ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পান্থ আফজাল

অপরাজিতারাই বাংলাদেশের নারী অগ্রযাত্রার প্রতীক

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২২ এপ্রিল ২০১৬

অপরাজিতারাই বাংলাদেশের নারী অগ্রযাত্রার প্রতীক

বিশ্বের প্রতিটি দেশের মতো বাংলাদেশেও নারীর ক্ষমতায়ন, অগ্রযাত্রা কিংবা জাগরণ একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, প্রাসঙ্গিক বিষয়। সমাজের অধাংশ নারী এবং নারীকে অবদমন কিংবা নানাবিধ শৃঙ্খলে আটকে রাখলে সমাজ কখনও সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে যাবে না। সুতরাং নারীর অধিকার, স্বাধীনতা এবং তার মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সবধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া অনিবার্য। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমরা প্রত্যক্ষ করি শুধু শিক্ষিত কিংবা আধুনিক মেয়েরাই নয়, অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া, গ্রামে-গঞ্জের মেয়েরাও জীবিকার তাড়নায় ক্ষুদ্রতর ঘরের গ-ি পেরিয়ে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। লেখাপড়া শিখে সম্মানজনক পেশায় নিজেদের নারীরা যেমন সম্পৃক্ত করছে অপরদিকে নিরক্ষর, অশিক্ষিত নারীরাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে বাঁচার তাগিদে, কাজের খোঁজে। তার ক্ষমতা এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে যে কোন ধরনের কাজ করতে নারীরা আর পেছনের দিকে না তাকিয়ে সমানে এগিয়ে যাচ্ছে। এদেরই একজন শিল্পী। বাড়ি তার ময়মনসিংহের এক অজপাড়াগাঁয়ে সেখান থেকে সে যাত্রা শুরু করে ঢাকা অভিমুখে। যান্ত্রিক যানবাহনের যুগে ঢাকা ময়মনসিংহের দূরত্ব উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই নয়। তবু শিল্পী যখন তার পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে অজানা পথে পা বাড়ায় সেটা সত্যিই এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। তার নিজস্ব জীবনযাত্রায় গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মেয়েদের মতো নয়। ঘর থেকে বের হয়ে আসাটাও এক অকল্পনীয়, দুঃসহ যন্ত্রণার ক্ষতবিক্ষত দলিল। তারপরেও তারা নিজেদের সীমবদ্ধ গ-িতে আর আটকে রাখতে রাজি নয়, কাজের সন্ধানে, স্বাবলম্বী হওয়ার তাকিদে আজ তারা প্রত্যয়ী, দৃঢ়চিত্র। এ বোধেই তাদের নিয়ে আসে একস্থান থেকে আরেক জায়গায়। যে কোন কাজ পেলেই তারা খুশি গ্রাম থেকে শহরে আসা এসব মেয়েরা হয়ত বা কোন সচ্ছল পরিবারে গৃহকর্র্মীর কাজ নেয় নতুবা পোশাকশিল্প কারখানায় তাদের গতি হয়। এ লক্ষ্য নিয়ে শিল্পীর মতো অসহায় নারীরা যখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন কিংবা প্রতিজ্ঞা নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে, তাকে কি আমরা নারী জাগরণের অন্যতম একটি সূচক হিসেবে ধরতে পারি না? শিল্পীর মতো মেয়েরা কি এই অগ্রযাত্রার প্রতিনিধি নয়? নব্বই এর দশকে পোশাকশিল্প কারখানার অভ্যুদয় বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের কর্মে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হলেও নারীজাগরণের ঐতিহাসিক ভিত্তি আরও আগের। বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে বেগম সুফিয়া কামালের মতো সৃজনশীল মহীয়সী নারীরা আমাদের সত্যিকারের প্রতিনিধি হলেও নারীর সহজ চলার পথ সবসময়ই কঠিন ছিল। তারপরও নারীরা লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়েছে। বিভিন্ন পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পীকার, কৃষিমন্ত্রীর পদই শুধু অলঙ্কতৃ করেনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদেও নিজেদের জায়গা মজবুত করেছে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে আরম্ভ করে পুলিশের উল্লেখযোগ্য পদও আজ মেয়েরা নিজেদের যোগ্যতায় অর্জন করেছে। অর্থাৎ মেয়েরা আজ পুরুষের সমান তালে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিক জনসংখ্যার তুলনায় এসব মেয়ের সংখ্যা হাতে গোানর মতো। বৃহত্তর নারী সমাজ আজও পেছনে পড়ে আছে। মুষ্টিমেয় হলেও নারীর ক্ষমতায়নের পথ তৈরি হয়েছে, নিজেকে যোগ্য প্রমাণের সুযোগ সৃষ্টি হলেও অধিকাংশ নারী এখনও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। নিপীড়িত, দুস্থ, অসহায় সিংহভাগ নারীর প্রতিনিধিই হচ্ছে শিল্পীর মতো মেয়েরা। রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে শিল্পীর মতো মেয়েরাই নিজেদের স্বনির্ভর করার তাগিদে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অজানার পথে পা বাড়ায়। কতখানি ঝুঁকি তাদের নিতে হয় প্রতি দিনের জীবন সংগ্রামে। তারপরেও তারা থামে না। তাদের ন্যায্য মজুরিও তারা পায় না। তবুও নিরলসভাবে প্রতিদিনের যুদ্ধে তারা জয়ী হতে চায়, মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, কোলের সন্তানটিকে নিজের মতো করে মানুষ করতে চায়। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের একটা বড় অংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে। এ শিল্পের সিংহভাগই নারী শ্রমিক। যারা শিল্পীর মতো প্রতিনিয়তই শ্রম দিয়ে যাচ্ছে স্বামী-সন্তান নিয়ে নিজেকে বাঁচানোর কর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আত্মশক্তিতে শুধু নিজেরাই জেগে ওঠেনি সংসারেরও হাল ধরছে, দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। শিল্পীর মতো পোশাকশিল্প কারখানার নারী শ্রমিকরাই নারী স্বাধীনতার অদম্য সৈনিক। নারীর অধিকার আদায়ের সোচ্চার প্রতিনিধি হিসেবেও তাদের মূল্যায়ন করতেই পারি। ছবি : সারু মডেল : লিপন ও পারু
×