ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তার অনুসারীরা ভিন্ন নামে সংগঠিত হয়ে ব্লগার হত্যা করছে ;###;আইএসের সঙ্গে এদের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ মেলেনি

নেপথ্যে মেজর জিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২২ এপ্রিল ২০১৬

নেপথ্যে মেজর জিয়া

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সেনাবাহিনীতে ক্যু করার পরিকল্পনা, ব্লগার হত্যা এবং বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা থাকার অপপ্রচার চালানো এক সূত্রে গাঁথা। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে সেনাবাহিনীতে ক্যুর চেষ্টাকারী বহুল আলোচিত মেজর জিয়াসহ বেশ কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। ব্লগার হত্যাকারীদের নেপথ্যের কারিগররাই বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা রয়েছে বলে প্রপাগা-া চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) তৎপরতা থাকার প্রমাণ মেলেনি। তবে কোন কোন জঙ্গী সংগঠনের তরফ থেকে আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আইএসের তরফ থেকে কোন সাড়া মেলেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, খেলাফত প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে আইএস সৃষ্টি করে পৃথিবীর অন্যতম একটি সুপার পাওয়ার। মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক ও সিরিয়ায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে দেশ দুটির কিছু অংশ দখল করে আইএস আলোচনায় আসে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ইউরোপের ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লন্ডনে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় আইএস। যে দেশ আইএসকে সৃষ্টি করেছে তাদের কারসাজিতেই দুনিয়াব্যাপী অপপ্রচার চলছে। এমন অপপ্রচারের ধারাবাহিকতায় আইএস বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ দূর প্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন দেখছে বলে বিভিন্ন সময় প্রকাশ করা হচ্ছে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৩ এপ্রিল আইএসের সাময়িকী হিসেবে পরিচিত ‘দাবিক’-এ একটি সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাতকারটি জঙ্গী গোষ্ঠীটির বাংলাদেশ শাখার কথিত প্রধান শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের বলে প্রচার করা হয়। সেই সাক্ষাতকারে বলা হয়েছে, ভূ-অবস্থানগত কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকেই আইএসের ঘাঁটি বানানোর জন্য তাদের পছন্দ। ওই ঘাঁটি থেকেই তারা ভারতে হামলা চালাতে চায়। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে চাপের মুখে থাকা জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা এখন আইএসে যোগ দিচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামীর কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ এক বিবৃতিতে জামায়াত নেতাকর্মীদের আইএসে যোগ দেয়ার তথ্যটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে দাবি করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আইএসের কথিত প্রধানের সাক্ষাতকার একটি পরিকল্পিত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশে আইএসের কোন অস্তিত্ব নেই। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্্রীর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। সেই সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। ক্যুর পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম মেজর জিয়া। বর্তমানে তিনি পলাতক। মেজর জিয়ার এমন পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে তিনি পুরোপুরি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তার পরামর্শে ও নির্দেশনায় হিযবুত তাহ্্রীরের অনেক সদস্য নতুন করে সংগঠিত হয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম দেয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৪-৫ জন করে সদস্য নিয়ে ছোট ছোট সিøপার সেল তৈরি করা হয়। সেই সব সিøপার সেল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের ওপর চড়াও হয়। তারা নির্মমভাবে হত্যা করা শুরু করে ব্লগারদের। ব্লগার হত্যার পর আগে কোন জঙ্গী সংগঠনের তরফ থেকে হত্যার দায় দায়িত্ব স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ধারাবাহিক অভিযানে বেশ কিছু জঙ্গী ধরা পড়ে। গ্রেফতারকৃতরা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি (জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ), হিযবুত তাহ্রীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তাদের অধিকাংশই আইএসের অনুসারী। গ্রেফতারকৃতরা আইএসের অনুসারী বলে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। তাতে দেশে আইএসের তৎপরতা থাকার তথ্য অনেকটা সুদৃঢ় হয়। যদিও এসব