ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস না বসানোয় উদ্বিগ্ন অনেক ব্যাংক গ্রাহক

সাইবার সন্ত্রাস

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২১ এপ্রিল ২০১৬

সাইবার সন্ত্রাস

রহিম শেখ ॥ ইন্টারনেটের কল্যাণে গত এক দশকে অনলাইনের মুঠোয় চলে এসেছে গোটা ব্যাংকিং খাত। সাধারণ ব্যাংকিং পরিবর্তিত হয়েছে ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং’-এ। ব্যাংকিং সেবা যখন গ্রাহকের দোরগোড়ায় ঠিক তখনই সাইবার হামলার শিকার এই ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং’। এটিএম বুথ এবং রিজার্ভ জালিয়াতির বেশ কিছু সাম্প্রতিক ঘটনায় গোটা ব্যাংকিং খাতের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে। এদিকে এটিএম বুথে গ্রাহকের টাকা লোপাটের ঘটনার ২ মাসেও এ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস বসায়নি অনেক ব্যাংক। প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা বাড়াতে প্রচুর অর্থ ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করছে ব্যাংক মালিকদের মনে। এজন্য খোদ ব্যাংকাররাই বলছেন, সামনের দিনগুলো ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়। কেননা, কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করেও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সাইবার হামলার শিকার হতে পারে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত। তবে শুধু যে বাংলাদেশে এমনটি ঘটছে তা কিন্তু নয়। আর্থিক খাতে গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটি ক্রেডিট কার্ড চুরির হয়েছে। গত বছর বিশ্বের ৩০ দেশের প্রায় ১০০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাইবার হামলার শিকার হয়েছে। বিশ্বজুড়ে পেশাদার হ্যাকাররা এখন পুঁজিবাজারের সাইবার হামলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানা গেছে, দেশে কার্যরত ৫৬ ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজারের অধিক শাখা এবং প্রায় ৭ হাজার ৩শ’ এটিএম বুথ রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকরা অনলাইনে লেনদেন করতে পারছেন। এর বাইরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এ্যাকাউন্ট রয়েছে ৩ কোটি ৩৯ লাখের বেশি। এর বাইরে অনেক গ্রাহক ব্যাংকগুলোর অনলাইন সেবা নিচ্ছেন। ফলে ব্যাংকিং খাতের একটি বড় অংশই চলে গেছে অনলাইনের সেবায়। এভাবেই গত এক দশকে ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং’ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। ব্যাংকিং খাত ডিজিটাল করতে কাড়ি কাড়ি অর্থও খরচ করা হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, দেশের ৫৬ ব্যাংক এ খাতে খরচ করেছে ২২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এই খাতে উদার হয়ে খরচের অনুমতি দিয়েছে। বেসরকারী ও বিদেশী ব্যাংকগুলোর প্রায় সব শাখা ইতোমধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে। সরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক ৫শ’ শাখায় অনলাইন সার্ভিস চালু করেছে। অন্য ব্যাংকগুলোও দ্রুত এ কাজ করছে। তবে এ সময়ে দেশে ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে অনেক। ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ব্যাংকিং খাতের জন্য পরিচিত একটি শব্দ। মাঝে মধ্যে ঘটেছে চেক জালিয়াতির ঘটনাও। তবে সেগুলো ছিল সীমিত পর্যায়ে। এর আগেও মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। তাও গ্রাহকের মাঝে তেমন আতঙ্ক দেখা দেয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে টাকা লোপাটের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন গ্রাহকরা। অবশ্য এ ঘটনায় প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার পাশাপাশি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এ ঘটনার পর এটিএম বুথে জালিয়াতি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা জারি করা হয়। বলা হয়, এক মাসের মধ্যে চুরি প্রতিরোধক এ্যান্টি স্কিমিং ও পিন শিল্ড ডিভাইস স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় এসএমএসের মাধ্যমে লেনদেনের তথ্য প্রদান করতে হবে। কিন্তু দুই মাস অতিবাহিত হলেও বেশিরভাগ ব্যাংক কার্যকর করেনি এমন উদ্যোগ। কয়েকটি ব্যাংক এ দুটি ডিভাইস বসালেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। আর টাকা তোলার পর সব গ্রাহককে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসএমএস পাঠাতে বলা হলেও এসএমএস সার্ভিস নেই, এমন গ্রাহককে এখনও ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে না। এ বিষয়ে একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, চুরি প্রতিরোধক যন্ত্র দুটি বসাতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে তারা এটিএম বুথে সার্বিক নিরাপত্তা বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, এটিএম বুথের নিরাপত্তায় দেয়া নির্দেশনার বিষয়ে এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর অগ্রগতি প্রতিবেদন নেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কোন কোন ব্যাংক নির্দেশনার আলোকে কাজ শুরু করলেও অনেক ব্যাংক পিছিয়ে আছে। এর আগে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মাইক্রোসফট তাদের সতর্কতামূলক নিরাপত্তা বার্তায় বলেছে, ২০১৪ সালের জুলাই মাসের পর উইন্ডোজ এক্সপি সংস্করণে কোন নিরাপত্তা সুবিধা দেয়া হবে না। পরে আরেক বার্তায় মাইক্রোসফট আরেক দফা সময় বাড়িয়ে বলেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নিরাপত্তা দেয়া হবে। কিন্তু এ সেবাগ্রহীতাকে মাইক্রোসফটের নির্ধারিত সেবামূল্য পরিশোধ করতে হবে। সাইবার দুনিয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে ফেব্রুয়ারিতে দেশের কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথে গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটল। এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের এমডি আহমেদ কামাল খান চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং খাতে এখন তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরচের পরিমাণও। ব্যাংকিং খাত নিরাপদ রাখতে এ খাতে নিত্যনতুন সফটওয়্যার আসছে। সেগুলো কিনতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। এদিকে এটিএম বুথের জালিয়াতির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই একই মাসে ‘সুইফট মেসেজ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮০০ কোটি টাকা অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ফিলিপিন্সে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং বাকি অর্থ শ্রীলঙ্কায় পাচার হয়। এ ঘটনায় গত ১৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে মামলাটি বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারের তদন্ত কমিটি ছাড়াও সিআইডির পাশাপাশি র‌্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ও পুলিশের বিশেষ শাখাসহ (এসবি) অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। একই সঙ্গে ঘটনাটি তদন্ত করছে ফিলিপিন্স, শ্রীলঙ্কা ও এফবিআই। এ ঘটনায় বড় ধরনের ইমেজ সঙ্কটে পড়ে গোটা ব্যাংকিং খাত। প্রশ্নের মুখোমুখি হয় ব্যাংকিং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। শেষঅবধি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গবর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পদ হারান দুই ডেপুটি গবর্নর, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সচিব। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ আর্থিক খাতের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জনকণ্ঠকে বলেন, আর্থিক খাতের নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে। ব্যাংকগুলোতে যেসব মেশিন ও কার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে তা খুবই নিম্নমানের। এতে যে কোন সময় গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়া যায়। ব্যাংকের যোগসাজশ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। এজন্য এখনই ব্যাংকগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমরা ডিজিটাল দেশ ও অর্থনীতির কথা বলছি। কিন্তু এটা চিন্তা করে দেখিনি এর ভালোর সঙ্গে খারাপটাও আছে। আমাদের ব্যাংকিং খাতে এটিএম বুথ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা চুরি হওয়ার পর আমরা উপলব্ধি করেছি নিরাপত্তা নিয়ে। এ ধাক্কাটা আরও আগে খেলে ভাল হতো। তবে আমি আশা করছি, সরকার এখন সচেতন হবে। দেশের আর্থিক খাতের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত কম্পিউটারে বাংলা লিখনী বিজয় কি-বোর্ডের উদ্ভাবক মোস্তাফা জব্বার মনে করেন, আমাদের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আছে। তাই ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এজন্য সরকারকে নতুন প্রযুক্তি ও আইন তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ নুরুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রতি কর্মকর্তার জন্য একটি করে কম্পিউটার নির্ধারিত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া তার পাসওয়ার্ড অন্য কারও পক্ষে জানা অসম্ভব। ব্যাংক কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সচেতন হলে অপরাধ খুব সহজে ঘটানো সম্ভব নয়। গত পাঁচ বছরে অপরাধ যত সংখ্যায় বেড়েছে, তাতে প্রযুক্তির উদ্ভাবন হালনাগাদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আপডেট হওয়াও জরুরী বলে তিনি মনে করেন। শুধু যে বাংলাদেশ কিংবা এদেশের ব্যাংকিং খাত সাইবার হামলার শিকার হয়েছে তা কিন্তু নয়। এর আগে ২০১৪ সালে বড় ধরনের সাইবার হামলার শিকার হয় আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান চেজ। ওই হামলায় হ্যাকাররা ব্যাংকের সুরক্ষিত তথ্যভা-ারে ঢুকে পড়ে ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্টসহ মোট আট কোটি ৩০ লাখ এ্যাকাউন্টের তথ্য চুরি করে। এর মধ্যে ৭০ লাখের বেশি ছিল ব্যবসায়িক এ্যাকাউন্ট। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ হওয়া এ ঘটনা রীতিমতো কাঁপন ধরিয়ে দেয় বিশ্বের আর্থিক খাতে। এ ঘটনাটিকেই এখন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাইবার হামলা হিসেবে ধরা হয়। সর্বশেষ গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা একটি কোম্পানির ব্যাংক এ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে। সাইপ্রাসের ‘ইউরো ব্যাংক, সাইপ্রাস লিমিটেড’-এর একটি এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই ১০০ মিলিয়ন ডলার লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া, সেøাভাকিয়া, হংকংসহ সাত দেশে স্থানান্তর করা হয় জালিয়াত চক্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ২০ এ্যাকাউন্টে। এ অর্থ বাজেয়াফত ঘোষণা করে উদ্ধারের জন্য নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে অবস্থিত ইউএস ফেডারেল কোর্টে ১৪ এপ্রিল একটি মামলা করা হয়েছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি নিরাপত্তা পণ্য নির্মাতা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিউলেট প্যাকার্ড এন্টারপ্রাইজ তাদের সাইবার ঝুঁকি প্রতিবেদন-২০১৬-তে জানায়, চলতি ২০১৬ সালে সাইবার নিরাপত্তায় উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত। এটিএম বুথগুলোয় পুরনো সংস্করণের উইন্ডোজ এক্সপি ব্যবহার করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অদূর ভবিষ্যতে এটিএম বুথের নিরাপত্তা দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে সাইবার আক্রমণ চালিয়ে ব্যাংক থেকে গ্রাহকের টাকা সরিয়ে নিতে পারে দেশী-বিদেশী অপরাধীরা। এ প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বেসিসের সভাপতি শামীম আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে নেই। আমরা অনলাইনে পিছিয়ে আছি বলে ঝুঁকি কম। তবে সরকারী-বেসরকারী ওয়েবসাইটগুলো ঝুঁকিতে আছে। এ ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে প্রতি তিন মাস পরপর তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি ও নিরাপত্তা অডিট করানো। উন্নত বিশ্ব ঝুঁকি মোকাবেলায় এ অডিট করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির চেয়েও বড় ধরনের সাইবার হামলার পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী হ্যাকাররা কাজ করছে বলে আশঙ্কা করছেন সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ইউগেন ক্যাসপারস্কি। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বহুল ব্যবহৃত এ্যান্টিভাইরাস ক্যাসপারস্কির উদ্ভাবক ইউগেন ক্যাসপারস্কি। শনিবার মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে পেশাদার হ্যাকাররা এখন পুঁজিবাজারের মতো বৃহৎ আর্থিক খাতে সাইবার হামলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। বিশ্বব্যাপী সাইবার সন্ত্রাস ছড়ানোই এসব হামলা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য। ক্যাসপারস্কি ল্যাবের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চীন, ইউক্রেন, কানাডাসহ বিশ্বের ৩০ দেশের প্রায় এক শ’ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। এ অপরাধে রাশিয়া, ইউক্রেন ও চীনের একটি সুসংগঠিত সাইবার ডাকাত চক্রকে অভিযুক্ত করা হয়। ‘কারবানাক’ নামে একদল হ্যাকার অনলাইনে সেসব দেশের ১০০টির মতো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্স লিমিটেডের (ফিনেক্সেল) ‘সিকিউরিটি ইন ব্যাংকিং এ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর’ শীর্ষক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলা হয়, গত কয়েক বছর সাইবার অপরাধের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আর্থিক সেবা খাতের। বর্তমানে আর্থিক সেবা খাতের ৪৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান সাইবার অপরাধ প্রবণতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঝুঁকির তালিকায় দ্বিতীয়তে রয়েছে সরকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোয় সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি ৪১ শতাংশ। আতিথেয়তা বা অবকাশ শিল্প খাতে এ অপরাধের প্রবণতাও ৪১ শতাংশ। এছাড়া অন্য খাতগুলোর মধ্যে উৎপাদনে ৩৬, প্রকৌশল ও নির্মাণে ৩৩, বিনোদন ও মিডিয়ায় ৩১, বিদ্যুত, জ্বালানিতে ৩১ এবং ফার্মাসিউটিক্যালে ২৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান অপরাধ প্রবণতার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ করা, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা শক্তিশালী না থাকা ও সচেতনতার অভাবে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, আর্থিক খাতে গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটি ক্রেডিট কার্ড চুরির ঘটনা ঘটেছে। ভারতে ক্রেডিট কার্ড তৈরির প্রতিষ্ঠান থেকে চুরি হয়েছে ৫০ লাখ কার্ড। এ সময়ের মধ্যে ২৫ দেশের ব্যাংক থেকে তারা হাতিয়ে নিয়েছে ১০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ। এর মধ্যে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার আত্মসাৎ হয়েছে একটি ব্যাংকের এটিএম জালিয়াতির মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের আরএকে ব্যাংক ও ব্যাংক মাসকট থেকে চুরি হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি এটিএম কার্ড। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে ৫ কোটিরও বেশি ডলার আত্মসাত হয়েছে। এ সময় ব্যাংকিং ডিভাইস হাইজ্যাক করে যুক্তরাজ্যের একটি ব্যাংক থেকেও ১৩ লাখ ইউরো হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। মূলত এসব ঘটনার কারণেই বিশ্বব্যাপী সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের বিষয়টি সামনে চলে আসে। ফলে বিশ্বব্যাপী সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি কমে এসেছে এর মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী সাইবার নিরাপত্তা ব্যয় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
×