ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পলো, ঠেলাজাল ঠেলাতে আনন্দই আলাদা

বৈশাখে মাছ ধরা

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

বৈশাখে মাছ ধরা

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে...’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার গ্রীষ্মের রূপ দেখেছেন নানাভাবে। হাঁটু জলের এই নদীতে বৈশাখ মাসে ছেলেরা নাইতে নামে। কাদায় নৌকা আটকে গেলে মাঝিমাল্লা ও নদী তীরের লোকজনের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। খুঁজতে থাকে আর কত জলাশয়ে পানি একেবারে কমে কাদা জমেছে। এইসব দেখে গ্রামের কৃষক ও তরুণরা কোন এক সকালে পলো, কোঁচা ঠেলা জাল ও মাছ ধরার সামগ্রী নিয়ে কাদায় মাছ ধরতে নামে। এই সময়টায় মধ্য বৈশাখে গ্রামে এমন দৃশ্য আজও চোখে পড়ে। যদিও অনেক নদীতে চর পড়ে মাছ ধরার সেই অবস্থায় নেই তারপরও নদীর ভিতরে নেমে পলো আটকে ওপর থেকে হাত ঢুকিয়ে মাছ ধরার আলাদা একটা আনন্দ আছে। কেউ হাঁটু পানিতে ঠেলা জাল বসিয়ে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে কখন শোল, সরপুটি, মাগুর, শিং মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে জানান দেয় তারা ধরা পড়েছে। দিনভর মাছ ধরার পর গোটা দেহ কাদায় মেখে যায়। তখন মনে হয় কাদামাটি দিয়ে সাজগোজ করেছে। দল বেঁধে এমন মাছ শিকারের আনন্দই আলাদা। উত্তরাঞ্চলের অনেক গ্রামে শুধু দল বেঁধে নয়, গ্রামের লোক ভেঙ্গে পড়ে এমন মাছ ধরায়। বগুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে হাজারো লোকের উপস্থিতিতে কাদাপানিতে এভাবে মাছ ধরার আয়োজনকে বলা হয় ‘বোত নামছে’। একেক এলাকায় একেক নামে কাদাজলে মাছধরার উৎসবের নামকরণ করা হয়। এই মাছধরা লোকজ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। মাছ ধরতে যাওয়ার সময় গাঁয়ের বধূরা গীত গায়। পুরুষরা যে যার মতো শব্দ বানিয়ে হৈহৈ রৈরৈ করে এগিয়ে যায় জলাশয়ের দিকে। সকলে মিলে উৎসবের আমেজে নানা জাতের মাছের নাম ধরে যে যার মতো করে ছন্দ বানিয়েছে। একটা সময় এই কাদাপানিতে মিঠা পানির সকল মাছই পাওয়া গেছে। আজ আর সেই অবস্থা নেই। এ্যালং মাছ, দাড়কে মাছ, ডোরাকাটা বউ মাছ, ভ্যাদা মাছ, চ্যাঙ কাঁকলে ঠাঁটানি, ট্যাপা... মিঠা ও স্বাদু পানির এইসব মাছ নিয়ে কত যে ছন্দ তৈরি করা হয়েছে। সেই মাছ আর চোখে পড়ে না। মাছে ভাতে বাঙালীর পরিচয়ের সঙ্গে মানুষের শারীরিক ও আত্মপ্রকাশের বিষয়গুলো আজও মাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমন হালকা পাতলা গড়নের কাউকে দেখলে বলা হয় পাতাসী। ঘুমের ঝিমুনি ভাব দেখলে পিন করা হয়েছে ট্যাংরা মাছ বলে। বোকার মতো হা করে তাকিয়ে থাকা দেখলে সম্বিত ফেরানো হয়েছে ভ্যাদা ডাক দিয়ে। কারও অস্থিরতার সময় উপমায় এসেছে মাগুর মাছ। কেউ প্যাঁচ দিয়ে কথা বললে