ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

ঘুরে এলাম ঐতিহাসিক নন্দীগ্রাম

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ২২ এপ্রিল ২০১৬

ঘুরে এলাম ঐতিহাসিক নন্দীগ্রাম

খ্রিস্টীয় ষোডশ শতকেও নন্দীগ্রাম ছিল সমুদ্রের তলায়। ওই সময় নন্দীগ্রামের নাম ছিল গুমগড়। ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে চর, জঙ্গল সৃষ্টি হয়। পরে সেই জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে মানুষ। কিন্তু ঠিক কবে থেকে মানুষের বাসোপযোগী হয়ে উঠল নন্দীগ্রাম, সে ইতিহাস পাওয়া যায় না। যা কিছু ইতিহাস পাওয়া গিয়েছে এ অঞ্চলের তা মুঘল আমল থেকে। ওড়িয়া ভাষায় লেখা ‘চৌধুরী চরিত’ থেকে জানা যায় গুমগড়ের রাজা নন্দীগোপাল রায় চৌধুরীর নাম অনুসারে পরে এই এলাকার নাম হয় নন্দীগ্রামের। ‘চৌধুরী চরিত’ অনুযায়ী সপ্তদশ শতকে হিজলিতে তাজ খাঁ নামে একজন রাজা ছিলেন। তার কর্মচারী ছিলেন ব্রজগোপাল রায় চৌধুরী। মহিষাদলের রাজার সঙ্গে তাজ খাঁর সন্ধি হলে শর্ত অনুযায়ী গুমগড় পরগনাটি তাজ খাঁর হাতে তুলে দেন মহিষাদলের রাজা। পরে ব্রজগোপালের কর্মদক্ষতায় খুশি হয়ে তাজ খাঁ তাকেই রাজা উপাধি দিয়ে গুমগড় পরগনা দান করেন। সম্পর্কে ব্রজগোপাল মহিষাদলের রাজা কল্যাণ রায় চৌধুরীর আত্মীয়। এই ব্রজগোপাল রায় চৌধুরীর ছেলেই নন্দীগোপাল রায় চৌধুরী। নন্দীগ্রাম থানার তাজপুর গ্রামে দ্বারকানাথ ম-লের বাড়ি থেকে ওড়িয়া ভাষায় লেখা তালপাতার একটি পুঁথি পাওয়া যায়। সেই পুঁথিতে গুমগড়ের চৌধুরী রাজবংশের উপাখ্যান রয়েছে। রয়েছে নন্দীগ্রামের নামকরণের বিষয়টি ‘আপন নামে নন্দীগ্রাম/দ্বিতীয় গড় রানীর নাম/লগ্নামনি সে ভেটুরাতে/কাশী স্থানই তৃতীয়তে/গড়িল গড়কাশী নামে/সে যে ঘোলপুকুর গ্রামে।’ অর্থাৎ, নিজের নামে নন্দীগ্রাম, রানীর নামে ভেটুরাতে লগ্নামনিগড় এবং ঘোলপুকুরে গড়কাশী নির্মাণ করেন রাজা নন্দীগোপাল। এই নন্দীগ্রাম শুধু এখন ভারতবর্ষের একটি নাম নয় বরং বিশ্বমানচিত্রের একটি আলোচিত ও আমোদিত নাম। এই নাম নন্দীগ্রামকে লড়াকু মানসিকতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি আর ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করার জন্য। পশ্চিম বাংলার পূর্বমেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম আজ শুধু আন্দোলন-সংগ্রামের আঁতুরঘরই নয় শিক্ষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যের পদপীঠও বটে। এই অঞ্চলে ১০৪ বছর আগে শিক্ষা নিকেতন গড়ে তোলেন দানবীর ব্রজমোহন তিয়াড়ি। তার সঙ্গে সহযোগিতা করেন ফকির চাঁদ দাস (বাং ১২৩১-১৩০৩ বাং)। ব্রজমোহন তিয়াড়ির (১৮৩৬-১৯৪১) নামেই ১৯১২ সাল স্থাপিত হয় বিএমটি শিক্ষা নিকেতন। তিনি অত্রাঞ্চলের শিক্ষা সংস্কারকওই ছিলেন না, ছিলেন মহৎ মানুষ। এলাকার মানুষের উন্নয়নে তিনি অনেক জমি দান করেছিলেন। তার নামে এই নন্দীগ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ব্রজেমোহন তিয়াড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এ কলকাতার পুটিয়ারীতেও একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাদূত হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা পুরো পশ্চিম বাংলায় শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। শুধু শিক্ষা নয় সাহিত্য-সংস্কৃতি খেলাধুলায়ও এ অঞ্চলের ব্যাপক ইতিহাস রয়েছে। নন্দীগ্রাম ডগলাস ক্লাবের অনেক খেলোয়াড় মোহনবাগান, মোহামেডানে খেলেছে। মজার ব্যাপার এখানে বঙ্গবন্ধুর নামে রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্পোর্টিং ক্লাব। আর বহু পুরনো উদয়ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতো এ অঞ্চলের সংস্কৃতির সারস্বত ঋত্বিক। মূলত নন্দীগ্রাম যাওয়া আমাদের বইমেলাকে কেন্দ্র করে। ব্রজমোহন তিয়াড়ি শিক্ষা নিকেতন প্রাঙ্গণে ৪ মার্চ থেকে ১০ মার্চ ৭ দিনবাপী ‘মেধাবী মানুষের সন্ধানে’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য সেøাগানে তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিতব্য বইমেলায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি পরিষদের ৫ জন সদস্য আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। লক্ষ্য দুই বাংলার সংস্কৃতি সেতুর স্বারবত সাধনার অয়ষ্কান্ত ব্রতের ঋত্বিক হওয়ার প্রত্যয়ে মননশীল চেতনাকে জাগ্রত করার মানসে এ সংস্কৃতি সফর। নন্দীগ্রামবাসী বইমেলার ৩ মাস পূর্বেই নন্দীগ্রাম উৎসব নামে একটি সার্বজনীন উৎসব করে থাকেন সেটিও তৃতীয়বারের মতো হয়ে গেছে। এ উৎসবে ‘পলিমাটি’ নামে একটি সৃজনশীল পত্রিকা প্রকাশ করে এলাকার লেখকদের প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি নানা নান্দনিক বিয়ের চর্চাক্ষেত্রও উন্মীলন করেন। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ এলাকার হিন্দু-মুসলিম দারুণ সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সহাবস্থানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকল অনুষ্ঠান সফল করে ইতিহাস গড়ে যাচ্ছেন। নন্দীগ্রাম বইমেলাতে ‘উড়াল’ শিরোনামে একটি স্মরণিকাও নিয়মিতভাবে বের করে সৃষ্টিজ সৌকর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। ৪ মার্চ’ শুক্রবার বিকেলে নন্দীগ্রাম বইমেলার প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত কবি পিনাকী ঠাকুর। উদ্বোধন করার কথা ছিল তমলুক সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর কিন্তু নির্বাচন ঘোষণা হওয়ায় তাঁর আর আসেননি। কাঁথি সাংসদ শিশির অধিকারী ও নন্দীগ্রাম বিধায়ক শহীদ মাতা ফিরোজা বিবিও আসেননি একই কারণে। তবে নন্দীগ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শেখ আবু তাহের একেবারে শেষের দিকে এসেছিলেন। (চলবে)
×