ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফিলিপিন্স আইনী প্রক্রিয়ায় রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত দেবে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২২ এপ্রিল ২০১৬

ফিলিপিন্স আইনী প্রক্রিয়ায় রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত দেবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ফিলিপিন্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট তৃতীয় এ্যাকুইনো ক্ষমতা ছাড়ছেন আগামী ৩০ জুন। হাতে থাকা ওই দুই মাস সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া রিজার্ভের জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার আশা প্রকাশ করছে দেশটির সিনেট কমিটি। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি করা অর্থ ফেরত প্রদানে আইনী সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে ফিলিপিন্স সরকার। বৃহস্পতিবার দেশটির প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এ আইনী সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যাংক এ্যাকাউন্টের লেনদেন ২০ দিনের জন্য স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে ফিলিপিন্সের একটি আদালত। তবে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশকে ওই অর্থের আনুষ্ঠানিক মালিকানা দাবি করতে হবে এবং দীর্ঘ একটি আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলে জানিয়েছে ফিলিপিন্সের এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল। এজন্য বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ ফেরত আনতে দুই দেশের আইনগত বিষয় পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স। বৃহস্পতিবার প্রথবারের মতো বৈঠকে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তা প্রকাশ করা হবে বলে আবারও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগে আগামী ৩০ জুনের মধ্যেই ‘উদ্ধারযোগ্য’ সব টাকা ফেরত দেয়ার আশা প্রকাশ করেছেন ফিলিপিন্সের সিনেটের প্রেসিডেন্ট প্রো টেম্পোরে রাল্ফ রেক্টো। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ফিলিপিন্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এ্যাকুইনো আগামী ৩০ জুন ক্ষমতা ছাড়ছেন। ওই বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, এটা আমাদের জাতীয় সময়সীমা হওয়া উচিত। প্রেসিডেন্ট এ্যাকুইনো ব্যক্তিগত জীবনে যাওয়ার আগে আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে যে, চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে যেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব তা সঠিক মালিকের কাছে ফেরত গেছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আট কোটি ডলার চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যাংক এ্যাকাউন্টের লেনদেন ২০ দিনের জন্য স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে ফিলিপিন্সের একটি আদালত। দেশটির ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং এরই মধ্যে যে অর্থ দেশটির মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ কাউন্সিলকে ফেরত দিয়েছেন তার একাংশও আদালতের সম্পদ জব্দের এ আদেশের আওতায় রয়েছে বলে বৃহস্পতিবার দেশটির গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। এছাড়া ফিলিপিন্স ন্যাশনাল ব্যাংকে (পিএনবি) অংয়ের ৪ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন পেসোর এ্যাকাউন্ট, একই ব্যাংকে ক্যাসিনো অপারেটর ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি লিমিটেডের ৫ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন পেসোর এ্যাকাউন্ট এবং রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে (আরসিবিসি) ব্যবসায়ী উইলিয়াম গোর নামে থাকা ১৯ হাজার ৯৮৩ পেসোর এ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফিলিপিন্সের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ কাউন্সিল এএমএলসি কিম অং, ইস্টার্ন হাওয়াই ও গোর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা করার পর সোমবার সম্পদ জব্দের এ আদেশ দেয় আদালত। আগামী ২ মে এ বিষয়ে শুনানির দিন রাখা হয়েছে। অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য ওই মামলায় বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে পক্ষ হয়ে অর্থের মালিকানা দাবি করতে হবে বলে ফিলিপিন্সের ডেইলি ইনকোয়ারারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অন্যথায় এ অর্থ ফিলিপিন্সের সরকারী সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হবে বলে এতে বলা হয়। তবে ফিলিপিন্সের ফাইন্যান্স কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে আদালতে দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের কথা ভাবছেন না এবং বাংলাদেশকে অর্থ ফেরতে কেউ আপত্তি করবে না বলে আশার কথা বলছে ইনকোয়ারার। এক্ষেত্রে কিম অংয়ের স্বেচ্ছায় অর্থ ফেরত দেয়ার কথাও উঠে এসেছে। হাতিয়ে নেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলারের একটা অংশ হাতে আসার কথা স্বীকার করেছেন কিম অং। তবে চুরি করে ওই অর্থ নেয়ার বিষয়টি তার জানা ছিল না বলে দাবি করেছেন তিনি। ফিলিপিন্সের সিনেটে শুনানিতে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কাম সিন অং ওরফে কিম অং ফিলিপিন্সের সিনেটে শুনানিতে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কাম সিন অং ওরফে কিম অং এই ক্যাসিনো জাঙ্কেট এজেন্টের কাছ থেকে এরই মধ্যে তিন দফায় মোট ৯৮ লাখ ডলার