ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : মার্ক টোয়াইন ;###;ভাষান্তর- কাজী আখতারউদ্দিন

পলিটিক্যাল ইকোনমি

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২২ এপ্রিল ২০১৬

পলিটিক্যাল ইকোনমি

একটি ভাল সরকারের ভিত্তি হচ্ছে অর্থশাস্ত্র- পলিটিক্যাল ইকোনমি। সর্বকালের সকল জ্ঞানী ব্যক্তি- [এখানে আমার চিন্তায় একটু ব্যাঘাত ঘটলো, নিচে দরজায় একজন অপরিচিত লোক আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। পলিটিক্যাল ইকোনমি বিষয়ের যে ধারণাটি তখন আমার মগজে টগবগিয়ে ফেটে পড়ছিল, আপ্রাণ চেষ্টা করে তাতে কষে লাগাম টেনে রাখলাম, যাতে ধারণাটা আমার কাছ থেকে ছুটে না যায়। তারপর লোকটির সাথে দেখা করে বিষয়টা কি জানার জন্য নিচে গেলাম। তবে মনে মনে কামনা করছিলাম লোকটি যেন একটি গমভর্তি নৌকার নিচে খালের পানিতে ডুবে যায়। চরম উত্তেজনায় তখন আমার প্রায় জ¦র এসে গেছে, অথচ তাকে দেখা গেল বেশ ঠা-া মেজাজেই রয়েছে। প্রথমে সে আমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো। তারপর বললো, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে লক্ষ্য করলো যে, বজ্রপাত ঠেকাবার জন্য আমার হয়তো কিছু বজ্র-নিরোধক রড প্রয়োজন হতে পারে। আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে বলুন, এর জন্য কি করতে হবে?’ সে বললো, তেমন কিছু করতে হবে না, সে শুধু রডটা আমার বাড়িতে লাগিয়ে দেবে। সারাজীবন হোটেল আর বোর্ডিং হাউসে কাটিয়েছি, বাড়িঘরের ব্যাপারে তাই আমাকে একেবারে নবিস বলা চলে। এধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে তেমন লোকদের মতোই অপরিচিতদের কাছে আমি সবসময় নিজেকে একজন পুরোনো বাড়িওয়ালা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করি। কাজেই বেশ একটু নির্লিপ্তভাব দেখিয়ে তাকে বললাম যে, বেশ কিছু দিন ধরেই আমি ছয়টা বা আটটা বজ্র-নিরোধক রড ছাদে লাগাবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু একথা শুনে লোকটি একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু আমি বেশ শান্ত চেহারা নিয়ে রইলাম। ভাবলাম, অসতর্ক হয়ে যদি কোন ভুল বলেও থাকি, তাহলে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে হয়তো সে আমার ভুলটা ধরতে পারবে না। লোকটি বললো যে, শহরের অন্যান্য লোকের চেয়ে সে বরং আমার পছন্দমতোই কাজ করবে। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে’, তারপর আবার আমার সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরতেই সে পেছন থেকে ডেকে বললো, ঠিক কতগুলো পয়েন্টে আমি এটা লাগাতে চাই, বাড়ির কোন কোন জায়গায় লাগাতে হবে আর কি ধরনের রড আমার পছন্দ এগুলো তার জানা দরকার। বাড়িঘরের জরুরী প্রয়োজন সম্পর্কে ওয়াকেফহাল নয়, এমন একজন লোকের কাছে এটা একটা স্বল্পক্ষণস্থায়ী কিন্তু অসুখকর অভিজ্ঞতা, তবে আমি বেশ প্রশংসনীয়ভাবে কথা চালিয়ে গেলাম। খুব সম্ভব সে বোধহয় বুঝতে পারেনি যে, এ ব্যাপারে আমি একেবারে নবীন। আমি তাকে ছাদের আটটি ‘পয়েন্টে’ রডগুলো লাগাতে বললাম আর সবচেয়ে ভাল রডটি ব্যবহার করতে বললাম। সে জানালো যে, ‘সাধারণ’ মানের রড প্রতি ফুট ২০ সেন্ট; ‘তামা’ ২৫ সেন্ট; ‘দস্তার-প্রলেপ দেয়া পেঁচানো’ রড ৩০ সেন্ট দামে দিতে পারবে। তবে যেকোন সময়ে আর যেখানেই বাজ পড়ুক না কেন এই পেঁচানো রডটি তা ঠেকাতে পারবে। আর এই রডটি ‘বিদ্যুতের চমকটিকে প্রতিরোধ করবে এবং একে আর সামনে বাড়তে দেবে না।’ আমি বললাম পেঁচানোটাই আমার পছন্দ আর সেই জিনিসই যেন সে ব্যবহার করে। সে বললো এ কাজে দুই শ’ পঞ্চাশ ফুট হলেই চলবে। তবে সঠিক কাজটি বা এই শহরের সেরা কাজ, ছোটবড় সবাই প্রশংসা আকর্ষণ করে তেমন একটি কাজ, আর যা দেখে সবাই ভাববে এজন্মে তারা এরকম সুন্দর আর যুক্তিতর্কের সূচনাবিন্দুরূপে উপস্থাপিত বজ্ররক্ষী-রড দেখেনি- এধরনের একটি কাজ করতে হলে চার শ’ ফুটের কমে হবে বলে মনে হয় না। তবে সে নির্দয় নয় আর তার বিশ^াস কাজটা সে ভালভাবেই করার চেষ্টা করবে। আমি বললাম ঠিক আছে চার শ’ই লাগাও আর তুমি যেরকম ভাল মনে কর সেভাবেই কর, তবে আমাকে আমার কাজে ফিরে যেতে দাও। অবশেষে তার কাছ থেকে ছাড়া পেলাম; আর এখন আধঘণ্টা ধরে আমার পলিটিক্যাল ইকোনমির চিন্তার ট্রেনকে আবার জোড়া লাগিয়ে আমি আবার নতুন করে ভাবনা শুরু করলাম।] তাঁদের মেধার সর্বোত্তম সম্পদ, জীবনের অভিজ্ঞতা আর শিক্ষা দিয়ে এ বিষয়ে বিশেষ জোর দিয়েছেন। বাণিজ্যিক আইন-বিজ্ঞানের আলো, আন্তর্জাতিক ধর্মীয় ভ্রাতৃসঙ্ঘ এবং সব বয়সীদের জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত ভেদাভেদ, সকল সভ্যতা ও জাতি এবং জরাথ্রুস্ট থেকে শুরু করে হোরেস গ্রিলি পর্যন্ত, সবাই- [এখানে আবার আমি বাধা পেলাম এবং আবার আমাকে বজ্র-নিরোধক রড বিক্রেতার সাথে আলোচনা করতে হবে। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দ্রুত নিচে ছুটে চললাম আর মনে এমন সব বিশাল চিন্তা তরঙ্গের মতো কল্লোলিত হতে লাগলো যে ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে, প্রতিটি অক্ষর একটির পর একটি প্রকাশ করতে পনেরো মিনিট লাগবে। আর যখন আবার তার মুখোমুখি হলাম- তাকে বেশ শান্ত এবং মনোহর মনে হলো; অথচ এদিকে আমি কি ভীষণ উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হয়ে আছি। এক পা রজনীগন্ধার চারা আর আরেক পা ভায়োলেট ফুলগাছের ঝোঁপের মাঝে রেখে সে রোডস দ্বীপের এপোলোদেবতার বিশাল মূর্তির মতো ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুই হাত কোমরে, মাথার টুপির কিনারা সামনের দিকে উল্টো করে, এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখ দিয়ে আমার বাড়ির সবচেয়ে বড় চিমনিটির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললো, ‘এখন একটি রাজকীয় বস্তু দেখা যাচ্ছে, যা একজন মানুষকে বেঁচে থাকার আনন্দ যোগায়।’ তারপর আবার বললো, ‘আপনি কি এমন ছবির মতো সুন্দর আর কোন চিমনি দেখেছেন, যাতে আটটি বজ্র-নিরোধক রড লাগানো আছে?’ আমি বললাম, এমুহূর্তে তেমন কিছু আমার মনে পড়ছে না। সে বললো, একমাত্র নায়াগ্রা জলপ্রপাত ছাড়া এর চেয়ে সুন্দর আর কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য এই পৃথিবীতে আর নেই। তবে আমার বাড়িকে পুরোপুরি চোখ ধাঁধানো করতে হলে এখন কেবল দরকার, অন্য চিমনিগুলোতে সামান্য একটু প্রলেপ দেয়া। ব্যস আর এরপর যা হবে তা একেবারে মাৎ করে দেবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কি এসব কথা বলা কোন্ বই থেকে শিখেছে আর সেই বইটি আমি কোথায় পেতে পারি? সে স্মিত হেসে বললো যে, এভাবে কথা বলাটা কোন বইয়ে শেখানো হয় না। আর বজ্রপাতের সাথে পরিচয় হয়েছে এমন লোকই কেবল কোন ধরনের অনিষ্ট ও শান্তির ঝুঁকির ব্যতিরেকে তার কথা বলার স্টাইলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। তারপর সে একটু হিসাব করে জানালো যে, ছাদের বিভিন্ন জায়গায় আরও আটটি রড ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাগালে আমার জন্য ভাল হবে। আর এতে আনুমানিক পাঁচ শ’ ফুট উপকরণে কাজ হবে। তারপর আরও বললো, প্রথম আটটা কেবল শুরু করতে লেগেছে। আর তার হিসাবের চেয়ে প্রায় এক শ’ ফুট উপকরণ বেশি লেগেছে। আমি বললাম আমার ভীষণ তাড়া আছে আর আমার ইচ্ছা হচ্ছিল এ বিষয়টার স্থায়ীভাবে একটা সমাধা করার, যাতে আমি আবার আমার কাজে ফিরে যেতে পারি। সে বললো, ‘আমি ইচ্ছা করলে ওই পাঁচটা রড লাগিয়েই চলে যেতে পারতাম- যা অনেকেই করতো। কিন্তু না, আমি নিজেকে বললাম, এ মানুষটি আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত আর আমি মরে গেলেও তার সাথে অন্যায় করতে পারবো না। এ বাড়িতে যথেষ্ট পরিমাণে বজ্র-নিরোধক রড নেই, আর সে কারণে আমার যা যা করার দরকার তা না করা পর্যন্ত আমি আমার পথ থেকে বিচ্যুত হব না। আর হয়তো বলতাম, হে অপরিচিত মানুষ, আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে; যদি আকাশ থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গকারী ও অম্লজান শূন্য দেবদূত আপনার বাড়ির ওপর আঘাত-’ আমি বললাম, ‘থামো, থামো, শোন। আরও আটটা আর পাঁচ শ’ ফুট পেঁচানো রড লাগাও, যা দরকার সব কর; তবে দয়া করে শান্ত হও আর তোমার অনুভূতিকে এমন জায়গায় প্রকাশ কর, যেখানে অভিধানসহ পৌঁছতে পার। ইতোমধ্যে যদি আমরা পরস্পরকে বুঝে নিয়ে থাকি, তাহলে আমি আমার কাজে ফিরে যাই।’ আমার মনে হলো আমি এখানে পুরো এক ঘণ্টা বসে ভেবে ভেবে, যে জায়গায় আমার চিন্তার সূত্রটা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, সেখানে ফিরে যেতে চেষ্টা করছিলাম। তবে আমার বিশ^াস শেষপর্যন্ত সেখানে পৌঁছতে পেরে আবার সামনে এগিয়ে যেতে পারবো।] এ বিশাল বিষয়টি নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। আর এদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তারা এ বিষয়টিকে