ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মীম নোশিন নাওয়াল খান

হলুদ গোলাপ ও রোদ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

হলুদ গোলাপ ও রোদ

বাগানে অনেকগুলো ফুলগাছ। লাল গোলাপ, হলুদ গোলাপ ছাড়াও হাসনাহেনা, অপরাজিতা, রজনীগন্ধাসহ আরও অনেক ফুল। ওদের সবার মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব। প্রতিদিন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ফুলগাছগুলোর গায়ে শিশির এসে আদর মেখে দিত। সকাল হলে সূর্য ওঠার পর রোদ এসে আলত চুমু দিত ফুলের নরম পাপড়িতে, পাতার কোলে। সব ফুলেরা রোদকে অনেক ভালবাসত। সারাটাদিন রোদ ওদের সঙ্গে গল্প করত। ওদের খাবার রান্না করতে সাহায্য করত। দিনের শেষে সে বাড়ি ফিরে যেত। অন্ধকারের কোলে চড়ে সন্ধ্যা, তারপর রাত নামত, আর ফুলেরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুদিন আগে ফোটা একটা হলুদ গোলাপ দেখল রোদ ওর গায়ে সোনালি কিরণ ছড়াচ্ছে। ও নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল, গায়ের রংটা কেমন যেন গোলাপি আর সাদাটে হয়ে গেছে। তাই না দেখে গোলাপটার কী রাগ! কিন্তু ও মোটেই জানত না, যেই ছোট্ট মেয়েটির বাগান এটি, সেই মেয়েটি এই কারণেই ওকে এত ভালবাসত আর এজন্যই সে ওকে বাগানে এনে লাগিয়েছিল। গোলাপ ফুলটা কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখল, আসলে রোদের কারণেই তার গায়ের রং ঝলসে যাচ্ছে। রোদের উপর কী যে রাগ হলো ওর! গোলাপটা রোদকে চিৎকার করে বলল, ‘এই রোদ! তুমি কেন আমার গায়ের রং ঝলসে দিচ্ছ? আমি এত সুন্দর একটা ফুল, তুমি আমার নরম পাপড়ি তোমার আগুনের মতো তাপ দিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছ। তুমি আর কখনও আমার কাছে আসবে না। চলে যাও তুমি।’ রোদ ওর কথা শুনে খুব কষ্ট পেল। সে বলল, ‘আমি তো তোমার বন্ধু। আমি কি কখনও তোমাকে ঝলসে দিতে পারি?’ ‘দিচ্ছই তো।’ বলল গোলাপটা। ওদের কথায় অন্য ফুলগুলোও জেগে গেল। তারা গোলাপকে অনেক বোঝাল, রোদ না থাকলে তো তুমি খাবারই রান্না করতে পারবে না। তখন তুমি খাবে কী? রোদ না থাকলে তো একটা ফুলও ফুটবে না। তখন কী হবে? কিন্তু গোলাপটা কিছুতেই বুঝল না। সে রোদকে চলে যেতে বলল। রোদ খুব মন খারাপ করে চলে গেল। এরপর থেকে সে আর হলুদ গোলাপের কাছে আসত না। দুদিন পর গোলাপগাছ দেখল ঘরে কোন খাবার নেই, সে রান্নাও করতে পারছে না। রোদ ছাড়া তো সে রাধতেই পারে না। কিছুদিন এভাবে চলার পর ফুল ফোটা তো দূরেই থাকুক, সে এত অসুস্থ হয়ে পড়ল যে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। ছোট্ট মেয়েটা ফুলগাছটার এ দশা দেখে ভাবল, হয়তো পোকামাকড় আক্রমণ করেছে ওকে। সে গোলাপগাছে ভাল করে কীটনাশক ছড়িয়ে দিল। গোলাপটার এবার একদম মরো মরো অবস্থা হলো। কী বিচ্ছিরি গন্ধ কীটনাশকটার! দম বন্ধ হয়ে এল গোলাপের। কীটনাশকে কিছু হচ্ছে না দেখে মেয়েটা ভাবল, গাছ বোধহয় পানি কম পাচ্ছে। সে তখন ওকে বেশি করে পানি দিল। এত এত পানি, কিন্তু রোদ নেই। গোলাপ রান্না করতে পারল না। উল্টো ওর গোড়ায় পানি জমে শেকড় পচতে শুরু করল। ছোট মেয়েটা দেখল, গোলাপগাছটাতে আর একটাও ফুল ফুটছে না। আর এতকিছুর পরেও গাছটা সেরে উঠছে না, মরেই যাচ্ছে। সে তখন একা একা বলল, ‘আজ তো শনিবার। বাবার ছুটি থাকবে, বাবাকে বলব এই গোলাপগাছটা তুলে ফেলে আরেকটা নতুন গোলাপ কিনে আনতে। এটাতে তো আর রং পাল্টানো ফুল ফুটছে না। আমি এটা দিয়ে কী করব?’ গোলাপগাছ এ কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এমনিতেই সে অনেক দুর্বল আর অসুস্থ ছিল, তার উপরে এমন কথায় সে ভাবল, এবার আর তার বাঁচার উপায় নেই। গোলাপের এই হাল দেখে মাধবীলতা বলল, ‘আমরা তো বলেইছিলাম তোমাকে, রোদ আমাদের বন্ধু। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করে তুমি ঠিক করে বাঁচতেই পারবে না। উপকারী বন্ধুকে কখনও এভাবে ভুল বুঝতে নেই, আর তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে নেই। সবাই সবার সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করতে হয়। তা নাহলে সমাজে থাকা যায় না।’ অপরাজিতা বলল, ‘হ্যাঁ। কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে নেই। তাহলে নিজেকেও কষ্ট পেতে হয়। আর সবার সঙ্গে মিলেমিশে না থাকলে কেউ তোমায় ভালবাসবে না। সবাই তোমার সঙ্গে আড়ি নেবে, যেমন নিয়েছে রোদ। তখন তুমি একা একা বাঁচবে কিভাবে?’ ওদের কথা শুনে গোলাপগাছ ওর ভুল বুঝতে পারল। রোদ যখন অন্য গাছদের গায়ে এসে বসল, তখন গোলাপ তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করল এবং ক্ষমা চাইল। অন্য গাছেরাও রোদকে বলল গোলাপের ভুল ক্ষমা করে দিয়ে তার গায়ে বসতে। অনেক করে বলাতে রোদ ওদের কথা শুনল। সে গোলাপকে মাফ করে দিল এবং আবার তার পাতাগুলোতে গিয়ে আদর ছুঁয়ে দিল, তার খাবার রান্না করতে সাহায্য করল। গোলাপটা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। শুক্রবারে মেয়েটা বাবাকে নিয়ে গাছ তুলতে এসে দেখল, গাছটা অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে। সে তখন ওকে আর উপড়ে ফেলল না। বাবাকে বলল, ‘বাবা, আরও কিছুদিন দেখি। গোলাপগাছটা যদি আগের মতো হয়ে যায় তাহলে এটাকে আর উপড়ে ফেলব না।’ গোলাপসহ বাকি সব গাছেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। গোলাপগাছ রোদকে আদর করে দিয়ে বলল, ‘তুমি সত্যিই আমার অনেক ভাল বন্ধু।’
×