ফেরত এসেছে বলে ফিলিপিন্সের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। কিম অংয়ের পক্ষ থেকে গত ৩১ মার্চ ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং ৪ এপ্রিল আট লাখ ৩০ হাজার ৫৯৫ ডলার এএমএলসির তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য দেয়া হয়। পরে গত সোমবার তার কোম্পানি ইস্টার্ন হাওয়াইয়ের পক্ষ থেকে আরও ২০০ মিলিয়ন পেসো (প্রায় ৪৩ লাখ ডলার) দেয়া হয়েছে। প্রথম দুই দফায় তার ফেরত দেয়া অর্থ কর্তৃপক্ষকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে বলেছে আদালত। অংয়ের আরও আড়াই শ’ মিলিয়ন পেসো ফেরত দেয়ার কথা রয়েছে। অংয়ের ভাষ্যমতে, বেজিংয়ের শুহুয়া গাও এবং ম্যাকাওয়ের ডিং জিজের নামে দুজন জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশের ওই অর্থ ফিলিপিন্সে নিয়েছিলেন। ‘ডিং গ্রুপ’র ১০৭ মিলিয়ন পেসোর একটি এ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে ম্যানিলার সোলাইরি রিসোর্ট এ্যান্ড ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে ওই গ্রুপের জুয়াড়িদের কক্ষ থেকে আরও ১ দশমিক ৩৪৭ মিলিয়ন পেসো জব্দ করে তারা। এই অর্থ ফেরত দিতে আদালতের আদেশের অপেক্ষায় আছে তারা। রিজার্ভের অর্থ ফিরিয়ে আনতে আইনগত বিষয় পর্যালোচনার উদ্যোগ টাস্কফোর্সের ॥ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করে ফিলিপিন্সে নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ ফেরত আনতে দুই দেশের আইনগত বিষয় পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মোঃ ইউনুসুর রহমান বৃহস্পতিবার এক সভার পর সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই প্রকাশÑ অর্থমন্ত্রী ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, বুধবার কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট জমা দিয়েছে। রিপোর্টটি আমি পড়িনি। রিপোর্ট বের হবে আফটার দ্য ফাইনালাইজেশন অব রিপোর্ট। বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে লাইলা টাওয়ারে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউসকুপার্সের (পিডব্লিউসি) বাংলাদেশ অফিস উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সাংবাদিকদের জানানো হবে। প্রসঙ্গত, তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বুধবার সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রীর কাছে অন্তর্বর্তীকালীন ওই প্রতিবেদন জমা দেন। ফরাসউদ্দিন কমিটির কার্যপরিধিতে এক মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন এবং ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সাইবার নিরাপত্তায় একগুচ্ছ সুপারিশ ॥ অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত রিপোর্টে আর্থিক খাতের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সাইবার সন্ত্রাস সারাবিশ্বে একটি বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ দেশের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কার করার সুপারিশ করার কথা বলা হয়েছে। দক্ষ জনবল গড়ে তোলাসহ প্রকৃত ও মেধাবীদের যথোপযুক্ত স্থানে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তহবিল সংরক্ষণে প্রযুক্তিগত বিশেষ করে আইটি সংক্রান্ত যেসব বিষয় রয়েছে তা আরও শক্তিশালী করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সব ধরনের ফাঁকফোকর বন্ধে নতুন করে তিনজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া তদন্ত রিপোর্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন কিভাবে ও কার বরাবর গেল, অবৈধ পরিশোধ ঠেকানোর লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের পর্যাপ্ততা, গোপন রাখার যৌক্তিকতা ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবহেলা ছিল কি-না এবং অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা, গৃহীত কার্যক্রমের পর্যাপ্ততা ও এ ধরনের পুনরাবৃত্তি রোধে গৃহীত ব্যবস্থা খতিয়ে দেখেছে অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত কমিটি। রিজার্ভ চুরিতে তিনটি চক্র জড়িত বলে মনে করছে সিনেট ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ ফিলিপিন্সে পাচার ও সাইবার হ্যাকিংয়ের পেছনে তিনটি চক্র রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির দুর্নীতিবিরোধী সিনেট ব্লু-রিবন কমিটির সিনেটর সার্জিও ওসমেনা। বৃহস্পতিবার ফিলিপিন্সের সংবাদমাধ্যমে ‘এবিএস সিবিএন’কে এসব কথা জানান তিনি। সার্জিও ওসমেনা বলেন, একটি চক্র বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোড চুরি করেছে। দ্বিতীয় চক্রটি সুইফট সিস্টেম হ্যাকিংয়ের কাজ করেছে। আর অপরটি এই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নিয়ে গেছে। আর এই তৃতীয় চক্রটির সঙ্গেই ফিলিপিনো নাগরিকরা জড়িত। আইনি সহায়তার আশ্বাস ফিলিপিন্স সরকারের ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি করা অর্থ ফেরত প্রদানে আইনী সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে ফিলিপিন্স সরকার। বৃহস্পতিবার দেশটির প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রিজার্ভ কেলেঙ্কারিতে চাকরি হারালেন আরসিবিসির আরেক কর্মকর্তা ॥ রিজার্ভ কেলেঙ্কারির ঘটনায় চাকরি হারিয়েছেন ফিলিপিন্সের আরেক ব্যাংকার। এ ঘটনায় রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কোষাধ্যক্ষ রাউল ভিক্টর ট্যান পদত্যাগ করেছেন বলে বৃহস্পতিবার ফিলিপিন্স স্টক এক্সচেঞ্জকে অবহিত করা হয়। তবে বুধবারই তিনি পদত্যাগ করেন বলে জানায় ফিলিপিন্সের পত্রিকা ‘দ্য এনকোয়ারার’।
×