ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাকিল আহমেদ

আফ্রিকায় সবুজ বিবর্তন

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২০ এপ্রিল ২০১৬

আফ্রিকায় সবুজ বিবর্তন

খাদ্য সমস্যা মোকাবেলায় এশিয়া ও লাতিন আমেরিকান পরিচালিত সবুজ বিপ্লব সফল হয়েছে। এই বিপ্লবের মূল ভিত্তি উন্নতজাতের অধিক ফলনশীল ধান-গম আবাদ ও পানি সেচ। একই পদ্ধতি আফ্রিকার বুকে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে সবুজ বিপ্লবের প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। তবে সামগ্রিকভাবে সেখানে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। তাই আফ্রিকান সবুজ বিপ্লব পুরোপুটি সফল না হলেও যেটা হয়েছে তাকে বলা যেতে পারে সবুজ বিবর্তন। অধিক ফলনশীল জাতের ধান ও গমের আবাদ অন্যত্র নাটকীয় ফল দিলেও আফ্রিকায় তেমন না দেয়ার পেছনে অবশ্য কারণও আছে। কারণ, আফ্রিকার জলবায়ু একেক অঞ্চলে একেক রকম। সেখানকার মৃত্তিকার মান উন্নত নয়। সড়ক অবকাঠামোর তীব্র অভাব থাকায় কৃষকের দোরগোড়ায় উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশক যেমন ঠিকমতো পৌঁছে না তেমনি তাদের উৎপাদিত ফসলের বাণিজ্যিকীকরণ ভালভাবে হয় না। তবে দেখা গেছে, যেখানে সুশাসন আছে, উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষি উপকরণের সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে সেখানে খাদ্য উৎপাদনে রীতিমতো বিপ্লব ঘটছে। এসব এলাকায় কৃষিতে বিস্ময়কর অগ্রগতি হচ্ছে। ১৯৬১ সালের পর থেকে আফ্রিকার সব ধরনের কৃষিজপণ্যের উৎপাদনমূল্যের দিক দিয়ে চারগুণ বেড়েছে। বর্ধিত উৎপাদনটা এসেছে নতুন জমি আবাদের কাজে ব্যবহারের ফলে। যেমন ষাটের দশকের প্রথমদিকে সাহারা সন্নিহিত আফ্রিকায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় চাষাবাদ হতো। এখন আরও ৮ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা চাষাবাদের আওতায় এসেছে। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী রুয়ান্ডায় ২০১৪ সালে প্রায় ৮ লাখ টন শস্য উৎপাদিত হয়েছে, যা ২০০০ সালের উৎপাদনের চেয়ে তিনগুণ বেশি। পূর্ব আফ্রিকার প্রধান শস্য ভুট্টার উৎপাদন ৭ গুণ বেড়েছে। ইথিওপিয়ায় ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দানাদার শস্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণ, যদিও এলনিনোর প্রভাবে গত বছর উৎপাদন হয়েছে কম। ক্যামেরুন, ঘানা ও জাম্বিয়ায় উৎপাদিত খাদ্যশস্য মূল্যের দিক দিয়ে বেড়েছে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ। কেনিয়ায়ও প্রায় তাই হয়েছে। ফলে আফ্রিকার এসব দেশ ও এলাকার কৃষকরা এখন ভালভাবে খেয়েপরে আছে। তাদের জীবনে খাদ্য নিরাপত্তা এসেছে। সেটা সম্ভব হয়েছে উন্নত প্রযুক্তি, সঙ্কর জাতের বীজ ও সারের ব্যবহার এবং উন্নততর ব্যবস্থাপনার বদৌলতে। সুতরাং, সবুজ বিপ্লব চিরায়ত অর্থে ব্যর্থ হলেও আফ্রিকায় আজ সবুজ বিবর্তন ঘটছে। আফ্রিকার কৃষির স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। সেখানকার কৃষির ফলন বৈশ্বিক গড় ফলনের অর্ধেকেরও কম। আফ্রিকার কৃষির উৎপাদনশীলতা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের প্রায় অর্ধেক হারে বাড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকা মহাদেশ হলো ক্ষুদে কৃষকদের এলাকা। এই কৃষকদের অর্ধেক মহিলা। