ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

শহীদ তাজুল মিলনায়তনে সম্মাননা গান ও কবিতায় বৈশাখী সম্মিলনী

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

শহীদ তাজুল মিলনায়তনে সম্মাননা গান ও কবিতায় বৈশাখী সম্মিলনী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছুটির দিনে সকাল থেকে শুরু হলো বৈশাখী সম্মিলনী। বাংলা নববর্ষ উদযাপনে রোদ বৃষ্টি ঝড়ের বার্তা সামনে রেখেই বলা হলো এগিয়ে যাওয়ার কথা। প্রকাশিত হলো গণতান্ত্রিক-মানবিক ও সাম্যময় মাতৃপ্রান্তর গড়ার প্রত্যয়। নববর্ষে নবপ্রতিজ্ঞতায় নবশপথে প্রতিপাদ্যে এই সম্মিলনের আয়োজন করে মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট। শুক্রবার পুরানা পল্টনের ট্রাস্ট ভবনের শহীদ তাজুল মিলনায়তনে বৈশাখ আবাহনে প্রাণের উচ্ছ্বাসে মিলিত হলেন সকলে। আনন্দ আড্ডার সঙ্গে গাওয়া হলো গান, পড়া হলো কবিতা। সম্মিলনীর আনন্দ আয়োজনটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে মহান স্বাধীনতার ৪৫ বছর এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ১০৫ বছরের আনুষ্ঠানিকতায়। এ উপলক্ষে প্রদান করা হয় বৈশাখী সম্মাননা, বেতিয়ারা শহীদ জননীদের সম্মাননা, অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জুটিকে সম্মাননা, তিন শহীদ তনয়াকে সম্মাননা ও একাত্তরের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষককে সম্মাননা। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনেও সাহসিতার জন্য প্রদান করা সম্মাননা। প্রাণের এই সম্মিলনে সকালের খরতাপ উপেক্ষা করে অভ্যাগতদের আগমনে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণের উত্তাপ। কবিতা আবৃত্তি দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ভরাট কণ্ঠে শ্রোতাকে আলোড়িত করে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর হাড়েরও ঘরখানি কবিতাটি পাঠ করেন মোবারক। এর পর গান নিয়ে মঞ্চে আসেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর মিরপুর শাখার শিল্পীরা। নতুন বছরে আবাহনে সুদিনের প্রত্যাশায় শিল্পীরা গেয়ে শোনানÑ সেদিন আর কত দূরে/যখন প্রাণের সৌরভে সবার গৌরবে ভরে...। গান শেষে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ট্রাস্টের সম্পাদক মুহম্মদ হিলালউদ্দিন। সূচনা বক্তৃতা করেন ট্রাস্টের সভাপতি শেখর দত্ত। সংক্ষিপ্ত কথন শেষে সম্মাননাপ্রাপ্তদের হাতে স্মারক তুলে দেয়া হয়। সবশেষে সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাঙালী সংস্কৃতিতে নববর্ষ আবহমানকালের ঐতিহ্য। গ্রাম-গ্রামান্তরে বরাবরই হালখাতা, মেলা-পার্বণ হতো। কিন্তু ঢাকা মহানগরে নবপর্যায়ে নববর্ষ পালন শুরু হয় পাকিস্তানী আমলে ষাটের দশকের শুরু থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার পর যখন দমন-পীড়ন ও বিধিনিষেধের ফলে রাজনৈতিক আন্দোলনে ভাটার টান, সেই সময় ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে রমনা বটমূলে সঙ্গীত অনুষ্ঠান ও ছাত্র ইউনিয়নের প্রভাতফেরির মাধ্যমে দিবসটি পালন শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে এই অনুষ্ঠান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিস্তারলাভ করতে থাকে। আজ বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সব মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য নূরুর রহমান ও ফরিদা আক্তার জাহান জীবনকে প্রদান করা হয় অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জুটি সম্মাননা। একই সম্মাননা জানানো হয় আজিজুর রহমান চৌধুরী ও আয়েশা আক্তারকে। একাত্তরের ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য এই জুটির প্রতি জানানো হয় সশ্রদ্ধ অভিবাদন। মুুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে নিবেদিত অংশী হিসেবে মফিদুল হককে এবং বিজ্ঞান সাধনার অগ্রযাত্রী অধ্যাপক হাসিনা খানতে প্রদান করা