ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মু. আব্দুল্লাহ আলআমিন

ডাচেস অব কেমব্রিজের ফ্যাশন কূটনীতি

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২০ এপ্রিল ২০১৬

ডাচেস অব কেমব্রিজের ফ্যাশন কূটনীতি

২৪ বছর আগে মায়ের স্মৃতি বিজড়িত স্থানটিতে সস্ত্রীক এসে প্রিন্স উইলিয়াম জানান, তারা এই সফরকে বেশ উপভোগ করেছেন। ১৬ এপ্রিল তারা ঠিক সেই বেঞ্চটিতে বসলেন ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি যেখানে বসেছিলেন উইলিয়ামের প্রয়াত মা প্রিন্সেস ডায়ানা। তাজমহল ভারতের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বহু বিদেশী পর্যটক কেবল সম্রাট শাহজাহানের এই অমর স্থাপত্য কর্মটি দেখার জন্য ভারতে এসে থাকেন। ডিউক অব কেমব্রিজ উইলিয়াম ও তার স্ত্রী ডাচেস অব কেমব্রিজ ক্যাথেরিন (সাবেক নাম কেট মিডলটন) এক সপ্তাহের জন্য ভারত ও ভুটান সফরে এলেও তাজমহল না দেখেই চলে আসবে তাই কি হয়। রাজকীয় অতিথিদের আগমন উপলক্ষে তাজমহলে এদিন অন্য পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়। আবহাওয়া ছিল প্রচ- তাই বরফ পানি ছিটিয়ে সেই ঐতিহাসিক মার্বেলের বেঞ্চটি শীতল করা হয়। বলাবাহুল্য পুরো এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল। এ কারণেই তারা সফরের শেষ পর্যায়ে (উইলিয়ামের মা ও প্রিন্স চার্লসের সাবেক স্ত্রী) ডায়ানার সেই আইকনিক ফটোগ্রাফটি রিমেক করার জন্য সেই মার্বেলের বেঞ্চটিতে বসে ছবি তোলেন। জায়গাটি পরিদর্শন করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন উইলিয়াম। প্রেমের তীর্থক্ষেত্র বলে পরিচিত হলেও ১৯৯২ সালের ওই সফরে চার্লস ও ডায়ানা একসঙ্গে ভারতে এলেও তারা দুজন একসঙ্গে তাজমহল পরিদর্শনে যাননি। ডায়ানা যখন তাজমহল দেখতে আগ্রায় চার্লস তখন ছিলেন ব্যাঙ্গালুরুর একটি অনুষ্ঠানে। এই রাজ দম্পতির সম্পর্ক যে বিচ্ছেদের দিকে গড়াচ্ছে ওইদিনের ঘটনা হয়তো সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিল। চার্লসের সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদের পর ডায়ানা ১৯৯৭ সালে প্যারিসে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আগ্রার বাসিন্দা রাজ পরিবারের ফ্যান ৭৩ বছর বয়সী সুরেন্দ্র শর্মার সঙ্গেও এবারের রাজ পরিবারের অতিথিরা সাক্ষাত করেন। ১৯৬১ সালে রানী এলিজাবেথের তাজমহল পরিদর্শনে আসার স্মৃতিচারণ করে শর্মা বলেন, তার প্রয়াত পিতৃব্য কৈলাশ নাথ শর্মা এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের ছবি তুলেছিলেন। ২৪০ ফুট উঁচু তাজমহলে বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে। প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের (প্রকৃত নাম আরজুমান্দ বানু বেগম) স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশে মোগল সম্রাট শাহজাহান ১৬৩১ থেকে ৪৮ সালের মধ্যে যমুনা নদীর পাড়ে এটি নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, মমতাজ মহলের গর্ভে শাহজাহানের ১৪ জন সন্তানের জন্ম হয়। সর্বশেষ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মমতাজ মারা যান। ৪২ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত তাজমহলকে বহির্র্বিশ্বে ভারতের পরিচিতিমূলক অন্যতম ল্যান্ডমার্ক গণ্য করা হয়। সপ্তাহব্যাপী এ সফরের মাঝামাঝি সময়ে একদিনের জন্য তারা যান ভুটানে। সেখানে ভুটানের রাজা নামগিয়াল ওয়াংচুক ও রানী জেটসুন পেমার সঙ্গে কেট-উইলিয়াম দম্পতি দেখা করেন। এই সফরে তারা নিজেদের দুই শিশুসন্তানকে সঙ্গে নেননি। এর আগে ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় তারা জর্জকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১০ এপ্রিল তারা ভারত সফরে এসে রাজ দম্পতি