ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খুরশীদ আলম পাটওয়ারী

শিল্পী কনকচাঁপার প্রদর্শনী ॥ দ্বিধার দোলাচল

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২২ এপ্রিল ২০১৬

শিল্পী কনকচাঁপার প্রদর্শনী ॥ দ্বিধার দোলাচল

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।’ প্রকৃত অর্থেই মানব জীবনের এই জানাশোনার বসতি, লেনাদেনা শেষ হয় না মৃত্যু অবধি। জীবনের বাঁকে বাঁকে মানুষ নতুন নতুন প্রকাশের বারতা নিয়ে হাজির হয়। সৃষ্টির প্রকাশ হবেই তা যে কোন মাধ্যমেই হোক না কেন। শিল্পী কনকচাঁপার সুরেলা কণ্ঠে অবগাহন করেনি এমন সঙ্গীতপিপাসুর দেখা পাওয়া ভার। কিন্তু সেই কনকচাঁপাই যখন রংতুলির পসরা নিয়ে উপস্থাপিত হন তখন নতুন মনোযোগ দাবি করে। সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় ‘দ্বিধার দোলাচল’ শীর্ষক একক চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন শিল্পী কনকচাঁপা। প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ব্রোশিওরে শিল্পী নিজেই লিখেছেন চিত্রকলায় অঙ্কুরোদগামের কথা- ‘জন্ম নিয়ে অক্ষরজ্ঞান হওয়ার আগেই পরিচিত হয়েছি বাবার অত্যাশ্চর্য সুরেলা কণ্ঠের গান, অবিরাম আঁকিবুঁকি আর মা’র কুরআন পড়ার কারুকার্যময় কান্নার সঙ্গে। বাবার কলমের টান ছিল অপূর্ব লীলাময়, চলন্ত। বাবা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। আমিও ক খ লিখার চাইতে প্রদীপের শিখা আঁকতে বেশি আনন্দিত বোধ করতাম। ...সারা জীবন বাবার, ওস্তাদের এবং স্বামীর শেখানো বুলি তোতাপাখির মতো গেয়ে গেয়ে এই বেলা একটু আঁকতে ইচ্ছে হলো। যে ইচ্ছেটা শীতের অলস ভোরের মতো কাঁথামুড়ি দিয়ে লুকিয়ে ছিল আর রঙের তরল ভরা সূর্যটা উচ্চস্পর্ধা নিয়ে ডাকছিল। শিল্পী কনকচাঁপা তার প্রদর্শনীর শুরুতেই বাবার আঁকা ছবি রেখেছেন। ছিমছাম একটি আবহে উপস্থাপিত হয়েছে খড়ের গাদা, কুঁড়েঘর, ছাতামাথায় জনৈক বয়েজ্যেষ্ঠ, আর অনতি দূরে গ্রামীণ লোকালয়ের পাশ দিয়ে বহমান জলাশয়। কনকচাঁপা বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে ছবি সৃজন করলেও মূলত প্রকৃতির নানা রূপ, প্রকাশ, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, আনন্দের হোলিখেলা, দ্বিধাবিভক্ত প্রহর, ফুল, গাছ, কাঁটা ঋতু বৈচিত্র্য, পাখি, আবহমান বাংলার নান্দনিকতা তাঁর ক্যানভাসে উঠিয়ে এনেছেন। তাঁর ‘সুঁই সুতোর কাব্য’ শীর্ষক অনেকগুলো ছবিতে বাংলার চিরায়ত নকশীকাঁথার উপকরণ, গাছ, পাখি, ফুলদানি, প্রজাপতি, গ্রামীণ জনপদ উপস্থাপিত হয়েছে। ‘স্থানান্তর’ সিরিজে শিল্পী নানারকম পাতা, শিরা, উপশিরা, কোলাজ করা বিভিন্ন ফর্মের আশ্রয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ‘সেগুনের গল্প’ শীর্ষক আরেকটি ছবিতে বৃক্ষের জীবনচক্র নিয়ে এসেছেন তিনি। অর্থাৎ উদ্ভিদ বিজ্ঞানের বছরওয়ারী এক একটি এ্যানুয়াল রিং গাছের বয়স নির্ণায়ক ধারণা এখানে সৃজনশীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকৃতি তথা জীববিজ্ঞানের প্রতি শিল্পীর ভিন্ন মনোযোগের স্মারক এই ছবিগুলো। শিল্পী কনকচাঁপার অধিকাংশ ছবিই বাস্তবধর্মী এবং বর্ণনাত্মক। ছবি আঁকার ইতিহাস থেকে জানা যায় সর্বোত্তম বর্ণনারই আরেক নাম চিত্ররচনা। বহু মহান চিত্রকলাই বর্ণনাত্মকÑ বিষয়বস্তুর বৈভব থেকে আহরিত হয় সপ্রাণতা । প্রদর্শনীর অধিকাংশ ছবি মূলত উজ্জ্বল রঙের আধিক্যপুষ্ট। মৌলিক রংগুলোর পাশাপাশি নানারকম রঙের মিশেলে ব্যবহৃত হয়েছে অন্যান্য উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল রংও। ফলে প্রদর্শনীতে বসন্তকালের রূপ আর রং বৈচিত্র্যের আভাস মেলে। শিল্পী কনকচাঁপা স্বশিক্ষিত। নিজের জবানিতেই তিনি উল্লেখ করেছেনÑ আমার আঁকা ছবিগুলোতে নেই কোন গ্রামার, নেই কোন শিক্ষা। তবুও হৃদয়ের একান্ত রক্তক্ষরণ থেকেই আঁকিবুঁকি। কনকচাঁপার প্রথম এই চিত্রপ্রদর্শনী তাঁর সুপ্ত স্বপ্নের উজ্জীবন। এই প্রচেষ্টা তিনি অব্যাহত রাখবেন এই কামনা করি।
×