ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনবদ্য ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা

ওকি গাড়িয়াল মুই চলোং রাজপন্থে...

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৪ এপ্রিল ২০১৬

ওকি গাড়িয়াল মুই চলোং রাজপন্থে...

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলা লোকগানের আশ্চর্য সুন্দর ধারাটি ভাওয়াইয়া। আহা, কী গান! সব কথা বোঝা যায় না। তবু যেন নিজের কথাটি! বুকের একেবারে গভীরে যে বিরহ, বেদনার বোধ, বিয়োগ ব্যথা, উত্তরবঙ্গের শিল্পীরা তাদের নিজস্ব ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলেন। মানুষের সুখ স্বপ্নগুলোকে লালন করে ভাওয়াইয়া। তৃণমূলের জীবন, সমাজ-সংস্কৃতি থেকে নিয়ে সমৃদ্ধ হয়। শনিবার সে রূপটির সঙ্গে আরও একবার পরিচিত হলেন ঢাকার শ্রোতা। এদিন শুধু ভাওয়াইয়ার জন্য একটি সুন্দর সন্ধ্যা বরাদ্দ করেছিল গুলশানের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। শিল্পী ছিলেন সফিউল আলম রাজা। একক পরিবেশনায় শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় এই শিল্পী। ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে এখানে নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বেশ পরিশীলিত ঘরোয়া আয়োজন। সঙ্গীতের সমজদার শ্রোতারাই বেশি থাকেন। ভাওয়াইয়াটাও তাই চমৎকার উপভোগ করলেন তারা। সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগে মঞ্চে উঠেন সফিউল আলম রাজা। বিপুল জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া যেমন গেয়ে শোনান, তেমনি ছিল অপ্রচলিত গানের পরিবেশনা। সঙ্গতকারণেই প্রাধান্য পেয়েছিলেন ভাওয়াইয়ার প্রাণপুরুষ আব্বাস উদ্দীন। কিংবদন্তি শিল্পীর কণ্ঠে বহু গান বিখ্যাত হয়। এখনও বেঁচে আছে। সেগুলো থেকে কয়েকটি বেছে নেন সফিউল আলম রাজা। ভাওয়াইয়া গানের অন্যতম প্রধান চরিত্র গাড়িয়াল ভাইয়ের কথা জানাতে সুরে সুরে বলেনÑ বাওকুমটা বাতাস যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে/ কি ওরে ওই মতন মোর গাড়ির চাকা পন্থে/ পন্থে ঘোরে রে ওকি গাড়িয়াল মুই চলোং রাজপন্থে...। অপর গানে ভালবাসার মানুষকে হারানোর বিষাদ বিচিত্র ভাব ভাষায় প্রকাশিত হয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে শিল্পী গেয়ে যানÑ কিসের মোর রান্ধন কিসের মোর বাড়ন/ কিসের মোর হলদী বাটা/ মোর-এ প্রাণনাথ অন্যের বাড়ি যায়/ মোরে অঙিয়া দিয়া ঘাটা।/ ও প্রাণ সজনী, কার আগে কব দুষ্কের কথা...। হ্যাঁ, নারীর মনের কথা। ব্যক্ত হয় পুরুষ কণ্ঠে। ভাওয়ার এই রীতিটিও উপভোগ্য ছিল বৈকি! ভাওয়াইয়ায় ঘুরে ফিরেই আসেন কালা। আব্বাস উদ্দীনের সুর করা গান থেকে রাজা গেয়ে শোনানÑ ও মোর কালারে কালা/ ওপারে ছকিলাম বাড়ি/ কলা রুইলাম কালা সারি সারিরে কালা/ কলার বাগিচায় ঘিরিলো সেইনা বাড়িরে...। আধ্যাত্মবাদও স্থান পেয়েছে ভাওয়াইয়ায়। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাজা গেয়ে যানÑ ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে/ ফাঁন্দ বসাইছে ফান্দি রে ভাই/ পুঁটি মাছো দিয়া/ওরে মাছের লোভে বোকা বগা/ পড়ে উড়াল দিয়ারে...। নিজের সঙ্গীতগুরু নুরুল ইসলাম জাহিদ সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাওয়াইয়া গান লিখে গেছেন। সেখান থেকে রাজা গেয়ে শোনানÑ ওকি হায়রে হায়/ মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়...। একই গীতিকার থেকে পরে শিল্পী গানÑ ও বাহে অইদগে মাইনষের ফোসলামিতে/বাপ চাইল মোক বিয়াও দিতে/ এই কথাতে নাগিয়ে গেলো কাম/ ও বাহে আশ-পাশ আর দূর-দূরান্তর/ আসিল কত কইনের খবর/ বাড়িত নাগিল ঘটকের হাংগাম...। কুছিমউদ্দীনের কথা সুরে গেয়ে শোনানÑ তুই কেনে ডাকিলু নিশা রাইতে রে মুরুগা, তুই ক্যানে/ ওরে নিশা রাইতে ডাকিলু/ ঘুমের মানুষ জাগালুরে/ওরে তোর ডাকে মোর বন্ধু গেইল ছাড়িয়ারে...। সফিউল আলম রাজা নিজেও লেখেন ভাওয়াইয়া। সুর করেন। তেমন একটি গানÑ আরে ও সোনারে বন্ধুধন/ ছাড়িয়া না যান মোকে রে/ বুকের ভেতর কাচার ভাঙ্গেরে/ কাইও নাই বুঝিবে/আরও না হন/ বাঁশের আড়ালো রে...। এভাবে একটির পর একটি গান। গানের কথা সুরে ডুবে ছিলেন শ্রোতা। শিল্পীও এদিন দারুণ খেলেন সুর নিয়ে। খুব শোনা গানগুলোও তাই স্বতন্ত্র আবেদন নিয়ে হাজির হয়। ভাওয়াইয়ার মতো এমন লোকজ সম্পদ বাঁচিয়ে রাখতে নিশ্চয়ই ভূমিকা রাখবে এ ধরনের আয়োজন।
×