ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় কুমার রায়

ইতিহাস ঐতিহ্য-মোড়া ভ্রমণসাহিত্যৎ

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২২ এপ্রিল ২০১৬

ইতিহাস ঐতিহ্য-মোড়া ভ্রমণসাহিত্যৎ

ভ্রমণসাহিত্যভিত্তিক বই ‘দেখি বাংলার মুখ’ পাঠান্তে মুগ্ধ হলাম। ভাসলাম নিমগ্নতার স্রোতে। বাক্যের সুনিপুণ গঠন ও শৈলী মনকে তুমুলভাবে নাড়া দিল। শফিক হাসানের প্রথম ভ্রমণ চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকায় আসার গল্প। লেখাটির শিরোনাম ‘তূর্ণা নিশিথায় নিশিযাপন’। প্রতিটি লেখার নামকরণের নান্দনিকতা অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। উপর্যুক্ত লেখায় উল্লেখ করেছেন মানুষের ধৈর্যশক্তি ও আত্মবিশ্বাস সরকারী অব্যবস্থাপনার কাছে কীভাবে অসহায় হয়ে পড়ে। লিখেছেন- ট্রেনের টিকেট নেই কিন্তু ট্রেনের টিটি একজন যাত্রীকে টিকেট দেবেন বলে কাউন্টারের পেছনে নিয়ে গেলেন। পিছু পিছু লেখকও গেলেন। ঘটনাচক্রে দেখা গেল দুইটার বেশি টিকেট টিটি দিতে পারলেন না। তারপর টিটি একটা বগিতে অনেক যাত্রীকে তুললেন দর কষাকষি করে। এ রকম অভিজ্ঞতা আমার জীবনেও ঘটেছে- টিটি ও ট্রেনের পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি অনায়াসে। তখন এতোকিছু বুঝতাম না। ঘুরে বেড়ানোটাই জীবনের একটা অধ্যায় হয়ে উঠেছিল। টিটিদের এ রকম দুর্নীতিতে ট্রেন পরিবহন কেন ক্ষতিগ্রস্ত ও লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে না লেখক প্রশ্ন রেখেছেন। শুধু তাই নয়, ট্রেনে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মাদক চোরাচালান যায় টিটিদের সহযোগিতায় তা কার না জানা আছে। তবুও এসব অপরাধী পার পেয়ে যায় অনায়াসে। শফিক হাসান নিখুঁতভাবে গল্পের ঢঙে করে গেছেন একেক অঞ্চলের অসাধারণ বর্ণনা। মাঝে মাঝে মনে হয় কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোন ভ্রমণকাহিনী পড়ছি। প্রয়াত বন্ধুবর জাহিদের প্ররোচনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইটি পড়েছিলাম। পড়ে মনে হয়েছিল ভ্রমণ আসলে একজন সাহিত্যপ্রেমীর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারপর থেকে ভ্রমণবই সময় পেলেই পড়ি। শফিক হাসানের পর্যটক পরিচয় সম্বন্ধে জানতাম কিন্তু তিনি যে এতো ভাল ভ্রমণসাহিত্য রচনা করতে পারেন বইটি না পড়লে, স্বাদ-আস্বাদ গ্রহণ না করলে উপলব্ধি করতে পারতাম না। শফিক হাসান অসাধ্যকে সাধন করেছেন, মাঝে মাঝে একটু বেশিই করে ফেলেছেন; তা মোটেও ঠিক করেননি। তবুও বলতে পারি মাঝে মাঝে লেখকরা আন্দোলিত আবেগকে ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। শুধু শফিক হাসান কেন, এ রকম অনেক লেখক আছেন যাদের লেখনী অসাধারণ কিন্তু আবেগকে এমনভাবে ঢেলে দিয়েছেন যা দৃষ্টিকটু। শফিক হাসান ‘কেওক্রাডং চূড়ায়’ লেখাটিতে বান্দরবানের রুমা থানার সজীব দাশের রান্না ও তার পরিবারের বর্ণনা, ঘরবাড়ির চিত্র, গাইড লেলুং খুমির বাবা-মা ও তাদের জমিজমার সমস্যার কথা, হিরণ¥য় হিমাংশু তালুকদারের নানা বগিজগির কথা একটু বেশিই দিয়েছেন। এর চেয়ে বরং প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির বর্ণনা আরো সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারতেন। এছাড়া কিছু লেখায় এমন সমস্যা লক্ষ করা যায়। তবে বেশ ভাল লাগল তার ভ্রমণসঙ্গী লেখক ও অধ্যাপক ড. মাসুদুল হকের নানা রঙ্গ-রসিকতার বর্ণনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কতজন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেনÑ ইয়ত্তা নেই। সেখানে শফিক হাসান অনন্যতার পরিচয় দিয়েছেন। লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন একালের মহান পুরুষদের একজন নিবেদিতপ্রাণ এমপি ছোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন মহোদয়ের কথা। যিনি অর্থসম্পদের প্রতি লালায়িত না হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অম্লান করে রাখতে গড়ে তুলেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য জাদুঘর’। এভাবে ধারাবাহিকভাবে ‘শেকড়ের সন্ধানে মুজিবনগরে’ লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য জাদুঘর ও এমপি মহোদয়ের নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়। শফিক হাসানের ভ্রমণাসহিত্যের মাধ্যমে পাঠক শুধু ইতিহাসই জানতে পারবে না, পাবে অনাবিল আনন্দের স্বাদ। দেখি বাংলার মুখ শফিক হাসান প্রকাশক : পারিজাত প্রকাশনী প্রচ্ছদ : জাবেদ ইমন মূল্য : ১৫০ টাকা
×