ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৮৭ ভাগ যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় ;###;সেবার মান দুর্বল ;###;যত্রতত্র যাত্রী উঠানো-নামানো হয়, দেখার কেউ নেই;###;সিটিং সার্ভিস নামে অনুমোদন দেয় না বিআরটিএ

নামেই সিটিং সার্ভিস ॥ রাজধানীতে গণপরিবহনে প্রতারণা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

নামেই সিটিং সার্ভিস ॥ রাজধানীতে গণপরিবহনে প্রতারণা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ গুলিস্তান-কালিয়াকৈর সড়কে চলা ‘প্রভাতী বনশ্রী’ পরিবহনের কিছু বাস কোন রকম অনুমোদন ছাড়াই সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল শুরু করেছে। ২৫ টাকার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ টাকা। বাসের গায়ে লেখা হয়েছে ‘সিটিং সার্ভিস’। অথচ সিটিংয়ের নামে প্রায় সব বাসেই দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হয়। টিকেট দেয়ার বালাই নেই। থামানো হয় ইচ্ছামতো। সব মিলিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের এ রকম কারসাজির কাছে যাত্রীরা অসহায়। তারা বাধ্য হয়েই বাড়তি টাকা দিচ্ছেন। এ নিয়ে যাত্রী ও বাস শ্রমিকদের মধ্যে বাগ্বিত-া এখন প্রতিদিনের। বাস্তবচিত্র হলো কোন গণপরিবহনের রুট পারমিটে সিটিং সার্ভিস করার অনুমোদন নেই। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতারাতি সাধারণ বাসগুলো সিটিং সার্ভিস হিসেবে চালানো হচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সিটিং সার্ভিসের নামে রাজধানীতে ৮৭ ভাগ পরিবহন যাত্রীদের থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করছে। সিটিং সার্ভিসের নামে রাজধানীজুড়েই চলছে এ রকম অরাজকতা। প্রতারণা। ‘কম স্টপেজ’ বা ‘সিটিং সার্ভিস’ লিখে যে যার ইচ্ছামতো বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। কারও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই জবাবদিহিতা। নামমাত্র মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেই দায় সারতে চায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেও সন্তুষ্ট নন এমন বাস্তবতায়। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, কেউ যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করলে তাদের অভিযানের আওতায় আনা হবে। নেয়া হবে আইনানুগ ব্যবস্থা। সরেজমিন দেখা গেছে, সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া নেয়া হলেও যাত্রীসেবার মান বাড়েনি। বেশিরভাগ সিটিং সার্ভিস বাসে ফ্যানের কোন ব্যবস্থা নেই। এক সিটের চেয়ে অন্য সিটের দূরত্ব কম। থামানো হয় সবখানেই। তেমনি যাত্রীও তোলা হয়। অপরিচ্ছন্ন আসন। ছারপোকার দৌরাত্ম্য। লক্কড় ঝক্কড় বাস। ইঞ্জিনের ওপর বসানো হয় যাত্রী। সব মিলিয়ে মানসম্মত গণপরিবহন একেবারে নেই বললেই চলে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাড়ি রাস্তার নামানোর পর একবারও সিটের কাপড় পরিবর্তন হয়নি। যা ছিল তাই। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। গত ছয় মাসে রাজধানীতে ১৫টির বেশি নতুন বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। এর সবটিই সিটিং সার্ভিস হিসেবে বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল শুরু করেছে। নতুনদের অনুসরণ করে পুরনো বাস সার্ভিসগুলোও সিটিং সার্ভিসের অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সম্প্রতি গণপরিবহনে যাত্রীসেবা নিজের চোখে দেখে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, যাত্রীসেবায় বিশ্বাস হারানো যাত্রীদের টানতে এখন বিভিন্ন পরিবহন আল্লাহর নামে প্রতারণা করছে। নিজের চাক্ষুস অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি নিজে দেখেছি গাড়ির গায়ে লেখা ‘সিটিং সার্ভিস’, অথচ ভেতরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। এটি সিটিং নয় একটা চিটিং সার্ভিস।’ তিনি আরও বলেন, এখন কেউ বিশ্বাস করে না বলে লিখে দিয়েছে ‘আল্লাহর কসম সিটিং সার্ভিস’! আরেকটা বাস দেখলাম মুন্সীগঞ্জের পথে, লিখেছে ‘আল্লাহর কসম ভিআইপি সার্ভিস’! দেশের গণপরিবহনের এই অব্যবস্থাপনা দূর করার জন্য পরিবহন মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান মন্ত্রী। তিনি একই সঙ্গে নতুন বাস নামাতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা নতুন বাস নামান। আমি পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় বাস উঠিয়ে দেব। পোস্তাগোলা ব্রিজ থেকে নতুন-বাজার রুটে চলা নতুন সার্ভিস রাইদা। সিটিং হিসেবে শুরু থেকেই বাসটি চলছে। এতে সর্বনিম্ন ভাড়া ধরা হয়েছে ১৫ টাকা। অর্থাৎ মালিবাগ রেলগেট থেকে বাসাবো পর্যন্ত তিন কিলোমিটারের কম পথে এই টাকা গুনতে হয়। মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা সরকারীভাবে নির্ধারণ করা আছে। ১৫ টাকায় অন্তত ১০ কিলোমিটার রাস্তা যাওয়া সম্ভব। এই পরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকার বালাই নেই। ভাড়া ডাকাতির আরেকটি সার্ভিসের নাম লাব্বায়েক পরিবহন। শুরু থেকেই এই পরিবহনটি যাত্রীদের পকেট কাটছে। যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী ও সাভার পর্যন্ত এই পরিবহনটি চলাচল করে। তাদেরও সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা! লাব্বায়েক পরিবহনের চালক সাহেদ মিয়া জানালেন, বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ সত্য নয়। আমাদের সার্ভিস ভাল। তাই যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে কোন ক্ষোভ নেই। মতিঝিল থেকে মিরপুর রোডে নতুন সিটিং সার্ভিস ‘র‌্যাম্প পরিবহন’। এই গাড়িটির বিরুদ্ধেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ যাত্রীদের। ফার্মগেট থেকে মতিঝিলের ভাড়া নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। খিলক্ষেত থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত উইনার ট্রান্সপোর্ট, দ্বিপ বাংলা পরিবহন সিটিং সার্ভিস হিসেবে জনপ্রতি ভাড়া আদায় করছে ৬০ টাকা। গুলিস্তান থেকে চিড়িয়াখানাগামী বসুমতি ট্রান্সপোর্ট আগের ২৩ টাকা থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে জনপ্রতি ২৮ টাকা করে ভাড়া আদায় করছে। কাজল নামের বসুমতির কর্মী বলেন, বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী তারা ভাড়া আদায় করছেন। নতুন নিয়মে আগের চেয়ে পাঁচ টাকা ভাড়া বেড়েছে। যদিও গুলিস্তান থেকে চিড়িয়াখানার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটারের বেশি নয়; সে হিসেবে ভাড়ার বাড়ার কথা সর্বোচ্চ দুই টাকা। মতিঝিল থেকে নিউ ভিশন পরিবহনে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৮ টাকা। ফার্মগেট পর্যন্ত ১২ টাকা। যা আগে ছিল ২৩ টাকা ও ১০ টাকা। এই পরিবহনের সুপারভাইজার শাকিল জানালেন, ভাড়া আমরা নির্ধারণ করি না। মালিক পক্ষ আমাদের যেভাবে ভাড়া নিতে বলেন আমরা সেভাবেই কাজ করি। বাড়তি যাত্রী তোলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিটিং সার্ভিস হলেও অনেক সময় যাত্রীদের অনুরোধে বাড়তি লোক তোলা হয়। গুলিস্তান থেকে আব্দুল্লাহপুরগামী বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ পরিবহনে (৩ নম্বর বাস) আগে শাহবাগ থেকে মহাখালী যেতে ছয় টাকা ভাড়া দিতে হতো। তবে নতুন ভাড়া কার্যকরের দিন থেকে যাত্রীদের কাছ থেকে ৮-১০ টাকা করে আদায় করছে তারা। মতিঝিল থেকে সাভার রুটে সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে ওয়েলকাম পরিবহন। শাহবাগ থেকে গাবতলী পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার রাস্তায় ভাড়া আদায় হচ্ছে দ্বিগুণ। মতিঝিল থেকে চলা ৭১ পরিবহন, বায়ান্নসহ বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গাবতলী থেকে গাজীপুর রুটে চলা বসুমতি পরিবহনের যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন। গাবতলী-বাড্ডা রুটে চলা রবরব পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযোগ একই। গাবতলী থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত নতুন মিনিবাস সার্ভিস চালু হয়েছে সম্প্রতি। সিটিং সার্ভিসের নামে এই পরিবহনেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যাত্রীদের টিকেট না দেয়া, যেখানে ইচ্ছামতো যাত্রী ওঠানোসহ দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়ার অভিযোগ বিস্তর। এই পরিবহন কোম্পানিটিও সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা করেছে। খিলগাঁও থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত নিয়মিত চলছে মিডওয়ে পরিবহন। বাসাবো বৌদ্ধমন্দির থেকে মতিঝিল পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তার জন্য ভাড়া দিতে হয় ১০ টাকা। সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত ২০ টাকা! খিলগাঁও থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত বাহন পরিবহনে সিটিং সার্ভিসের নামে ৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। বাসাবো থেকে শাহবাগ নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। অথচ এ দুটি পরিবহনের কোনটিই সিটিং চলে না। কোন টিকেটেরও ব্যবস্থা নেই। মিরপুর থেকে খিলগাঁও পর্যন্ত চলা হিমাচল পরিবহনে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। সায়েদুল নামে এক যাত্রী জানান, সিটিং সার্ভিসের নামে কোম্পানিটি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করে। সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা। মিরপুর-১২ থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত চলা বিহঙ্গ পরিবহন, আকিক, প্রজাপতি পরিবহনে সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে রাজধানীতে বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১০ পয়সা বাড়িয়ে এক টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। মিনিবাসের ভাড়াও ১০ পয়সা বেড়ে এক টাকা ৬০ পয়সা হয়েছে। সে হিসেবে ১০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে বাসগুলোতে মাত্র এক টাকা বেশি ভাড়া নেয়ার কথা। কিন্ত এই পরিমাণ দূরত্বে ঢাকার বিভিন্ন রুটের পরিবহনগুলোকে নতুন ভাড়া কার্যকরের অজুহাতে দুই টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ‘লোকাল’ বাসগুলো আগে যেখানে পাঁচ টাকা ভাড়া নিত এখন সেখানে ছয় টাকা নিচ্ছে। আবার আগের ৭-৮ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ১০ টাকা হারে। জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অভিযান চলমান রয়েছে। কেউ বাড়তি ভাড়া আদায় করলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, কোন পরিবহন কোম্পানি যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেয়ার কথা নয়। কেউ যদি বাড়তি ভাড়া আদায় করে তাহলে কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের সমিতির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হবে। তাছাড়া এ ব্যাপারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, রুট পারমিটে সিটিং সার্ভিস বলতে কিছু নেই। সিটিং সার্ভিস হিসেবে বিআরটিএ কোন বাস অনুমোদন দেয় না। তবুও অনেকে সিটিং হিসেবে গাড়ি চালাচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। এ কারণে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগও আসছে। এ প্রসঙ্গে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস চালানোর কোন বৈধতা নেই। কারণ গাড়ির আসন বিবেচনা করে বিআরটিএ থেকে ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। এই হিসেবে কোন পরিবহনেই দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার কথা নয়। কিন্তু একদিকে বাস কোম্পানিগুলো দাঁড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছে অন্যদিকে সিটিংয়ের নামে বাড়তি ভাড়াও নিচ্ছে। এখন প্রকাশ্যে স্টিকার লাগিয়ে সিটিং সার্ভিস চলছে। এসব বাস কোম্পানিকে সহজেই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব বলে মত দেন তিনি।
×