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ খামার এক হেক্টরের কম। সাহারার দক্ষিণাঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কৃষিতে নিয়োজিত। আফ্রিকায় ভারি শিল্প তেমন নেই। কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এ অবস্থায় গোটা মহাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোই জীবনের মানোন্নয়নের অন্যতম উপায়। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, আফ্রিকার গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনও ২ শতাংশ। এতে অধিক সংখ্যক শ্রমিকের যোগান হচ্ছে ঠিকই তবে পাশাপাশি অধিকসংখ্যক মানুষের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে। আফ্রিকায় উর্বর ভূমি খুব বেশি নয়। অভ্যন্তরভাগের অধিকাংশ জমি চাষাবাদের উপযোগী নয়। সাহারার দক্ষিণে আবাদযোগ্য জমির মাত্র ৪ শতাংশে সেচ কাজ হয়। বাকি জমির চাষাবাদ স্থানীয় আবহাওার ওপর নির্ভরশীল। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে চাষীরা তেমন ফসল আবাদেই বেশি আগ্রহী থাকে যেগুলোর ফলন কম হয়েও বৈরী আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারে। রুয়ান্ডায় সাদা ভুট্টা ও শিম প্রধান খাদ্য। অন্যত্র যব, জোয়ার, কাসাভা ও মিষ্টি আলুই প্রধান। এশিয়ার সবুজ বিপ্লব অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কারণ, এশিয়ার প্রধান ফসল বলতে ধান ও গম। দুটোরই রয়েছে উন্নত জাত। অন্যদিকে আফ্রিকার প্রধান ফসল এ রকম একটি বা দুটি নয়Ñ একাধিক। তাই সেখানে একটি বা দুটি ফসলের ওপর নির্ভর করে সবুজ বিপ্লব করা সম্ভব নয়। সেখানে প্রয়োজন বেশ কয়েকটি ফসলের ওপর নির্ভর করে একাধিক সবুজ বিপ্লব সম্পন্ন করা। আফ্রিকার সবুজ বিপ্লবের পথে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। মহাদেশে এক বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্য ও বুভুক্ষার রাশ টেনে ধরার ব্যাপারে তেমন সাফল্য নেই। মহাদেশে তেল ও হীরার মতো আহরণমূলক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও তাতে কর্মসংস্থান ও দরিদ্রের আয় কোনটাই তেমন বাড়ছে না। আরেক মস্ত সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। আফ্রিকায় যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি এক দীর্ঘ পুরাতন সমস্যা। সেখানে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদান ও সোমালিয়ার মতো কিছু ব্যর্থ রাষ্ট্র আছে। কিছু কিছু রাষ্ট্রে অবশ্য নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকরা বিদায় নিয়েছে এবং সীমান্ত যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিকভাবে কৃষি উৎপাদনে গতি এসেছে। অবকাঠামো সমস্যাসহ যেসব বাধাবিপত্তি আছে তা এখন কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। কৃষকদের সঙ্কর জাতের উন্নত বীজ সরবরাহে বেসরকারী পর্যায়ে অনেক কোম্পানি গড়ে উঠেছে। অনেক বীজ আফ্রিকানরা নিজেরাও উদ্ভাবন করছে যেগুলো খরা সহিষ্ণু ও অধিকতর ফলনশীল। উন্নত বীজ ও সারের ব্যবহার ও নতুন প্রযুক্তি প্রচলনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলো কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। নিট হিসেবে বলতে গেলে আফ্রিকা এখনও খাদ্য আমদানিকারক হিসেবেই রয়ে গেছে। কারণ, মহাদেশের খাদ্যের এক বড় অংশ যেমন ডেইরি, মাংস, চিনি ও দানাদার শস্য বাইর থেকে আনতে হয়। তবে সাহারার দক্ষিণের দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদনে বর্তমানে যে অগ্রগতি চলছে তাতে সবুজ বিপ্লব ঘটে যেতে খুব বেশি বিলম্বে ঘটবে না। তখন নিরন্ন আফ্রিকা আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উঠে এক পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×