কটাক্ষ করে গচি মাছকে টেনে আনা হয়েছে। বোয়াল মাছকে নিয়ে প্রবাদ আছে শুদ্ধির। গজার ও শোল মাছের চোখ দেখে বলা হয়েছে ভয়ের মাছ, কেউ বলেছে জিনভূতের আছর আছে। মাছ নিয়ে গল্প কথার শেষ নেই। চিরচেনা সেইসব মাছ খুঁজতে আজও নদী তীরের মানুষেরা জলাশয়ে নামে। বৈশাখ মাসে কাদার মধ্যে খুঁজে ফেরে সেই মাছ। মাঝনদীতে জেলেদের জালে বিপন্ন ও বিলুপ্ত মাছের কিছু কালেভদ্রে ধরা পড়ে। উত্তরাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র যমুনা বাঙালী নদীর মাছের স্বাদই আলাদা। কখনও নৌকায় লতা পাতাসহ গাছের ডাল ভরে রাতভর ডুবিয়ে রেখে পরদিন তুলে নানা জাতের মাছ মেলে। হাঁটু পানিতে পলো দিয়ে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। অনেক সময় পলোইয়ের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাছ বের করার সময় বাইম মাছ মনে করে ঢোঁড়া সাপও উঠে আসে। বড় মাছের তরকারির চেয়ে ছোট মাছের চর্চরির স্বাদই মজার। এক মৎস্যজীবী জানালেন চিংড়ি মাছকে মাছ বলা হয় ঠিকই তবে তা পানির পোকা। তবে কাঁকড়া মাছের শ্রেণীভুক্ত। বর্তমানে কাদাজলে পাওয়া যায় কাঁকড়া। যা মাছ হিসেবে রান্না হয় তারকা চিহ্নিত হোটেলে। গায়ে নানা রঙের ডোরাকাটা মাছ দেখে কে যে কখন বউ মাছ নাম দিয়েছে, তা আজও সে বউ মাছ হয়েই আছে। ছেলেবেলায় এই মাছ খাওয়ার জন্য ভাইবোনে যে কত বাকবিত-া হয়েছে, যা দেখে মা বেকায়দায় পড়ে যেতেন। ভাতে মাছে বাঙালীর খাদ্য তালিকা থেকে প্রিয় খাবার মাছ কখনও ফুরাবে না। মৎস্য বিভাগ একটি খুশির খবর দিয়েছে তা হলো- বিপন্ন অবলুপ্তির পথে মিঠা বা স্বাদু পানির ৫৪ প্রজাতির মাছের মধ্যে উন্মুক্ত ও মৌসুমী জলাশয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে ৩২ প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সরপুটি, কৈ, গুজি, বাইম, পুটি, গোলসা, বউ, চেলা, বাল্যে, ফলি, পাবদা, কানছ (শিং), মাগুর, ভ্যাদা মাছ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে। ট্যাংরা, খোকশা, কালাবাটা, ঢেলা, মওয়া, লটা, শোল, বাইম, চান্দা, তিলপুটি, ফলই, কালবাউশ, গুইজা, একঠোটা ঘাউরা ইত্যাদি মাছের অনেক জাত আর নেই। এই মাছগুলোই কাদাজলের মধ্যে থেকেছে। বড় মাছ রুই কাতলা পাঙ্গাস বোয়াল মৃগেল আইড় চিতল গজার বাঘইর মাছ নদীতে ও বড় জলাশয়েই মেলে। এর বাইরে একক প্রজাতির মাছের মধ্যে ইলিশের উৎপাদনের আলাদা হিসাব আছে। দেশে মাছের উৎপাদন বছরে ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। মিঠা পানির মাছের প্রজাতি ২৬০টি। সামুদ্রিক প্রজাতি ৪৭৫টি। স্বাদু পানির মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করা গেছে। বছরে প্রতিজনের জন্য মাছের চাহিদা ২১ দশমিক ৯০ কেজি করে। সেখানে বর্তমানে প্রতিজনে মিলছে ১৯ দশমিক ৩০ কেজি করে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×