বৈঠকে মিলিত হয় এবং সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই আলোকে ১৯৬৯ সালে রাবাতে ২৫টি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বিশ্বের ৫৭টি ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ে সংস্থাটি এখনও সচল। গোড়াতে সংস্থাটি মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করে। জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাটির জাতিসংঘে একটি স্থায়ী প্রতিনিধি দল রয়েছে। ২০১১ সালে সংস্থাটির নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা করা হয়। সৌদি আরবের জেদ্দায় সদর দফতর অবস্থিত। চলতি বছর পর্যন্ত ১৩টি সম্মেলন হয়েছে। সংস্থা বাইরে ৫টি অতিরিক্ত সম্মেলন হয়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই শীর্ষ সম্মেলন হয়ে আসছে। ২০১৩ সালে দ্বাদশ সম্মেলন হয় কায়রোতে। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছেÑ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসলামী সংহতি বৃদ্ধি করা, যা আজও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। সংহতি না বাড়ায় বরং সংঘাত বেড়েছে সদস্য অনেক রাষ্ট্রের মধ্যে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহে সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা সংহত করা এবং আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করার লক্ষ্য অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে। তবে যে পরিমাণ সহযোগিতা প্রাপ্য হওয়ার কথা, তার কিয়দংশই হয়েছে বলা যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়ানোর বিষয়টি যেন হালে পানি পায়নি। লক্ষ্য সঠিক হলেও তার বাস্তবায়নে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সমঝোতার ক্ষেত্রটি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। আরও লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে বর্ণবৈষম্যের মূলচ্ছেদ এবং উপনিবেশবাদ বিলোপের চেষ্টা অব্যাহত রাখা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি প্রয়োজনীয় সমর্থন প্রদান করা, পবিত্র স্থানসমূহের নিরাপত্তা বিধানের সংগ্রামকে সমন্বিত এবং সুসংহত করা, ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য সংগ্রামকে সমর্থন করা ও তাদের অধিকার আদায় এবং স্বদেশ রক্ষা করার কাজে সাহায্য প্রদান, মুসলমানদের মান-মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং জাতীয় অধিকার সংরক্ষণের সকল সংগ্রামে মুসলিম জনগণকে শক্তি যোগানো। এছাড়া সদস্য রাষ্ট্রসমূহ এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং সমঝোতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই সাতটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কোনটিই যথাযথ কার্যকর বা বাস্তবায়নের পথ পায়নি ওআইসি। সদস্যভুক্ত উন্নয়নশীল ইসলামী দেশগুলো বিকল্প বাজার তৈরির সম্ভাবনাকে আজও কাজে লাগাতে পারেনি। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ইতোপূর্বে কয়েক দফা পারস্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সহযোগিতায় বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ বাড়ানো, যোগাযোগ, পর্যটন, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এসব খাতে অগ্রগতি নামমাত্র। ওআইসি দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের হার মাত্র ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। যখন বিশ্বজুড়ে ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল কায়েদা, তালেবান, বোকো হারাম, আল শাবাব, আল নুসরা ফ্রন্টসহ হাজার পাঁচেক জঙ্গী সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জনগণকে বিশ্ববাসীর প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে শুধু নয়, মানুষ হত্যাসহ সম্পদহানি ঘটাচ্ছে অতর্কিত হামলা চালিয়ে, এমনকি আত্মঘাতী হামলাও, তখন ওআইসি সম্মেলনে এসবের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সোচ্চার হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, আইএস দমনের প্রশ্ন আসেনি। স্রেফ আইএসের নৃশংসতার নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। কিন্তু আইএসবিরোধী সম্মিলিত অভিযানের প্রশ্নটি চাপা পড়ে গেছে। বরং মুসলিমদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন দেশে বিদেশীভীতি, সহিংস চরমপন্থা অবলম্বন, বৈষম্য প্রদর্শন, বর্ণবাদী আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আর এসবের সমাধানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানোর মাধ্যমে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে ওআইসি। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ দেশের নেতারা ইরানকে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। সন্ত্রাসের সঙ্গে ইসলামের জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টির কোন ব্যাখ্যাও আসেনি সম্মেলন থেকে। বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দেয়ার ফলে এই ধারণাটা পশ্চিমা বিশ্বে বদ্ধমূল হয়েছে যে, ইসলাম মানে হিংসা, হানাহানি ও রক্তপাত। অথচ আদতে ইসলাম তা নয়। ইসলামের মূল বিষয়গুলোকে সামনে না এনে বিকৃত ভাষ্য প্রদান করে ধর্মকেই অবমাননা করা হচ্ছে। ওআইসি এ বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। বাস্তব যে, ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার নামে আইএস যা করছে, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ তাদের এসব নৃশংস কর্মকা-ের মাসুল দিতে হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত মুসলমানদের। ইসলামোফোবিয়া নামে যে রহস্যময় নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে, তার কুফল কমানোর জন্য ওআইসি কোন ভূমিকাই পালন করছে না। অপরাধ ও ধর্মের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। যারা ঘৃণা উদ্রেককারী আক্রমণাত্মক ঘটনা ঘটাচ্ছে, সেজন্য তারাই দায়ী। কোন ধর্মই হিংসাত্মক কর্মকা-কে সমর্থন করে না। বরং অমানবিক ও এ ধরনের পৈশাচিক এবং হিংসাত্মক ঘটনা কেন সংঘটিত হচ্ছে, সেই প্রশ্নের জবাবও খোঁজা হয়নি সম্মেলনে। নেপথ্যের অপশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবেলার প্রসঙ্গ দূরে থাক, সামান্য নিন্দাও প্রকাশ করা হয়নি। যদিও লেবাননভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নিন্দা করে এদের মদদদানের জন্য ইরানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ইরান এর বিরোধিতা করে বলেছে, এটি ঐক্যের বক্তব্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রশংসিত শিয়া সম্প্রদায়ের হিজবুল্লাহ সিরিয়া থেকে সুন্নী শক্তিকে নির্মূলের জন্য লড়াই করছে। সম্মেলনে প্রথমসারিতে যে পাঁচটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য চেয়ার সংরক্ষণ করা হয়েছিল তাতে ইরানকে রাখা হয়নি। জাতিতাত্ত্বিক সংঘাত যে মুসলিম বিশ্বের কল্যাণ না এনে একটি ধ্বংসচক্র সৃষ্টি করছেÑ সেই উপলব্ধি সৌদি আরব ও ইরানের নেতৃত্বের মধ্যে আসেনি। মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের আহ্বানের মধ্যে এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও এক্ষেত্রে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। ওআইসিভুক্ত কয়েকটি দেশের মধ্যে বিভক্তি তীব্রভাবেই দেখা গেছে। বিশেষত সুন্নীপ্রধান সৌদি ও শিয়াপ্রধান ইরানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কোন সমাধান হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় মুসলিম দেশগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। অথচ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলার জন্য এ দুটো দেশের ঐক্যে পৌঁছানো জরুরী। বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ। জঙ্গীরা শুধু নিরপরাধ মানুষকেই হত্যা করছে না, ইসলামী সভ্যতার অপূরণীয় ক্ষতি করছে তারা। জঙ্গী কার্যক্রমের শীর্ষে রয়েছে আইএস ও আল কায়েদা। এছাড়া জ্বালানি বৈষম্য, পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ও বিদেশীভীতি এবং মুসলমানদের প্রতি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও উল্লেখযোগ্য সমস্যা। আরেকটি বড় সমস্যা গোষ্ঠীতন্ত্র। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য কেউ কেউ শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যকার বিভেদ উস্কে দিচ্ছে। কিছু কিছু গোষ্ঠী জঙ্গীদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে, যারা বিপথগামী যুবক ও হতাশাগ্রস্ত লোকদের দিয়ে মুসলিম বিশ্বে জঙ্গীবাদকে উস্কে দিচ্ছে। জঙ্গীবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে আজ। ঐক্য ছাড়া যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। অথচ ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলো জঙ্গীবাদ গড়ে ওঠার কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী তা মোকাবেলায় কোন রূপরেখা ঘোষণা করেনি। ‘ন্যায়বিচার ও শান্তির জন্য ঐক্য আর সংহতি’ এই প্রতিপাদ্য ছিল সম্মেলনের। কিন্তু সম্মেলনের আলোচনা ও ঘোষণায় এর কোন প্রতিফলন ঘটেনি। সম্মেলনটি এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন ইসলামী বিশ্ব বিবিধ ধারায় বিভক্ত; ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত। আঞ্চলিকতায় বিভক্ত মুসলিম উন্মাহ। কিন্তু এই সম্মেলন সংঘাতে সৃষ্ট ক্ষত উপশম করার পথরেখা দিতে পারেনি। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে সৌদি ও ইরানের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিবারণের কোন উপায়ও উদ্ভাবন করা যায়নি। সম্মেলনে অবশ্য মিসর ও জর্দান অংশ নেয়নি। সিরিয়ার আসাদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সংহতি ও ফিলিস্তিনীদের অধিকার বাস্তবায়ন নিয়ে ওআইসি বেশিদূর এগোতে পারেনি। ইসলামী সমাজে নারীর ভূমিকা জোরদার করার বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে পাঠানো ও পঠিত বিবৃতিতে আন্তঃধর্ম সংলাপের মাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষ ও ভীতি প্রশমনের ওপর গুরুত্বারোপ করে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য নিরূপণে ওআইসির একটি কৌশল বা উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। ফিলিস্তিন ও রোহিঙ্গা সমস্যারও সমাধান চেয়েছেন। ত্রিশটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং ২০টির বেশি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলন মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার হানাহানি ও সংঘাত বন্ধে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলা যাবে না। জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে আদৌ ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে কিনা, সে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মুসলিম উম্মাহ শব্দটি কাগজেই লিপিবদ্ধ থাকছে। বাস্তবে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মা সুদূরপরাহত। ওআইসি সন্মেলন যেন কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়, ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’। শোকের ঘটনা বৈকি!
×