একটি সুযোগ্য প্রতিপক্ষ মনে করেন। মহান কনফুসিয়াস বলেছেন যে, একজন পুলিশ প্রধান হওয়ার চেয়ে তিনি বরং একজন জ্ঞানবান অর্থশাস্ত্রবিদ হওয়াটাই শ্রেয়তর মনে করেন। সিসেরো প্রায়ই বলতেন যে, মানুষের মন যেসব বিষয়ের ওপর আধিপত্য করতে পারে তার মধ্যে অর্থশাস্ত্রেই সর্বাধিক পূর্ণতা দান করতে পারে। আর এমনকি আমাদের গ্রিলিও জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, পলিটিক্যাল- [এখানে আবার বজ্র-নিরোধক রডওয়ালা খবর পাঠালো। আমি প্রায় অধৈর্য হয়ে নিচে গেলাম। সে বললো, আমাকে এভাবে আবার বিরক্ত করার বদলে সে বরং মরে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু যখন সে একটা কাজ হাতে নিয়েছে, তখন আশা করে যে কাজটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং দক্ষকর্মীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে করা হোক। তারপর যখন এটা শেষ হলো আর বেশ ক্লান্ত হয়ে সে একটু আরাম করতে যাবে, তখন উপরের দিকে একঝলক তাকিয়ে দেখলো তার হিসাবে একটু সামান্য এদিক-ওদিক হয়ে গেছে। আর যদি এখন বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টি হয় তখন অন্তত ষোলটা বজ্র-নিরোধক রড লাগবে, নাহলে এই বাড়িটিকে কোনভাবেই রক্ষা করা যাবে না, বিশেষত যখন সে এই বাড়িটির ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী- আমি চিৎকার করে বললাম, ‘শান্তি, শান্তি! এক শ’ পঞ্চাশটা লাগাও! কয়েকটা রান্নাঘরে আর বারোটা গোয়ালঘরে লাগাও! গরুর উপর দুটো! পাচকের উপর একটা!-সমস্ত জায়গায় এমনভাবে ছড়িয়ে দাও, যাতে এটাকে দেখতে একটা দস্তা দিয়ে মোড়ানো, পেঁচানো, রুপাবাঁধানো বেতের ঝাড় মনে হয়! যাও! হাতে যত জিনিসপত্র পাও সব ব্যবহার কর আর বিজলি নিরোধক রড শেষ হয়ে গেলে র‌্যাম-রড, ক্যাম-রড, সিঁড়ির রড, পিস্টন রড যা পাও তাই দিয়ে একটি কৃত্রিম দৃশ্য তৈরি করার তোমার নিরস অভিরুচিকে পরিপূর্ণ কর। আর আমার উন্মক্ত মস্তিষ্ককে একটু অবসর দাও আর বুকের ক্ষততে একটু শান্তি দাও!’ সম্পূর্ণ নির্বিকার হয়ে সুমিষ্ট হেসে এই লৌহ হৃদয় মানবটি শুধু তার হাতের ব্যান্ডটা সুন্দরভাবে ঘুরিয়ে বললো যে, তাকে এখন নিজেকে খাটাবার কাজে যেতে হবে। এটা প্রায় তিন ঘণ্টা আগের কথা। তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই পলিটিক্যাল ইকোনমির মতো মহৎ বিষয়টি নিয়ে আর লেখার মতো আমার মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে কি-না। তবে আরেকবার চেষ্টা করার ইচ্ছা আমি ছেড়ে দিতে পারি না, কারণ এটিই একমাত্র বিষয় যা আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি আর এ পৃথিবীর সমস্ত দর্শনের মাঝে এটিই আমার মস্তিষ্কের সবচেয়ে প্রিয়।] ইকোনমি হচ্ছে বিধাতার কাছ থেকে মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ আর্শীবাদ। যখন উচ্ছৃঙ্খল তবে মেধাবী বায়রন ভেনিসে নির্বাসিত দিন কাটাচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেন