ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কঠোর অভিযানে নামছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

ফার্মেসিতে ভুয়া ফার্মাসিস্টের ছড়াছড়ি, মারাত্মক হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

ফার্মেসিতে ভুয়া ফার্মাসিস্টের ছড়াছড়ি, মারাত্মক হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওষুধের দোকানে কর্মরত অবৈধ ও ভুয়া ফার্মাসিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধের দোকান চলবে না বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অধিকাংশ ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রি করেন অবৈধ ও ভুয়া ফার্মাসিস্টরা। স্পর্শকাতর, ঝুঁকিপূর্ণ নানা ওষুধ তারা বিনা ব্যবস্থাপত্রে তুলে দেন গণমানুষের হাতে। অনেক ওষুধেরই যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, সে বিষয়েও অনেক ওষুধ বিক্রেতার জ্ঞান নেই। নিম্নমানের, এমনকি ভেজাল ওষুধ গছিয়ে দিতেও তাদের বাধে না। ফলে রোগমুক্তির বদলে অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা বাড়ছে। ভেজাল ওষুধে, অপচিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা তো ঘটেছে বহুবার। দেশে কয়েক লাখ ফার্মেসির বিপরীতে প্রকৃত ফার্মাসিস্টের সংখ্যা মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এর মধ্যে ‘এ’ এবং ‘বি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্ট আছেন মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার। সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ওষুধের ব্যবহার বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ফার্মাসিস্ট ছাড়া কোন ওষুধের দোকান চলবে না। যেসব ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট রাখার যোগ্যতা নেই তাদের ওষুধের ব্যবসা করার দরকার নেই। আমি সিদ্ধান্ত নেব যে, প্রত্যেক ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট রাখতে হবে। অন্যথায় ওষুধের দোকান চলবে না। এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহায়তা আশা করছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধের দোকান হতে পারে না। কোন্ এলাকায় কতটা ওষুধের দোকান থাকবে তা ভাগ করে দেয়া হবে। মানসম্পন্ন দশটা দোকান হলেই যথেষ্ট, এক শ’টা দোকান থাকবে কেন? ওষুধশিল্প এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, দেশে অনেক ওষুধের দোকান লাইসেন্স ছাড়াই চলছে। এগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু আপনারা কোন প্রতিবাদ করতে পারবেন না। যাদের লাইসেন্স আছে তাদের লাইসেন্সও খুঁটিয়ে দেখা হবে। যোগ্যতা না থাকলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে না ওঠার সুযোগে ফার্মেসিভিত্তিক ভয়ঙ্কর ডাক্তারির প্রবণতা বন্ধ হওয়া দূরের কথা, সবাই যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ৮৭ শতাংশ ওষুধ বিনা ব্যবস্থাপত্রে বিক্রি হচ্ছে এবং ৬৪ শতাংশ বিক্রেতা উপসর্গ শুনে নিজেরাই ‘ডাক্তারি’ করছে। দেশে অনুমতিপ্রাপ্ত ফার্মেসির তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ওষুধ বিক্রির প্রতিষ্ঠান থাকলেও এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলে না। বছরে হাতেগোনা অভিযান চালিয়ে দায়িত্ব পালন করেন সংশ্লিষ্টরা। নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি ও বাজারজাতকারীরাও শাস্তির বাইরে রয়ে যায়। ওষুধের দোকান বা ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টদের ওষুধ বিক্রি করার কথা। কিন্তু সারাদেশের অসংখ্য ফার্মেসিতে কোয়াক বা অবৈধ ফার্মাসিস্টরাই ওষুধ বিক্রি করছে। বাংলাদেশে কয়েক লাখ ওষুধের দোকান রয়েছে । এগুলো চালানোর জন্য রয়েছে অতি সামান্যসংখ্যক সরকারী রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট। প্রতি ওষুধের দোকানে একজন করে সরকারী রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট থাকার কথা থাকলেও প্রতি দশ দোকানেও একজন নেই। