ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিআইডিএস-এর বাংলাদেশ জার্নি সম্মেলন সমাপ্ত

অর্থনৈতিক অগ্রগতি-সুশাসনের মধ্যে বিস্তর ফারাক

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

অর্থনৈতিক অগ্রগতি-সুশাসনের  মধ্যে বিস্তর ফারাক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সুশাসনের মধ্যে বিস্তার ফারাক রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সেজন্য এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়ের তাগিদ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বাংলাদেশ জার্নি শীর্ষক দু’দিনব্যাপী সংলাপ অনুষ্ঠানের শেষ দিনের উ™ে^াধনী অধিবেশনে এ তাগিদ দেয়া হয়। রবিবার ‘গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এতে সভাপতিত্ব করেন। প্যানেল আলোচক ছিলেন বিআইডিএসের ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির ও ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেছেন, মানুষের যদি নিরাপত্তা না থাকে, স্বাধীনতা না থাকে, সবাই যদি সমানভাবে এগোতে না পারে তাহলে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে তা দিয়ে কোন লাভ হবে না। পর্বে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ও অংশগ্রহণ যদি মেলাতে না পারি তাহলে সে উন্নয়নের সুফল কেউ পাবে না। দুর্নীতি শুধু মানুষকে ক্ষতি করছে না, খুনও করছে। রানা প্লাজা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিদিন রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনাসহ জানা-অজানা বিভিন্ন কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে। এর দেখার কেউ নেই। এসব হতেই থাকবে যদি সুশাসন নিশ্চিত না হয়। বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান বিষয়ে সুলতানা কামাল বলেন, মানব সূচকে বাংলাদেশ এগোচ্ছে, কিন্তু লিঙ্গ সমতায় এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। নারীদের সব সময় বলা হচ্ছে তোমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে, আমরা (নারীরা) যদি বাস্তবতা বুঝতে থাকি, তাহলে বাস্তবতার পরিবর্তন কিভাবে করব? বিনায়ক সেন তার মূল প্রবন্ধে বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সুশাসনের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সেবার ক্ষেত্রে সরকারী ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু জবাবদিহিতার কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা এখন সবারই প্রশ্ন। বিআইডিএসের ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, উন্নয়ন, অর্থনীতি, সুশাসন সবই রাজনীতিকরণ হচ্ছে। আপনি কোন্ দিকে বেশি গুরুত্ব দেবেন সেটা আগে ঠিক করতে হবে। ব্যারিস্টার তানিয়া আমির বলেন, আমাদের দারুণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। সেটা নিয়ে অনেক আলোচনাও হচ্ছে। তবে সম্মিলিতভাবে না এগোতে পারলে তার কোন সুফল নেই। বরং এটি সমস্যা। যেমন একটি কোষে ক্যান্সার হলে অন্য ভাল কোষগুলোও মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে। এজন্য বলব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে হবে সমান ও সম্মিলিত এবং টেকসই উপায়ে। সেখানে গণতন্ত্র, সুশাসনের বিকল্প নেই। ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, এক সময় বিশ্বব্যাংক বলত উন্নয়নের জন্য সুশাসন দরকার। কিন্তু আমরা দেখছি সুশাসন ছাড়াও উন্নয়ন হচ্ছে। তবে সুশাসন দরকার সমতার জন্য। আর সত্যিকারের সুশাসন হচ্ছে জনসাধারণের সঙ্গে সরকারের সত্যিকারের যোগাযোগ। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, সুশাসন দুই ধরনের। একটা সম্মতির সুশাসন, অপরটি বল প্রয়োগের সুশাসন। সম্মতির সুশাসনে প্রবৃদ্ধি কম হয়। আমাদের এখন যেটা হচ্ছে সেটা হলো প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে বল প্রয়োগের সুশাসন। ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির বলেন, যারা খুবই নিরীহ তাদের জন্য কেউ নেই। তাদের কাছে উন্নয়নের সুফলও যাচ্ছে না, যা প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষণ নয়। সুজনের সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার, বিআইডিএসের আনোয়ারা বেগম, নাসরিন আকতার প্রমুখ মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। পরবর্তীতে আরও পাঁচটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হলোÑ অতিদারিদ্র্য নিরসন, জমির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা, অবকাঠামো খাতে ঘাটতি অর্থায়ন ইত্যাদি। অতিদারিদ্র্য বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এসএম জুলফিকার আলী। তিনি তার প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও এখনও চ্যালেঞ্জ শেষ হয়ে যায়নি। উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলো হলোÑ এখনও দুই কোটি মানুষ অতিদারিদ্র্য হিসেবে রয়েছে। তাদের জীবনমান অত্যন্ত খারাপ। বিশেষ করে মহিলাদের অবস্থা আরও বেশি খারাপ। মোটামুটি ৬ থেকে ১০ বছরের প্রাইমারী স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকই এখনও স্কুলের বাইরে রয়েছে। এখনও দুই-তৃতীয়াংশ মেয়েশিশুর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এবং দ্রুত ও কম বয়সেই ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবর্তী হচ্ছে। স্যানিটেশনে অগ্রগতি হলেও এখনও ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। মাতৃমৃত্যু এখনও রয়েছে, যা এমডিজির লক্ষ্যপূরণে বাধা ছিল। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা সংক্রান্ত মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের রুশিদান ইসলাম রহমান। তিনি বলেন, কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে শ্রমিকের সমস্যা রয়েছে। শ্রমের মজুরি ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যা কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাধারণত একজন শ্রমিকের ডেইলি মজুরি থাকে ৪৫০ টাকা। কিন্তু শস্য কাটার সময় বা মৌসুমের সময় মজুরি বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। এক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি এবং যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সম্ভব। জমির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মঞ্জুর হোসাইন। তিনি বলেন, জমির ব্যবহার সংক্রান্ত শক্তিশালী আইন তৈরি এবং তার যথাযথ প্রয়োগ জরুরী হয়ে পড়েছে। জমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ডিজিটাল করার বিকল্প নেই।
×