যে, যদি তাকে আবার ভুলভাবে কাটানো দিনগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়, তবে তিনি মত্ত অবস্থা ব্যতীত অন্যান্য প্রাঞ্জল সময়গুলোতে অসার পদ্য রচনার পরিবর্তে বরং অর্থশাস্ত্র রচনায় সময় কাটাতেন। ওয়াশিংটন এই সূক্ষ্ম বিজ্ঞানটি পছন্দ করতেন; এর সাথে বেকার, বেকউইথ, জাডসন এবং স্মিথ চিরস্থায়ীভাবে সংযুক্ত হয়ে আছেন; এবং এমনকি মহান হোমারও ইলিয়ডের নবম পুস্তকে বলেছেন : ফিয়াট জাস্টিটিয়া, রুয়াট কোয়েলাম, পোস্টমর্টেম উনুম এনটে বেলাম, হিক জাকেট হক, এক্স-পার্টে রেস, পলিটিকাম এ-কোনমি এস্ট -আকাশ যদি ভেঙ্গেও পড়ে, ন্যায়বিচার হতেই হবে যুদ্ধের আগে একটি মৃত্যুর পর, তারা শুধু একজন হয়ে এক সাথে যায়, অর্থাৎ পলিটিক্যাল ইকোনমি। প্রাচীন এই কবির এ ধারণাটির মহিমা এবং সেই সাথে যে ধরনের সুনির্বাচিত শব্দাবলী এবং উচ্চতম ও মহত্তম শ্রেণীর চিত্রকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা এ কবিতার স্তবকটিকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে তুলেছে আর আগের চেয়ে আরও মহিমান্বিত করেছেÑ [‘এখন আর একটি কথাও শুনতে চাই নাÑ একটি শব্দও নয়। শুধু বল কত খরচ হয়েছে আর তারপর চিরদিনের জন্য এ বিষয়ে একেবারে নীরবতা অবলম্বন কর। কত বললে? নয় শ’ ডলার? ব্যাস এই্? এই্ চেক নাও, এটা আমেরিকার যেকোন নামকরা ব্যাংক গ্রহণ করবে। আচ্ছা বাইরে রাস্তায় এত লোকজনের ভিড় কেন? কি বললে? আমার বাড়িতে লাগান বজ্র-নিরোধক রডগুলো দেখছে? ধন্য হলো আমার জীবন, ওরা কি বজ্র-নিরোধক রড জীবনে কখনও দেখেনি? একটি মাত্র বাড়ির সামনে এত মানুষের ভিড় আমি কখনও দেখিনি। ঠিক আছে নিচে গিয়ে এখন আমি মূর্খতার উচ্ছ্বাসটি দেখতে যাচ্ছি’] তিন দিন পরÑ আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কেননা শক্ত ছোট লোমের মতো খাড়া হয়ে ওঠা রডে আবৃত আমাদের বাড়িটা এখন শহরের একমাত্র আলোচ্য বিষয় এবং বিস্ময়কর একটি বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। থিয়েটারগুলো ক্রমশ নির্জীব ও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, কেননা তাদের চরম খুশির নাটকীয় সৃষ্টিগুলোও আমার বাড়ির বিজলি-নিরোধক রডের তুলনায় অত্যন্ত নির্জীব ও সাধারণ মনে হচ্ছিল। বাড়ির সামনের রাস্তাটি দিন-রাত দর্শকের ভিড়ে বন্ধ হয়ে রয়েছে। আর এদের মধ্যে অনেকে গ্রাম থেকেও এসেছিল। তারপর দ্বিতীয় দিন যেন আশীর্বাদস্বরূপ বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হতেই বিজলীগুলো আমার বাড়ির ওপর ‘আক্রমণ করলো’। ঐতিহাসিক জোসেফাস এভাবেই অদ্ভুত কিন্তু আকর্ষিকভাবে কথাটি বলেছিলেন। সাথে সাথে গ্যালারি দর্শকশূন্য হয়ে পড়লো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ির আশপাশের আধা মাইলের মধ্যে আর কোন দর্শক রইল না; তবে সেই দূরত্বের সমস্ত উঁচু বাড়ির জানালা, ছাদ আর অন্যান্য