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। স্পর্শকাতর এই সেক্টর চালাচ্ছে অল্পকিছু শিক্ষিত ফার্মাসিস্ট লোকের সঙ্গে কম শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত অবৈধ ফার্মাসিস্টরা। দেশের সর্বত্র রয়েছে বিপুলসংখ্যক ওষুধের দোকান, এর সংখ্যা কয়েক লাখ। মানুষ প্রয়োজনে ওষুধ কিনে এসব দোকান থেকে কখনও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে, কখনও ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই। আর এসব দোকান থেকেও অনায়াসে যে কোন ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে ক্রেতার কাছে, অনেক জটিল রোগের ওষুধও এরা বিক্রি করে কোন ধরনের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই (যা ১৯৮২ সালের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধ)। অথচ, ফার্মেসি থেকে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ওটিসি ড্রাগ ছাড়া অন্য কোন ওষুধ বিক্রি করার কথা নয়। অবাধে যাচাই-বাছাই ছাড়া বিক্রি হচ্ছে ওষুধ ফার্মেসি থেকে। অবৈধ ফার্মাসিস্টরা বুঝে না বুঝে যে কোন ওষুধই বিক্রি করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুসারে প্রত্যেক ফার্মেসিতে একজন করে গবঃ রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট থাকার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে এই আইনের বাস্তবায়ন নেই। জনগণকে সচেতন হতে হবে এবং যারা ড্রাগের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে আছেন তাদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে ফার্মেসিগুলোকে তদারকির অধীনে আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে কয়েক লাখ ফার্মেসির বিপরীতে ফার্মাসিস্টের সংখ্যা মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এর মধ্যে ‘এ’ এবং ‘বি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্ট আছেন মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার। এ গ্রেডের ফার্মাসিস্টরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি ফার্ম বা এম ফার্ম ডিগ্রিধারী। তারা ওষুধ বিক্রির জন্য ফার্মেসিতে কাজ করেন না। তারা মূলত ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। বি গ্রেডের ফার্মাসিস্টরা বিভিন্ন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ইন্সটিটিউট বা কলেজের অধীনে ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারী। তারাও ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রি করেন না। তারা সরকারী রেজিস্টার্ড হাসপাতাল, ক্লিনিক বা কর্পোরেট অফিসে সহকারী ফার্মাসিস্ট হিসেবেই কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন। আর সি গ্রেডের ফার্মাসিস্টরা মাধ্যমিক (এসএসসি) অথবা উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর যোগ্যতাসম্পন্ন, যারা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের অধীনে ফার্মেসি রেজিস্ট্রেশন কোর্স সম্পন্ন করেছেন। এদের সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫ হাজার। দুঃখজনক হচ্ছে, প্রতিবছর প্রায় ৪ হাজার সি গ্রেডের ফার্মাসিস্ট বের হন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে চলে যান। ফার্মেসিগুলোতে ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করা জরুরী। ফলে যারতার কাছে যে কোন ধরনের ওষুধ বিক্রির প্রবণতা বন্ধ হবে। পাশের দেশ ভারতে ইতোমধ্যেই প্রত্যেক ফার্মেসিতে একজন করে ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারী ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জানায়, নতুন ওষুধ আইন-২০১৪ প্রণয়নে হাত দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে এ আইনের একটি খসড়াও তৈরি হয়ে গেছে। এ আইনে দেশের ওষুধ প্রশাসনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং বিভিন্ন ওষুধ শিল্প কারাখানার নিয়মকানুন যাচাই-বাছাই করে দেখার অধিকার দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত ওই আইনে দোকানে ওষুধ নিরাপত্তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দ্রুত বর্ধনশীল ওষুধ শিল্প বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে ১৯৪০ সালের ওষুধ আইনের অধীনে। ওষুধ শিল্পে নতুন নীতিমালার প্রয়োজন জরুরী হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে সেই ব্রিটিশ আমলের আইন কোন প্রভাব ফেলবে না। সূত্রটি আরও জানায়, ওষুধের ব্যবসা করতে হলে ফার্মেসিতে অবশ্যই উপযুক্ত ফার্মাসিস্ট থাকতে হবে, তা না হলে ফার্মেসি চলতে দেয়া হবে না। দেশের অধিকাংশ ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট না থাকা খুবই বিপদের ও দুঃখজনক। কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। ফার্মেসি থেকে ওষুধ নেয়ার ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সচেতনতা দরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, যে কোন ভেজাল ও নিম্নমান এবং ভুলভাবে ওষুধ গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারকারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারেন। ওষুধ কেনার সময় সতর্ক হতে এবং মানবহির্ভূত ওষুধ এড়িয়ে চলার জন্য জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ।
×