ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের কাছ থেকে ঘুষ নেয় পুলিশ!

প্রকাশিত: ০৩:০১, ২৪ এপ্রিল ২০১৬

পুলিশের কাছ থেকে ঘুষ নেয় পুলিশ!

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ জেলা পুলিশের পিছু ছাড়ছে না ঘুষ কেলেংকারী। এবার ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বরিশাল বিভাগের ৪৬ থানার ওসি কমবেশী ক্ষমতসীন দলের চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীসহ বিভিন্ন প্রার্থীকে নির্বাচনে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার শর্তে আর্থিক (ঘুষ) সুবিধা নিয়েছেন। ওই সুবিধার অর্ধেক এবং জায়গা বিশেষ তিন ভাগের দুইভাগ অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে ডিআইজি হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়; ঘুষ না দেয়ায় কয়েকজন চৌকস ওসিকে তার (ডিআইজি) রোষানলে পড়ে আকস্মিক পুলিশ লাইনে ক্লোজ হতে হয়েছে। এছাড়াও ডিআইজি’র বিরুদ্ধে বিভাগের বিভিন্ন থানায় ওসি, ওসি (তদন্ত), এসআই ও এএসআইদের বদলীসহ নানা অজুহাতে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডিআইজি হুমায়ুন কবির। নাম প্রকাশ না করা শর্তে জেলার এক ওসি জানান, গত ২২ মার্চ ইউপি নির্বাচনে যারা ক্ষমতসীন দলের প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের সোজা সাফটা কথা ছিল দল মনোনয়ন দিয়েছে, এখন নির্বাচিত করার দায়িত্ব আপনাদের। তার দাবি ছিল ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা তেমন একটা টাকা দেয়নি। তারপরেও নির্বাচন উপলক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকা হাতে এসেছে। সেখানে ডিআইজি স্যারকে সকল থানার ওসিকে দিতে হয়েছে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। একাধিক থানার ওসি অকপটে স্বীকার করেছেন, ডিআইজি স্যার নিজে ফোন করে নির্বাচনের টাকার ভাগ নিয়েছেন। এমনকি এক ওসি ডিআইজি’র ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি তার মোবাইল ফোনে রেকর্ডিংও করে রেখেছেন। তবে যারা নির্বাচনের টাকার ভাগ ডিআইজিকে দেননি বা কম দিয়েছেন তাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। চাকরি হারানোর ভয়ে নামপ্রকাশ না করার শর্তে জেলার একটি থানার এক এসআই বলেন, উজিরপুর থানার চৌকস ওসি মো. নুরুল ইসলাম-পিপিএম’র কাছে নির্বাচনের ১০লাখ টাকা দাবি করেছিলেন ডিআইজি স্যার। তিনি তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ ডিআইজি টাকার প্যাকেট ছুড়ে মারেন। সাতটি মনোনয়ন দিয়ে বহু টাকা আয় করার অজুহাতে তার দাবিকৃত ১০লাখ টাকাই দিতে হবে বলে ডিআইজি সাফ জানিয়ে দেন। টাকা না দেয়ায় গত ১ এপ্রিল ওসি নুরুল ইসলামকে প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। অপর এক এসআই জানান, বাকেরগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ডিআইজিকে তিন লাখ টাকা দেয়ার পরেও গত ১১ এপ্রিল তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। তারস্থলে ওইদিনই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নতুন দায়িত্ব পান বামনা থানার ওসি আব্দুল আজিজ। পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বাউফলের ওসি মাসুদুর রহমানকে থানা থেকে পুলিশ লাইনে ক্লোজসহ অর্থের বিনিময়ে গত ১ মাসেরও কম সময়ে ২০পুলিশ কর্মকর্তাকে ডিআইজি রদবদল করেছেন। সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রায় সাত মাস আগে ঢাকা রেঞ্জ থেকে বরিশাল রেঞ্জে আসা পুলিশ পরিদর্শক শাহ মো. আওলাদকে বাবুগঞ্জ থানার ওসি করার জন্য ডিআইজি হুমায়ুন কবির চার লাখ টাকার দর কষাকষি করে ব্যর্থ হন। ফলে আবার ঢাকা রেঞ্জে গিয়ে রাজবাড়ি থানার ওসি হিসেবে যোগদান করেন আওলাদ। ওইসময় ডিআইজি’র দাবিকৃত অর্থ দিয়ে মাহবুবুর রহমান বাবুগঞ্জ থানার ওসি নিয়োগ পেয়েছেন। একইসময় আরও কয়েকটি থানায় অর্থের বিনিময়ে ওসি নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে ডিআইজি হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে। তবে এ কাজ ডিআইজি নিজে সরাসরি করতেন না। তার হয়ে এক ওসি বদলি বাণিজ্যের ঘুষ লেনদেন করতেন। ‘ওসিদের ওই নেতার’ মাধ্যমে ডিআইজিকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে পটুয়াখালী সদর থানার ওসি (তদন্ত) হয়েছেন আবুল বাশার ও স্বরূপকাঠী (নেছারাবাদ) থানার ওসি (তদন্ত) হিসেবে যোগদান করেছেন মাজাহারুল আমীন। ওই দফায় পদোন্নতি পেয়ে বরিশাল রেঞ্জের বিভিন্ন থানায় ওসি (তদন্ত) হিসেবে পদ পাওয়া সকলকেই ডিআইজিকে অর্থ দিতে হয়েছে। এছাড়াও গত বছরের অক্টোবর মাসে ঝালকাঠীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিদুল ইসলামের অনৈতিক আচরনের শিকার হয়ে ডিআইজি’র কাছে প্রতিকার চেয়েছিলেন সদর থানার এসআই আনোয়ার হোসেন। আনোয়ারের স্ত্রী নাজমা সুলতানা অভিযোগ করেন, তার স্বামীর প্রতিকারের আবেদন ‘অসদাচারন’ হিসেবে উল্লেখ করে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় এএসআই পদে অবনমন করা হয়েছে। তিনি (নাজমা) আরও অভিযোগ করেন, তার স্বামীর অভিযোগ নিস্পত্তির জন্য ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন ডিআইজি হুমায়ুন কবির। টাকা দিতে না পাড়ায় উল্টো তার স্বামীকেই শাস্তি দেয়া হয়েছে। একইভাবে তুচ্ছ ঘটনার অজুহাতে গৌরনদী থানার চৌকস ওসি আবুল কালামকে শাস্তিমূলক বদলি করেছেন ডিআইজি। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে হুমায়ুন কবির যোগদান করেন। আগামী ২৬ জুলাই তার অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে। অবসরে যাওয়ার আগ মুহুর্তে তার বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির বিস্তার অভিযোগ ওঠায় বিব্রত হয়ে পড়েছেন বরিশালের বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা। সকল অভিযোগ অস্বীকার করে ডিআইজি হুমায়ুন কবির বলেন, যারা একই থানার আজীবন ওসি হিসেবে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের কয়েকজনকে ক্লোজ করা হয়েছে। তারাই এখন মিথ্যা অভিযোগ ছড়াচ্ছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনতো আগে হয়েছে। তখন ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠেনি। এখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। উল্লেখ্য, ৭৭ লাখ টাকার ঘুষ তহবিল গঠনের অভিযোগে গত বছরের ৩০ জুন তিনজন এএসআই সহ ১০ পুলিশ সদস্যকে এবং ঘুষের অর্ধকোটি টাকা নিজ হেফাজতে রাখায় ১ জুলাই উপ-কমিশনার জিল্লুর রহমানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। যা সারাদেশের পুলিশ বিভাগকে কলংক একে দেয়।
×