সবজায়গায় মানুষজনের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অবশ্য হওয়ারই কথা, কেননা পড়ন্ত তারা আর এক প্রজন্মের চতুর্থ জুলাইয়ের আতশবাজি একসাথে মিলে আকাশ থেকে একপশলা বৃষ্টির মতো একযোগে একটি নিঃসহায় ছাদের উপর অঝোর ধারে পড়তে থাকায় ঝড়ের অন্ধকারে আমার বাড়িটিকে একটি চমৎকার দর্শনীয় বস্তু করে তোলায় ওরা একটি আতশবাজির প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পেয়েছিল। তবে প্রকৃত হিসাবে চল্লিশ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ির উপর সাত শ’ চৌষট্টি বার বজ্রচমক আঘাত হেনেছিল। তবে প্রত্যেকবার বিশ^স্ত কোন একটি রডে বিচ্যুত হয়ে বা হোঁচট খেয়ে পেঁচানো রড বেয়ে মাটিতে চলে গিয়েছিল। তবে নিচে নেমে যাওয়ার আগে এটি হয়তো অবাক হয়ে গিয়েছিল এ ব্যবস্থা দেখে। আর এতবার বজ্রপাতের পরও ছাদের একটি মাত্র স্লেট পাথরের ফলক খুলে পড়ে গিয়েছিল। আর তাও হয়েছিল কেননা, শুধু একবারের জন্য হয়তো রডগুলো যতটুকু সম্ভব বিদ্যুত গ্রহণ করে নিচে পাঠাবার চেষ্টা করেছিল। পৃথিবীর শুরু থেকে এধরনের ঘটনা আর কখনও দেখা যায়নি। পুরো একটি দিন আর একটি রাত আমার পরিবারের একজনও জানালা দিয়ে মাথা বের করতে পারেনি, কারণ কেউ মাথা বের করলেই তার সমস্ত চুল একঝটকা মেরে তুলে নিয়ে একটি বিলিয়ার্ড বলের মতো মসৃণ করে দিচ্ছিল। আর পাঠক বিশ^াস করুন, আমরা কেউই একবারও বাইরে বের হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে একসময় এই ভয়ানক অবরোধ অবশেষে শেষ হলো, কারণ আমার চির-অতৃপ্ত রডগুলোর আওতার মধ্যে আঁকড়ে ধরার মতো আর বিদ্যুত উপরের মেঘে অবশিষ্ট ছিল না। তারপর আমি এক ছুটে বের হয়ে কিছু সাহসী শ্রমিক যোগাড় করলাম আর পুরো বাড়ি থেকে ভয়ঙ্কর এ রণসজ্জাগুলো খুলে না ফেলা পর্যন্ত আমরা কেউই একবিন্দু দানা মুখে দিলাম না কিংবা একটুও বিশ্রাম নিলাম না। শুধু তিনটা রড রেখে দেয়া হলো। একটি বড় ঘরের উপর, একটা রান্নাঘর আর আরেকটা গোয়াল ঘরের উপর থাকলো। আর ওই যে দেখুন, আজও এগুলো আছে। আর তার আগপর্যন্ত লোকজন আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় আসতে সাহস করেনি। তবে যেতে যেতে এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই, সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে আমি অর্থশাস্ত্র প্রণয়ন নিয়ে আর কাজ করিনি। এমনকি এখনও আমার স্থায়ু আর মস্তিষ্ক এ কাজ আবার শুরু করার মতো যথেষ্ট স্থির হয়নি। যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য বিশেষ বিজ্ঞপ্তি- তিন হাজার দুই শ’ এগারো ফুট সর্বোচ্চ গুণসম্পন্ন দস্তা দিয়ে মোড়ানো পেঁচানো বিজলী নিরোধক রড এবং এক হাজার ছয় শ’ একত্রিশটির ডগা রুপা দিয়ে মোড়ানো- সব মেরামতযোগ্য (যদিও অতি ব্যবহারে একটু ক্ষয়ে গেছে, তবে সাধারণ যেকোন জরুরী অবস্থায় সমানভাবে ব্যবহারযোগ্য) মজুদ আছে। যাদের প্রয়োজন তারা প্রকাশকের ঠিকানায় যোগাযোগ করে দাম জেনে নিতে পারেন।
×