মুম্বাইয়ের একটি বস্তিতে গিয়ে শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা একটি স্থানীয় ক্রিকেট একাডেমিতে ক্রিকেটও খেলেন। ভারতে তাদের প্রথম সন্ধ্যাটি কাটে বলিউড সেলিব্রেটি ও ব্যবসায়ী নেতাদের অংশগ্রহণে এক চ্যারিটি অনুষ্ঠানে। সফরকালে তারা নয়াদিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও সাক্ষাত করেন। তারা অসমের কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্কও দেখতে যান। এক শিংঅলা ভারতীয় গন্ডারের আবাসস্থল হিসেবে পার্কটির খ্যাতি রয়েছে। সেখানে ক্যাথেরিন একটি গন্ডার ও হাতি শাবককে বোতলে দুধ খাওয়ানোর ছবি গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সবদিক দিয়ে দেখলে ডিউক ও ডাচেস অব কেমব্রিজের এই সফরকে সফলই বলতে হয়েছে। বিশেষ করে ডাচেস দেখিয়ে দিয়েছেন ফ্যাশন দুনিয়ায় তিনি ইতোমধ্যেই নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। সপ্তাহব্যাপী সফরকালে রাজকীয় যুগলের মধ্যে ক্যাথেরিনের দিকেই গণমাধ্যমের মনোযোগ বেশি ছিল। এই সফরে তিনি পোশাক বদলেছেন ২০ বার। এগুলোর মধ্যে সবার সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যেটি পরে তিনি মুম্বাইয়ের একটি ক্রিকেট মাঠে ব্যাট হাতে নেমে পড়েছিলেন। পাঁচ ভাঁজযুক্ত ছাপার ওই পোশকটি তৈরি করেন ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনার অনিতা ডংরি। মুম্বাইভিত্তিক এই ফ্যাশন ডিজাইনারের হাউস অব অনিতা ডংরি লি. ভারতের সেরা ফ্যাশন হাউসগুলোর একটি। অনিতা ছাড়া এই সফরে কোথাও তিনি কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য রাখেননি। বলা যায়, ফ্যাশনই এখানে তার হয়ে কথা বলেছে। পোশাক নির্বাচনের তিনি পাশ্চাত্য নয় বরং প্রাচ্যের রুচিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী নিউজউইক মন্তব্য করেছে, ক্যাথেরিন যে পোশাকগুলো পরেন ফ্যাশন বাজারে ওগুলো ১শ’ কোটি পাউন্ডের বেশি ব্যবসাকে প্রভাবিত করতে পারে। কোন কোন ফ্যাশনামোদি একে ‘কেট ইফেক্ট’ বলেও অভিহিত করছে। ম্যাঞ্চেস্টারভিত্তিক সাময়িকী গ্ল্যামারের ফ্যাশন এডিটর নাটালি হার্টলি বলেন, ‘রাজকীয় পোশাকগুলো সাধারণত রাজ পরিবারের সদস্যদেরই মানায়। কিন্তু ডাচেস যে পোশাকগুলো পরেছেন ফ্যাশন বাজারে ওগুলো সাড়া ফেলেছে। শোবিজ সেলিব্রেটি না হলেও তিনি এখানে নতুন ধারা প্রবর্তন করেছেন।’ ফ্যাশন সাময়িকীগুলোর প্রচ্ছদে উঠে এসেছেন ডাচেস। মুম্বাইভিত্তিক ফ্যাশন এডিটর মনীশ মনরোও তাই মনে করেন। তার মতে, এই সফরে ক্যাথেরিন ভারতীয় পোশাক না পরলেও তার নিজস্ব পছন্দের মধ্যে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ভাবধারার একটি মিশেল লক্ষ্য করা গেছে। যে কারণে তার ওই পোশাকগুলো এখন ভারতের বাজারে বেশ বিক্রি হচ্ছে। তবে এক সপ্তাহ (একদিন বাদে) ভারতে অবস্থান করলেও শাড়ি না পরায় কেউ কেউ মিশ্রপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। খ্যাতিমান (এবং কিছুটা বিতর্কিত) লেখিকা শোভা দে’ও তাই মনে করেন। তার কথায়, ক্যাথেরিন পোশাকের ব্যাপারে মোটেই সিরিয়াস ভাব দেখাননি। বিষয়টি তিনি যথেষ্ট হালকাভাবে নিয়েছেন। শোভা দে মনে করেন, এই সফরে তার পোশাকগুলো ছিল খুবই সাদামাটা ধরনের ও বৈচিত্র্যহীন। ডাচেস অব কেমব্রিজের পোশাকগুলোকে যথেষ্ট ফ্যাশনেবল হয়তো বলা যাবে না। কারণ ভারতীয় নারীদেরও আজকাল বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ছাপা সুতির ফ্রকের তুলনায় অনেক জমকালো পোশাক পরতে দেখা যায়। কিন্তু কূটনৈতিক দিক থেকে এর ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। দুই দেশের মধ্যে জনগণ যোগাযোগ আরও বাড়ানো যদি এই সফরের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে ফ্যাশন কূটনীতির জন্য রাজবধূ সাধুবাদ পেতেই পারেন।
×