ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ত্রিশালের কালীরবাজার ও আহাম্মদবাদ গণহত্যা দিবস আজ

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২১ এপ্রিল ২০১৬

ত্রিশালের কালীরবাজার ও আহাম্মদবাদ গণহত্যা দিবস আজ

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ আজ ২১ এপ্রিল ময়মনসিংহের ত্রিশালের কালীরবাজার ও আহাম্মদবাদ গণহত্যা দিবস। একাত্তরের এই দিনে হানাদার পাকি সেনারা ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে স্থানীয় দালালদের সহায়তায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কেবল কালীরবাজারেই হত্যা করে প্রায় অর্ধশত নিরীহ বাঙালীকে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ময়মনসিংহ পতনের আগে মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ময়মনসিংহে এটিই ছিল প্রথম গণহত্যা। অথচ দিবসটি পালন নিয়ে নেই সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কোন কর্মসূচী। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছরেও সরকারী উদ্যোগে শনাক্ত হয়নি কালীরবাজার ও আহাম্মদবাদ বধ্যভূমি। নাম পরিচয়ের তালিকাও করা হয়নি শহীদদের। ব্যক্তি উদ্যোগে কালীরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ ১৮ জনের নাম সংবলিত একটি সাইনবোর্ড গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ শহীদ পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন ছিল বাংলা ১৩৭৮ সালের ৮ বৈশাখ, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল, রোজ বৃহস্পতিবার। একাত্তরের এই দিন সকাল ৮টার দিকে ঢাকা থেকে পাকসেনাদের নিয়ে একটি ট্রেন ময়মনসিংহ আসছিল। ট্রেন লক্ষ্য করে দূর থেকে গুলি ছুড়ে স্থানীয় জিন্নাহ ও পাখি। এমন অভিযোগে ত্রিশালের কালীরবাজারে পাকসেনারা ট্রেন থেকে নেমে কালীরবাজার ও জসিদ্ধর গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টানা ৬ ঘণ্টার পাকি তা-বে সেদিন কেবল কালীরবাজার ও জসিদ্ধরেই হত্যা করা হয়েছিল প্রায় অর্ধশত নিরীহ বাঙালীকে। লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করা হয় কালীরবাজারে। গণহত্যার শিকার বাঙালীদের ভালভাবে দাফনও করতে পারেনি সেদিন স্বজনরা। শেয়াল কুকুরে খেয়েছিল তাদের লাশ। পাকসেনারা যে কোন সময় আসতে পারে এমন খবরে পুরো ত্রিশালের মানুষ ছিল আতঙ্কিত। ট্রেন থেকে নেমে গ্রামের দিকে আসছে খবরে জসিদ্ধর গ্রামের সেদিনকার নববধূ মেহারুন নেছা (৫৮) শাশুড়িসহ বাড়ির অপর বৌ জা ননদের সঙ্গে পাশের ব্রহ্মপুত্র পাড়ের নৌকায় আশ্রয় নেন। পাকিদের হামলা থেকে বাঁচতে শ্বশুর হোসেন আলী ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন অপর গ্রামবাসীর সঙ্গে। মেহারুন জানায়, তার চোখের সামনেই শ্বশুর হোসেন আলীসহ আরও ৪ জনকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। শহীদ হোসেন আলীর পুত্র মোহাম্মদ আলী (৬৫) জানান, তিনি বাবাকে হত্যার দৃশ্য দেখেও এগিয়ে আসার সাহস পাননি। পাকসেনারা চলে গেলে সেদিন সন্ধ্যার পর হোসেন আলীকে পুরনো লুঙ্গি দিয়ে ঢেকে মাটি চাপা দেন ব্রহ্মপুত্র পাড়ে। শহীদ ধরণী চন্দ্র বর্মণের পুত্র অবণী চন্দ্র বর্মণ জানান, সময়মতো দাফন করতে না পারায় সেদিন অনেকের লাশ শেয়াল কুকুরে খেয়েছিল। শহীদ ধরণী চন্দ্র বর্মণের লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র নদে। এ দিন রাতে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে ওপারে চলে যান মেহারুন ও বাড়ির অপর নারীরা। কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে দেখেন সবকিছুই লুট হয়ে গেছে। জসিদ্ধরের শহীদ আব্দুল মান্নানের পুত্র সিদ্দিকের (৬০) দাবি, ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহ পতনের আগে ত্রিশালের কালীরবাজারে পাকসেনাদের এটিই ছিল প্রথম গণহত্যা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালামের ব্যক্তি উদ্যোগে জসিদ্ধর গ্রামে সেদিনের গণহত্যায় শহীদ ১৮ জনের নাম পরিচয়ের তালিকা প্রকাশ করে গাছের সঙ্গে একটি সাইনবোর্ড ঝুলানো হয়েছে। আবুল কালামের উদ্যোগে জসিদ্ধরের বধ্যভূমিটিও শনাক্ত করা হয়েছে। সাইনবোর্ডে থাকা ১৮ জন শহীদ হচ্ছেন-ধরণী চন্দ্র বর্মণ, নীরিশ চন্দ্র বর্মণ, সুরেশ চন্দ্র বর্মণ, রিয়াজ আলী, হোসেন আলী, আব্দুল মান্নান, হযরত আলী, কাছম আলী, জভেদ আলী, উষান, কাসেম, ছষ্টি বর্মণ, মতি সরকার, ময়না, মকবুল, মহর চন্দ্র বর্মণ, সুবাদ বর্মণ ও সাহেদ। কালীরবাজার ও জসিদ্ধর গণহত্যার পর ময়মনসিংহের পতন হলে পাকসেনারা ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রেস্ট হাউসে ঘাঁটি গাড়ে। ময়মনসিংহ শহরের এই ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকেই মূলত বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন চালায় পাকসেনারা। পরবর্তীতে ত্রিশালের কানীহারি গ্রামের আহাম্মদবাদ স্কুলে স্থানীয় মুসলিমলীগ নেতা, রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ক্যাম্প থেকেই ত্রিশালের নানা জায়গায় গণহত্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগসহ তা-ব চালানো হয়। কানীহারি গ্রামের সাবেক ইউপি মেম্বার আব্দুল আজিজ (১০১) জানান, ত্রিশালের তৎকালীন মুসলিমলীগ নেতা ও থানা শান্তি কমিটির সভাপতি আব্দুল খালেক সরকার ছিল মোনায়েম খানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সাবেক গবর্নর মোনায়েম খানের যাতায়াত ছিল ত্রিশালে। খালেক সরকারের নেতৃত্বেই সেদিন ত্রিশালে থানা শান্তি কমিটিতে সদস্য হয় মুসলিমলীগ নেতা গেদু চেয়ারম্যান, লতিফ চেয়ারম্যান ও রশিদ চেয়ারম্যান। শান্তি কমিটি নেতাদের উদ্যোগে পরে ত্রিশালের কানীহারি আহাম্মদবাদ স্কুলে টর্চার ক্যাম্প করা হয়। এই ক্যাম্পের প্রধান হর্তাকর্তা ছিল খালেক সরকারের পুত্র আনিসুর রহমান মানিক। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদ হামন, ইউনুছ আলী ইনু, আহমেদ আলী, নরেন্দ্র বাবু, মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী ও কালীরবাজারের মুক্তিযোদ্ধা রসুলসহ অনেক নিরীহ বাঙালীকে ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতনের পর পেছনের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় বলে জানায় এলাকাবাসী। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ-স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আনিসুর রহমান মানিক ও তার সহযোগী রাজাকার শামছুল হক বাচ্চু, মোখলেছুর রহমান মুকুল, ছাইদুর রহমান রতন, মাওলানা মোফাজ্জল হোসেন, আদিল সরকার, শামছুল হক ফকির, নুরুল হক ফকির, সুলতান ফকির, মুকুল মাস্টার, আব্দুল খালেক গুডু মাওলানাকে নিয়ে পাকসেনারা ত্রিশালের নানা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক বাঙালীকে হত্যা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিশালের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালীদের ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতনের পর পেছনের বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দেয়া হতো। স্কুলের সামনে একাত্তরের সেই বধ্যভূমিটিও ব্যক্তি উদ্যোগে শনাক্ত করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এই বধ্যভূমিতে কতজন শহীদ হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও স্থানীয় দাবি অন্তত অর্ধশত বাঙালীকে এই বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হলে শহীদ পরিবারের সদস্যরা একবার নগদ ১ হাজার টাকা আর এক বান্ডিল টিন ছাড়া আর কোন সহায়তা পায়নি। কেউ খোঁজও নেয়নি পরে। কালীরবাজার ও আহাম্মদবাদ বধ্যভূমি শনাক্ত করে শহীদদের নামের তালিকাসহ স্মৃতিফলকও করা হয়নি। স্থানীয় হাফিজ উদ্দিন (৬৮) জানান, কালীরবাজার ও আহাম্মদবাদ ছাড়াও ত্রিশালের তিরখী, বারইগাঁও, গোয়ারপাড়া, কানীহারিতে ব্যাপক গণহত্যা চালায় পাকসেনা ও স্থানীয় রাজাকার আলবদররা। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালামের দাবি, সেদিন রাজাকার কমান্ডার ও তাদের সহযোগীদের মদদে পাকসেনারা ত্রিশালের কালীরবাজার ও আহাম্মদবাদ এলাকাতেই হত্যা করে শতাধিক বাঙালীকে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ময়মনসিংহ জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রব জানান, আগামী নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে ত্রিশালের বধ্যভূমিগুলো শনাক্ত করে শহীদদের নামের তালিকাসহ স্মৃতিফলক করার দাবি জানিয়েছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ। গত বছরেও অক্টোবর ও নবেম্বর মাসে ত্রিশালে পাকসেনাদের দোসর জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আনিসুর রহমান মানিক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আলাদা ৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল এসব মামলা তদন্ত করছে। তবে এখনও গ্রেফতার হয়নি কোন যুদ্ধাপরাধী।
×