ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বনাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বনাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

প্রায় চার শ’ বছর আগে ইংরেজ মহাকবি জন মিল্টন ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের কাছে প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন। এর পঞ্চাশ বছর পর প্রথমে ব্রিটেন এবং ইউরোপের কিছু দেশ, আরও প্রায় এক শ’ বছর পর আমেরিকার সংবিধানে সংবাদপত্র তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। আমেরিকা দাবি করে মুক্ত বিশ্বচেতনার জন্মদাতা তারা, আমেরিকার মতো সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে নেই। ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড’-এর পিতা আমেরিকায়ও কমিউনিস্ট পার্টিকে কাজ করতে হয় গোপনে, কমিউনিস্টদের মুখপত্রও প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় গোপনে। আমাদের মতো সংবাদপত্রের ‘নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা’র দেশে ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমেরিকার তুলনায় বেশি। তারপরও গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বলতে কোথাও কিছু নেই। আমেরিকা বা পশ্চিমের দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে গণমাধ্যমসহ রাজনৈতিক ও ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো। বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতি ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অগ্রাহ্য করে একে ইসলামবিরোধী কুফরি মতবাদ আখ্যা দিয়ে এসব মতের অনুসারীদের হত্যার ফতোয়া দেয়ার স্বাধীনতা বাংলাদেশে রয়েছে। ২০০১ সালে হাইকোর্টে বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ফতোয়াকে অবৈধ বলে এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছিলেন। এই রায়ের জন্য ফতোয়াবাজ আমিনীদের দল এই দুই বিচারপতিকে হত্যার ফতোয়া দিয়েছিল। এটাও বাংলাদেশে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’র অন্তর্গত। অন্যদিকে বাংলাদেশে কেউ যদি ধর্মের বিরুদ্ধে, নাস্তিকতার পক্ষে, লিঙ্গীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে বা সমকামিতার পক্ষে মতপ্রকাশ করে, মৌলবাদীরা তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে হত্যার জন্য জঙ্গী কর্মীদের উৎসাহিত করে হত্যাও করা হয়। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে নীরব থাকে, কখনও ঘাতকদের পক্ষ অবলম্বন করে সরকারের তরফ থেকে কথিত নাস্তিকদের বাড়াবাড়ি না করার জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে অহরহ ফতোয়া দিয়ে নারী নির্যাতনের জন্য কাউকে শাস্তি পেতে হয়েছে এমন তথ্য গণমাধ্যমে চোখে পড়েনি। জামায়াতে ইসলামী এবং সমচরিত্রের অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনের নেতারা ওয়াজ মাহফিলের নামে অহরহ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও ইহুদীদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কদর্য ভাষায় ঘৃণা ছড়াচ্ছে। দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও এ কারণে বাংলাদেশে কাউকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। যে কারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে। অমুসলিমদের হত্যা, নির্যাতন ও লাঞ্ছনা মুসলিম মৌলবাদী ঘাতকদের ‘ঈমানী দায়িত্বে’ পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তারতম্য সর্বকালে সর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান। পশ্চিমে উদারনৈতিকতা সত্ত্বেও গণমাধ্যম যে স্বাধীনতা উপভোগ করে তা যেমন পুঁজির মনোপলির কারণে নিরঙ্কুশ নয়, একইভাবে বহু ক্ষেত্রে প্রাচ্যের ধর্মীয় এবং সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক রক্ষণশীলতা স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এক অর্থে মালিকের স্বাধীনতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বড় পুঁজির মালিকরা গণমাধ্যমে বিনিয়োগ শুরু করলেন তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিত্ত ও ক্ষমতার বিস্তার। মালিকরা সম্পাদক হয়েছেন, রাজনৈতিক দলের নেতা ও ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন এবং আর্থিক সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন। অনেক মালিক সরাসরি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্টির তালিকায় রাখেন আর্থিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য। কর্মরত সাংবাদিক যত জাঁদরেলই হোন না কেন অন্তিমে মালিকের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার স্বাধীনতা তার থাকে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চেয়ে দায়বদ্ধতার বিষয়টি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যা পশ্চিমা ধারণার অন্তর্গত নয়। গণমাধ্যমÑ আরও নির্দিষ্টভাবে বললে গণমাধ্যম কর্মীদের দায়বদ্ধতা এখনও সংজ্ঞায়িত হয়নি। এই দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও দেশকালভেদে তারতম্য ঘটে। তবে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার কিছু সাধারণ বোধ সর্বকালে মান্য করা হয়েছে। সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ বললে বিষয়টি বিমূর্ত থেকে যায়। গণমাধ্যমকে দায়বদ্ধ থাকতে হয় রাষ্ট্র-ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তা-লিঙ্গ-বিত্ত-ভাষা-অঞ্চল-বিশ্বাস নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার প্রতি। স্বাধীনতার চেয়ে দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রটি অনেক বড়। আমার স্বাধীনতা সীমিত হয়ে যায় অন্যের অধিকারের সীমানা থেকে। অন্যের অধিকার রক্ষাও আমার দায়বদ্ধতার অন্তর্গত। মানবিকতার মর্যাদা ক্ষুণœ করবার স্বাধীনতা কারও থাকতে পারে না। একইভাবে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ তার পক্ষাবলম্বন করাও স্বাধীনতার অংশ হতে পারে না। বাংলাদেশে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বার বার আলোচনায় এসেছে এবং আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছেÑ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ অস্বীকার বা লঘু করবার প্রবণতা কখনও অনুমোদন করা যায় না। যে সব দেশ ও জাতি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তারা জানে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষার সংগ্রাম অনেক দীর্ঘ, জটিল ও কষ্টসাধ্য। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে মুক্তিযুদ্ধে অভূতপূর্ব বিজয়ের পরও এই দেশটি অধিকাংশ সময় শাসিত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং পাঁচ লক্ষাধিক নারীর চরম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী তাঁর সহযোগীদের। ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের চলমান বিচার বন্ধ করে যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার উদ্দেশ্যেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল এবং ঘাতকদের বিচার বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়েছিল। এ ধরনের হত্যা ও ইনডেমনিটি কোন সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না, যদিও আমাদের সর্বোচ্চ আদালত তখন অবৈধ ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডকেও বৈধতা দিয়েছিল। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের রাজনীতি ও সমাজে শুধু পুনর্বাসিতই করা হয়নি, এসব অপরাধ অস্বীকার অথবা হালকাভাবে দেখার বোধ সচেতনভাবে মানুষের মনোজগতে প্রোথিত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণাপত্র’। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী কী কারণে কোন্্ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে তাদের ঘোষণাপত্রে সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক দিক নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। এই ঘোষণাপত্রের কারণেই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কোন গৃহযুদ্ধ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ না হয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা লাভ করেছে। এই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম বৈধতা পেয়েছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ১৯৭২-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই সরকারের সকল কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের ভিন্নপাঠ কিংবা একটি বাক্য, শব্দ বা দাড়ি-কমা পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই, যা সংবিধানের ক্ষেত্রেও থাকে। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অস্বীকার করবার অর্থ হচ্ছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে ফিরিয়ে নেয়া, যা গণমাধ্যমে সচেতন বা অচেতনভাবে অহরহ করা হচ্ছে। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘হলোকস্ট’ অস্বীকার করা যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার অথবা বিতর্কিত করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিত এবং এ কারণেই আমরা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে বার বার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের হলোকস্ট অস্বীকার আইনের আদলে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছি। সমগ্র বিশ্বে মানবাধিকারের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত ফ্রান্স যখন ১৯৯০ সালে হলোকস্ট অস্বীকার ও অবজ্ঞাকারীদের শাস্তির জন্য আইন প্রণয়ন করে, তখন এ নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে যথেষ্ট আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছিল। নোয়াম চমস্কির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীও ভলতেয়ারের দেশে এই আইনকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ ও কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (বাকী অংশ আগামীকাল)
×