ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বনাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৪ এপ্রিল ২০১৬

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বনাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

(গতকালের পর) ফ্রান্সের সংশোধনবাদী ঐতিহাসিক রবার্ট ফরিসনকে গণ্য করা হয় নব্য নাৎসিদের সমর্থক একজন শীর্ষস্থানীয় হলোকস্ট অস্বীকারকারী হিসেবে। ১৯৯০ সালের ১৩ জুলাই ফ্রান্সে হলোকস্ট অস্বীকারকারীদের বিচার ও শাস্তির জন্য ‘গেসট আইন’ প্রণীত হওয়ার দুই যুগ আগে থেকেই ফরিসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্যাপক ইহুদী নিধন এবং গ্যাস চেম্বারে মানুষ পুড়িয়ে মারা থেকে শুরু করে এ্যানি ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরির সত্যতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি বই লিখেছেন। ১৯৮৫ সালে তিনি লিখেছেন ‘দি ডায়েরি অব এ্যানি ফ্র্যাঙ্ক : এ ফোর্জারি’। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ফরিসনের ‘মেমোয়ার এন ডিফেন্স’ গ্রন্থে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে ইহুদীদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা চ্যালেঞ্জ করেছেন। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখে নোয়াম চমস্কি ইউরোপে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। নব্য নাৎসিরা চমস্কির প্রশংসা করলেও ফরাসী বিদ্বৎসমাজে চমস্কির বন্ধুরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। চমস্কির এই ভূমিকা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে ‘সাম এলিমেন্টারি কমেন্টস অন দি রাইটস অব ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’ নামে। চমস্কি হলোকস্ট অস্বীকার না করলেও তার বন্ধুদের সমালোচনার জবাবে লিখেছিলেন, ‘হিজ রাইট টু সে ইট’। (দি নেশন, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১) হলোকস্ট অস্বীকার, প্রশ্নবিদ্ধ বা অবজ্ঞার ক্রমবর্ধমান ধারা প্রতিহতকরণের জন্য ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পর। পশ্চিমে ক্ষমতা ও বিত্তে ইহুদীরা যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও নব্য নাৎসি এবং ইহুদীবিদ্বেষী মুসলিম মৌলবাদীদের অর্থ ও ক্ষমতা উপেক্ষা করবার উপায় নেই। ১৯৯০ সালে ফ্রান্সে হলোকস্ট অস্বীকারকারীদের বিচার ও শাস্তির জন্য ‘গেসট এ্যাক্ট’ প্রণীত হওয়ার পর পরই এই আইনে সবার আগে বিচার হয়েছিল রবার্ট ফরিসনের। বিচারে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে জরিমানা করা হলে তিনি এর বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আপীল করেছিলেন এই বলে যে, ফরাসী সরকার মানবাধিকার কমিটির ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে তাকে শাস্তি দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি ১৯৯৬ সালে ফরিসনের আপীল আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। ফরিসনকে ২০০৬ সালে আবারও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল ইরানের এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে হলোকস্ট অস্বীকারের জন্য। সেবার তাকে জরিমানার পাশাপাশি তার সকল পদমর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এর পুরস্কার হিসেবে আয়াতুল্লাদের ইরানের প্রেসিডেন্ট ২০১২ সালে ফরিসনকে ‘সাহসিকতা’র জন্য পুরস্কৃত করেছেন। বাংলাদেশে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বেগম খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় আসেন তার প্রতিদান হিসেবে শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী এবং পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে সংবিধান লঙ্ঘন করে জামায়াতে ইসলামীর আমির হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন, যার প্রতিবাদে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২-এর জানুয়ারিতে আমরা ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করেছিলাম। কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অধিনায়ক কর্নেল কাজী নূরুজ্জামানসহ ১০১ জন বরেণ্য নাগরিক কর্তৃক স্বাক্ষরিত নির্মূল কমিটির ঘোষণায় সরকারকে ২৫ মার্চের ভেতর গোলাম আযমের বিচারের জন্য বলা হয়েছিল। এরপর বলা হয়েছিল, সরকার যদি ২৫ মার্চের ভেতর যুদ্ধাপরাধী এবং সংবিধান লঙ্ঘনকারী পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমের বিচার না করে ২৬ মার্চ সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত গঠন করে তার বিচার করা হবে। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস অস্বীকারের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ নাগরিক প্রতিবাদ। জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট বিএনপি সরকার গোলাম আযমের বিচার করেনি। গণআদালতের কর্মসূচী বানচাল করার জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে, দূরপাল্লার ট্রেন, বাস, লঞ্চ-স্টিমার সব বন্ধ করে রাজধানী ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে লাগানো আমাদের ৫০০ মাইক পুলিশ জব্দ করেছিল। হুমকি দেয়া হয়েছিল গণআদালত করলে ঢাকা শহরে রক্তগঙ্গা বইবে। সকল হুমকি অগ্রাহ্য করে আমরা গণআদালত করেছিলাম, যেখানে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছিল। গণআদালত করার সময় আমরা দেখেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা। সরকারের সকল হুমকি উপেক্ষা করে গণআদালত সফল করার জন্য সাংবাদিকরা কিভাবে জাহানারা ইমামের ডাক দেয়া দ্বিতীয় পর্বের মুক্তিযুদ্ধের এক একজন যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিলেন তার প্রতিফলন ঘটেছে তখনকার সংবাদপত্রে। তখন কোন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। নির্মূল কমিটি গঠনের পর থেকেই জামায়াত-বিএনপি-ফ্রিডম পার্টির সমর্থক বিভিন্ন দৈনিকে জাহানারা ইমাম ও তাঁর এই আন্দোলনকে ভারতের ও ইহুদীদের ‘চক্রান্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। অন্যদিকে গণআদালতের কর্মসূচী জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক গণমাধ্যম এক অভূতপূর্ব ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তখন সরকার আমাদের বিরুদ্ধে হলেও আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন না, বিএনপির প্রতি দুর্বল এমন কিছু সাংবাদিক নির্মূল কমিটির কর্মসূচী সমর্থন করেছেন এবং গণআদালত সফল করার জন্য যথাসাধ্য শুধু নয় অসাধ্যও সাধন করেছিলেন। ২৬ মার্চ ছিল স্বাধীনতা দিবস, সরকারী ছুটির দিন এবং পত্রিকাও এ দিন বন্ধ থাকে। শুধু গণআদালতের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দৈনিকগুলো নির্ধারিত ছুটি বাতিল করেনি, তিনটি দৈনিক এই দিন গণআদালতের সংবাদসহ টেলিগ্রাম বের করেছিল। দেশ ও জাতির বিশেষ সঙ্কটকালে বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম যখনই জনগণের পক্ষ অবলম্বন করেছে তখনই গণবিরোধী সরকারের রোষানলে পড়েছে। যে সব দৈনিক পত্রিকা গণআদালত সমর্থন করেছে তাদের সরকারী বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। গণআদালতের যে ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে জামায়াত সমর্থিত বিএনপি সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেছিল আমিও তাদের একজন। আমাকে শুধু রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়েই সরকার ক্ষান্ত হয়নি, ২৪ ঘণ্টার নোটিসে আমার ২০ বছরের চাকরি থেকে বরখাস্তও করেছিল। আমি তখন সরকারী মালিকানাধীন সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। এরপর আমাকে যাতে কোন পত্রিকা চাকরি না দেয় সে পথও বন্ধ করে দিয়েছিল খালেদা জিয়ার জামায়াতবান্ধব সরকার। সে সময় কী কঠিন আর্থিক সঙ্কটের ভেতর আমাকে পড়তে হয়েছিল আমার ঘনিষ্ঠজনরা তা জানেন। এরপর ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হয়েও রেহাই মেলেনি। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর খালেদা-নিজামী বাহিনীর নজিরবিহীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লেখার জন্য ২০০১ এবং ২০০২-এ আমাকে দুবার কারানির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল। দুবারই অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার যা উচ্চ আদালতে খারিজের জন্য দশ বছর আমাকে লড়তে হয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা তখন সরকার বার বার অস্বীকার করেছে। বলেছে, গণমাধ্যমে আমার মতো কিছু ‘ভারতীয় এজেন্ট’ মিথ্যা সংবাদ ছেপে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্ণিমা ধর্ষণের ঘটনাও অস্বীকার করেছিলেন যা পরে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সাংবাদিকদের হত্যা, চাকরিচ্যুতি, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার, নির্যাতন প্রাত্যহিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশকে ‘হিন্দুশূন্য’ ও ‘নৌকাশূন্য’ করার পাশাপাশি মুক্তচিন্তা মুক্ত করার এক ভয়ঙ্কর অভিযানে নেমেছিল খালেদা-নিজামীদের জোট সরকার। যে ‘ইনকিলাব’ ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার মিথ্যা সংবাদ ছেপে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছিল, সেই পত্রিকাটি ২০০২-২০০৩ সালে আমার বিরুদ্ধে এবং মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিষোদ্গার করে ক্রমাগত লিখেছে। ইনকিলাবের মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিষোদ্গারের স্বাধীনতা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দালাল প্রাক্তন গবর্নর মোনেম খানকে হত্যা করে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব পেয়েছিলেন। ‘ইনকিলাব’-এর ভাষায় মোনেম খান ‘শহীদ’, মোজাম্মেল ‘দুষ্কৃতকারী’। ‘ইনকিলাব’ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ‘সূর্যসন্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। গত ডিসেম্বরে (২০১৫) বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের অন্যতম নেতা গয়েশ্বর রায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ সম্পর্কে কদর্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য প্রদান করে পাকিস্তান প্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। গণমাধ্যমের এহেন স্বাধীনতা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে মুক্তযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের উচ্ছিষ্টভোগী সাংবাদিকের সংখ্যা কম নয়। এখন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পাঠক সংখ্যাও বেড়েছে। পাঠকের মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক সূচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম যদিও স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে চিনেছে এবং ঘৃণা করতেও শিখেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী তাদের সনাতন নাৎসি গোয়েবলসীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত সত্যকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করছে, নতুন প্রজন্মের পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের ভেতর সংশয় সৃষ্টি করছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ জানে বাংলাদেশে বাস করে সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করা যাবে না কিংবা মুক্তযুদ্ধ অস্বীকার করা যাবে না। তারা ‘তবে’, ‘যদি’, ‘কিন্তু’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে বলছে বিচার যথেষ্ট স্বচ্ছ বা মানসম্পন্ন নয়, শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পক্ষে প্রমাণ আছে ইত্যাদি। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’সহ সচেতন নাগরিকদের বিভিন্ন ফোরাম এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের দাবির কারণে অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬’ প্রণয়ন কতে যাচ্ছে। আইন কমিশন এই আইনের খসড়া প্রণয়নকালে আন্দোলকারী ব্যক্তি ও সংগঠনসহ মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এই খসড়া প্রণয়নে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন, যিনি সুপ্রীমকোর্টে বিচারক থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন, ২০১৬’-এর খসড়া রচনাকালে আইন কমিশন দেশবরেণ্য ৫৯ জন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করেছে। এর আগে অন্য কোনও আইনের খসড়া রচনার ক্ষেত্রে এভাবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বিষয়টি যেহেতু বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও চেতনার সঙ্গে জড়িত, সেহেতু আইন কমিশন এই আইনের খসড়া রচনার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত গ্রহণ করেছে। আমরা আশা করব আমাদের মহান জাতীয় সংসদ এই আইন দ্রুত অনুমোদনের ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ভবিষ্যতে এই আইন যাতে কেউ বাতিল করতে না পারে সে জন্য এর সাংবিধানিক সুরক্ষাও প্রয়োজন, যেমনটি করা হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩’-এর ক্ষেত্রে। এই আইনের মতো আইন কমিশনের প্রস্তাবিত আইনে বাদী শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নয় সরকারকেও হতে হবে। এ ছাড়া দেড় শ’ বছরের পুরনো ফৌজদারি আইন দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা রক্ষা করা যাবে কিনা এটি আইন কমিশনকে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনবিদিত ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, যা বার বার উচ্চারিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের বিভিন্ন ঘোষণা ও দলিলে এবং চূড়ান্তভাবে মূর্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আদি সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চার মূলনীতিতে- তা বার বার অস্বীকার ও বিকৃত করেছে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সামরিক শাসকরা। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারিকৃত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এবং আদি সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের চার মূলনীতি অস্বীকার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে এদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দর্শন প্রতিষ্ঠা করা, যাকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সমাধিস্থ করে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শুধু নয়, রাষ্ট্রের কোন অঙ্গই মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনবিদিত ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করতে পারে না। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন’ প্রণয়ন এবং এর কার্যকর প্রয়োগ বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরী। মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত শত্রুরা এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, যেভাবে তারা ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাতিলের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের এসব হুমকি ও বাধা শক্ত হাতে মোকাবেলা করা না হলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিরাপদ রাখার জন্য জামায়াতে ইসলামীর মতো স্বঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলসমূহের নিষিদ্ধকরণ যেমন জরুরী, তেমনই জরুরী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকারীদের উপযুক্ত দ-প্রদান। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজন স্বীকৃত ইতিহাস অস্বীকার বা কটাক্ষ কখনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়, তাহলে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে শুধু অস্বীকার নয়, মহিমান্বিত করা হয়। বাংলাদেশে শুধু গণমাধ্যম নয়, যে কোন প্রতিষ্ঠানকে অর্পিত দায়বদ্ধতাসহ দায়বদ্ধ থাকতে হবে তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং পাঁচ লক্ষাধিক নারীর চরম ত্যাগের প্রতি। যারা এই দায় অস্বীকার করবে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার যোগ্য হতে পারে না। (সমাপ্ত) ২০ এপ্রিল ২০১৬
×