হয় বৈশাখী সম্মাননা। সম্মাননাপ্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় মফিদুল হক বলেন, জীবনে অনেক মহান শিক্ষা পেয়েছি মণি সিংহের কাছে। জীবনের গৌরবময় দিনগুলো কেটেছে এমন মহান মানুষের সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, বৈশাখ মানেই নতুন যাত্রা। আর এই সম্মাননাপ্রাপ্তির মাধ্যমে সেই নবযাত্রার অংশীদার হলাম। আজিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পর এই সম্মাননা আমাকে অভিভূত করেছে। ১৯৭১ সালের ১১ নবেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারায় শহীদ হয়েছিলেন নয়জন বিশেষ গেরিলা যোদ্ধা। সেই নয় মুক্তিযোদ্ধার প্রয়াত ও জীবিত সহধর্মিণীদের প্রদান করা হয় সম্মাননা। তাঁরা হলেনÑ অর্সিয়া (প্রয়াত), জাহানারা আহমেদ (প্রয়াত), জোবেদা খানম (প্রয়াত), জোবেদা খাতুন (প্রয়াত), জোবেদা বেগম (প্রয়াত), মোসাম্মৎ রজবন্নেসা, মোসাম্মৎ সাহেরা খাতুন (প্রয়াত) ও হালিমা খাতুন (প্রয়াত)। শহীদ জননীদের পরিবারের সদস্যদের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেয়া হয়। তাঁদের মুখ থেকে উঠে আসে বেতিয়ারার শহীদ গেরিলা যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার কথা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আগুন পাখি নামে পরিচিতি পাওয়া প্রয়াত ভাষাসংগ্রামী নাদেরা বেগমকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। একাত্তরের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে ছাত্র ইউনিয়ন সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ আবুল কাশেম মিয়াকে প্রদান করা হয় বৈশাখী সম্মাননা। তিন শহীদ তনয়াকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। তাঁরা হলেনÑ শহীদ অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার মেয়ে মেঘনা গুহ ঠাকুরতা, সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ এবং ডাঃ আলিম চৌধুরীর চেয়ে ডাঃ নুজহাত চৌধুরী। এই তিন শহীদ তনয়ার মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নুজহাত চৌধুরী। তিনি বলেন, এই সম্মাননা প্রদানের ক্ষেত্রে একাত্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত নিভৃতচারী মানুষগুলোকে খোঁজা হয়েছে। আলিম চৌধুরীর মেয়ে হিসেবে নয়, সহস্র শহীদের সন্তানদের পক্ষে আমি এই সম্মাননা গ্রহণ করছি। মানব মুক্তি ও প্রগতির কঠিন সংগ্রামে নিভৃতে নেপথ্যে স্বদেশের জন্য কাজ করেছেন এমন ১৫ জন অগ্রণী জননীকে প্রদান করা হয় সম্মাননা। তাঁরা হলেনÑ আকিকা খাতুন (প্রয়াত), আনোয়ারা বেগম (প্রয়াত), ঊষা দাশ পুরকায়স্থ (প্রয়াত), খাদিজা বেগম (প্রয়াত), নূরজাহান বেগম, নির্মলা ম-ল (প্রয়াত), বদরুন্নেসা খানম (প্রয়াত), মামুনা খাতুন (প্রয়াত), মোমেনা খাতুন (প্রয়াত), রাফিয়া চৌধুরী (প্রয়াত), রিজিয়া বেগম, রেণুকা দাশগুপ্ত (প্রয়াত), হাসিবা খাতুন (প্রয়াত), শামসুন নাহার ও সিরিজা হোসেন। সম্মাননা প্রদান শেষে ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠান। খবির উদ্দিন পরিচালিত ক্ষণিকের মিলন নামের সঙ্গীত দল পরিবেশন করেÑ নাও বাওয়া মর্দ লোকের কাজ, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম ও রাঙামাটির দেশে লাল পাহাড়ের দেশে যা শিরোনামের তিনটি গান। উদীচীর মিরপুর শাখার শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিনসহ বিশিষ্টজনরা অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। তনুর বিচার দাবিতে গান ও আলোচনা ॥ নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার দাবিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলছে পাঁচ দিনব্যাপী প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুক্রবার ছিল এ আয়োজনের চতুর্থ দিন। এদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ। গানের সুরে ও বক্তাদের আলোচনায় তনু হত্যাকা-ের প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের দাবি জানানো হয়। আলোচনায় অংশ নেনÑ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ঝুনা চৌধুরী, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আহ্্কাম উল্লাহ্ ও গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সম্পাদকম-লীর সদস্য মানজার চোধুরী সুইট। সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সভাপতি গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর। আজ শনিবার শেষ হবে পাঁচ দিনের এই প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এদিন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে বিকেল ৫টায় তনু হত্যার প্রতিবাদে আলোচনা এবং সন্ধ্যায় তনুর জন্য প্রদীপ প্রজ্বলন করা হবে। গানে গানে বকুলতলায় বর্ষবরণ ॥ গানে গানে বরণ করা হলো ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে। শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় অনুষ্ঠিত হলো ‘বর্ষবরণ উৎসব ১৪২৩’। নববর্ষ উদযাপনের এ আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন অমৃতবর্ষিণী। রাগাশ্রয়ী ও বাংলা গানে সাজানো ছিল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় শিশু তবলচি ভুবন ও ফাহমিদার যৌথ তবলাবাদনের মাধ্যমে। ত্রিতালে দুই শিশুশিল্পীর তবলাবাদনে মুগ্ধ হয়েছেন শ্রোতারা। এর পর পাঠ ও বক্তৃতা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লতিফুন জুলিও। তিনি জানান, সাংস্কৃতিক সংগঠন অমৃতবর্ষিণীর প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এই আয়োজন। কথা শেষে শুরু হয় পরিবেশনা পর্ব। ‘হংসধ্বনি’ রাগে সম্মিলিত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় তারানা। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অংশগ্রহণে বৈশাখী উৎসব ॥ বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হলো থ্যালাসেমিয়া পরিবারের বৈশাখী আয়োজন ‘উৎসব ১৪২৩’। শুক্রবার সকালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এ আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি ও ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে তরুণদের উদ্দেশে কথা বলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। থ্যালাসেমিয়া সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা দিদার বক্স, সাধারণ সম্পাদক সানজিদা জামান লিজা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে থ্যালাসেমিয়া রোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘আইসাপোর্ট’ শীর্ষক কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়া হয়। আয়োজনের শুরুতেই ছিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। সাদা ক্যানভাসের মনের ভাব রংতুলির আঁচড়ে তুলে আনে ছোট্ট শিশুরা। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। যার শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনায় তাসনিয়া, সামিহা, আনদারা, নওশীন, সাদিয়া, নাশা, ওয়াফা ও মাহিন। এরপর থ্যালাসেমিয়া পরিবারের পক্ষে বাচ্চাদের সঙ্গে ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি পরিবেশন করেন অভিভাবকরা। অনুষ্ঠানে শিশুদের উদ্দেশে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা এদেশের জন্য আমাদের সাধ্যমতো করার চেষ্টা করেছি। তোমাদের জন্য দেশ স্বাধীন করেছে, নিজেদের পতাকা, নিজেদের ভূখ- এনেছি। কিন্তু দুঃখের কথা তোমাদের জন্য বাসযোগ্য একটি রাষ্ট্র আমরা রেখে যেতে পারছি না। আর্থিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে আমরা অগ্রসর হলেও, রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনও বিদ্যমান। এই বাংলাদেশকে বাসযোগ্য রাষ্ট্র করার দায়িত্ব তোমাদের। তোমরা তোমাদের সৃজনশীলতা, কর্মযজ্ঞ দিয়ে এ দেশেকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবা, এটাই আমার প্রত্যাশা।
×