ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশী চাপে পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২২ এপ্রিল ২০১৬

বিদেশী চাপে পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা বাড়ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রায় চারবছর আগে এক সকালে বিকট শব্দে ধসে পড়ে সাততলা বিশিষ্ট রানা প্লাজা। ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক বের করে আনা হচ্ছিল শ্রমিকদের মৃতদেহ। মরদেহ গণনা যেন শেষই হচ্ছিল না। দু’সপ্তাহের উদ্ধার অভিযানে শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৪ জনে। এই ঘটনা শিল্প মালিকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে শ্রমিক নিরাপত্তাকে তারা কতটা অগ্রাহ্য করে। কিন্তু এই তিন বছরে পরিস্থিতি কতটা বদলেছে? ঢাকার কাছে আশুলিয়ায় কর্মরত কয়েকজন শ্রমিককে জিজ্ঞেস করলে আব্দুল হাকিম নামের একজন শ্রমিক বলেন, আগের চেয়ে এখন নিয়ম-কানুন ভাল হইছে। নিরাপত্তাটা বাড়ছে। তিনি জানালেন, কারখানার জরুরী নির্গমন পথ এখন সবসময় পরিষ্কার রাখা হয়, যাতে অগ্নিকা- হলে শ্রমিকরা দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারে। আরেকজন শ্রমিক জেসমিন আক্তার জানালেন, তিনি যে কারখানায় কাজ করেন সেখানে মাসে কয়েকবার অগ্নি নির্বাপনী মহড়া হয়। সূত্র জানায়, শ্রমিকরা আজ যে পরিবর্তনের কথা বলছেন, সেটি এমনিতেই আসেনি। প্রায় সাড়ে এগারোশো শ্রমিকের মৃতদেহ সে পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। গত তিন বছরে নানা উদ্যোগ, নানা চাপের মাধ্যমে এর সূচনা হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর তৈরি পোশাক খাতের নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়। কাজের নিরাপদ পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি সবাই বুঝতে পেরেছে শতশত শ্রমিকের প্রাণহানির বিনিময়ে। তৈরি পোশাক খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনা মালিকদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সবাই বুঝতে পেরেছে শ্রমিকের নিরাপত্তা সবার আগে। রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো নিরাপদ করার উদ্যোগ শুরু হয়। এই উদ্যোগ আসে প্রথমে বিদেশীদের দিক থেকে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক এবং মানবাধিকার সংগঠনের চাপে পড়ে এই উদ্যোগে শামিল হয় ইউরোপ এবং আমেরিকার ক্রেতারা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারও সম্পৃক্ত হয় এই উদ্যোগে। সাড়ে তিন হাজার তৈরি পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত কারার কার্যক্রম শুরু হয়। এই কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ভবন কতটা নিরাপদ সেটি পরীক্ষা করা। পাশাপাশি কারখানার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ঝুঁকি মুক্ত করা এবং অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করা। কিন্তু গত তিন বছরে এসবের ফলাফল কী হয়েছে? ইউরোপিয়ান ক্রেতাদের উদ্যোগে গঠিত হয় এ্যাকর্ড অন ফায়ার এ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েজ। তারা প্রায় ১৭০০ কারখানা পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, তিন বছর আগের তুলনায় পোশাক কারখানা এখন অনেক নিরাপদ। নিরাপত্তার জন্যে ন্যূনতম যে বিষয়গুলো দরকার সেগুলো মাথায় রেখেই কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছি। ভবনগুলোর নিরাপত্তা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। নিরাপত্তার শর্ত পূরণ করতে না পারায় ৩০টির বেশি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেসব কারখানা বন্ধ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কিছু কারখানা স্থানান্তর করা হচ্ছে। পরিদর্শনের পর কারখানাগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ বিষয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলছেন যাতে সংস্কার কাজ যেন দ্রুত শেষ হয় সেদিকে তারা নজর রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি শ্রম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আল্লাহর ওপর ভরসা করে বলতে পারি, বাংলাদেশে রানা প্লাজার মতো দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনা ঘটবে না। রানাপ্লাজা ধসের পরে যে বিষয়টি সমালোচনায় এসেছিল তা হচ্ছে পর্যাপ্তসংখ্যক কারখানা পরিদর্শক ছিল না। প্রায় চার হাজারের মতো কারখানা থাকলেও নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য পরিদর্শক ছিল অল্প কিছু। অভিযোগ ছিল কার্যত কোন পরিদর্শন ব্যবস্থা কাজ করত না। এ বিষয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক জানান, কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদফতরে এখনও পর্যন্ত ৩৫০ জন পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে পরিদর্শকের সংখ্যা ৫৫০ জনে উন্নীত করা হবে। নিরাপত্তার প্রশ্নে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তার সবটাই এসেছে বিদেশীদের চাপে। এসব সংস্কার শুরু করতেও কিছু-কিছু মালিক নানা টালবাহানা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, মালিকরা যতটা না নিজে এগিয়ে এসেছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে বিদেশী ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য। তবে যেভাবেই হোক খানিকটা হলেও পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা দেখতে চাই মালিক করতেছে। সে কতখানি চাপে করতেছে আর কতখানি নিজের ইচ্ছায় করেছে, সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় না। যেসব কারখানা পরিদর্শন হয়েছে সেগুলো বিজিএমইএ’র তালিকাভুক্ত। এর বাইেরও আরও কিছু ছোটখাটো কারখানা রয়েছে পরিদর্শনের বাইরে। ইউরোপীয় ক্রেতাদের উদ্যোগ এ্যাকর্ডের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েজ বলছেন যেসব কারখানাগুলো বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করছে সেগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। তিনি বলছেন, এখনও অনেক কারখানা সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি। কিন্তু এ কাজ তাদের করতেই হবে।
×