সংগঠনের তরফ থেকে আইএসের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে আইএস সাড়া দেয়নি। এমন সুযোগটিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর পাশাপাশি আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্লগারদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যাতে আইএস তাদের সঙ্গে যোগাযোগকারী জঙ্গী সংগঠনগুলোকে নানাভাবে বিশেষ করে আর্থিকভাবে ব্যাপক সহায়তা করে। আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ধারাবাহিকতায়ই ব্লগার হত্যার পরেই আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার আনসার আল ইসলাম বা আনসার আল ইসলাম-৭ বা ৮ বা বিভিন্ন নামে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে। এসব দায় স্বীকার করা হয়েছে আইএসের প্রচারের সঙ্গে জড়িত সাইট ইন্টেলিজেন্স নামের একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে। এই ওয়েব সাইটটিকে পরিকল্পিতভাবে এসব প্রপাগা-া চালানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করারও অভিযোগ রয়েছে। সাইটটির মালিক রিটা কাৎজের সঙ্গে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে যোগাযোগ করে সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু রিটা কাৎজের তরফ থেকে কোন সহযোগিতা করা হয়নি। ব্লগার হত্যার তদন্তকারী সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ও মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই এবং হত্যাকারীরা গ্রেফতারের বাইরে থাকইে মূলত ভিন্ন নামে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে। এমন অপপ্রচারের কারণে একদিকে বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা থাকার বিষয়টি প্রকাশ করা হচ্ছে, অপরদিকে মূল হত্যাকারীরা দিনের পর দিন আড়ালে থাকার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের আইএসের তৎপরতা থাকার অপপ্রচার শুরুর পর চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অন্তত ৫০ জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে ব্লগার হত্যা, আইএসের পক্ষে অপতৎপরতা চালানোসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তারা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযুবত তাহ্রীরসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য। গ্রেফতারকৃতরা নিজেদের আইএসের অনুসারী বলেও দাবি করেছেন। তবে তাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত তদন্তে ও জিজ্ঞাসাবাদে আইএসের যোগাযোগ থাকার কোন প্রমাণ মেলেনি। গ্রেফতারকৃতদের অনেকেই ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিকভাবে আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। তবে আইএসের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়ার তথ্য মেলেনি। ব্লগার হত্যার পর দায় স্বীকারের বিষয়ে তিনি বলেন, মূলত ব্লগার হত্যাকারীরাই নিজেদের গ্রেফতারের বাইরে রাখতে এবং দেশে আইএসের তৎপরতা থাকার অপপ্রচার চালাতেই দায় স্বীকার করছে। আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সিøপার সেল নির্মমভাবে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের হত্যা করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। তাতে ব্যর্থ হয়েই একটি গোষ্ঠী ব্লগার হত্যায় নামে। তারাই ব্লগারদের হত্যার পর দেশে আইএসের তৎপরতা রয়েছে বলে নানা অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়েদার কোন তৎপরতা নেই। এসবই প্রপাগা-া। তিনি আরও জানান, আইএসের বাংলাদেশ শাখার কথিত প্রধান শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত আইএসে যোগদানকারী হিসেবে ১৫ থেকে ২০ জন বাংলাদেশীর কথা জানা গেছে। এদের মধ্যে ৩ থেকে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যারা যোগ দিয়েছেন তারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে যোগ দেননি। তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিভিন্ন দেশের নাগরিক। যোগদানকারী বাংলাদেশীদের অধিকাংশই মালয়েশিয়া, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বসবাস করছিলেন। এর মধ্যে জাপান থেকে একজন তার স্ত্রী ও চার সন্তানসহ আইএসে যোগ দিয়েছেন। আইএসে যোগদানের চেষ্টাকারী ও আইএস থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসার চেষ্টাকারীদের সম্পর্কে বিমানবন্দরে বিশেষ বার্তা দেয়া আছে। যারা বাংলাদেশ থেকে ইরাক বা সিরিয়ায় যেতে আগ্রহী তাদের বয়সসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানাতে বলা হয়েছে। আর ইরাক ও সিরিয়া থেকে ফেরত আসা দেশী বা বিদেশীদের বিষয়েও একই রকম তথ্য এবং বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাৎক্ষণিক জানানোর সরকারী নির্দেশ রয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত কোন বাংলাদেশীর সিরিয়া বা ইরাকে যাওয়ার চেষ্টা করার তথ্য মেলেনি। এমনকি দেশ দুটি থেকে কারও আসারও তথ্য মেলেনি।
×