ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরিণয়ের পর পরিবারের গল্প- অঞ্জলির জন্য শচিনের অনুধাবন;###;মোঃ মামুন রশীদ

‘কোন প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়’

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২০ এপ্রিল ২০১৬

‘কোন প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়’

মাত্র ২২ বছর বয়সে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু করলেন শচিন টেন্ডুলকর। ১৯৯৪ সালের ২৪ এপ্রিল নিজের ২১তম জন্মদিনে বাগদান সম্পন্ন হয় শচিন-অঞ্জলি মেহতার। আর ঠিক এক বছর পর ২৫ মে, ১৯৯৫ শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন দু’জন। বিয়ের পরই সংসারধর্মে জড়িয়ে ক্যারিয়ার বাধাগ্রস্ত হতে পারত শচিনের। কিন্তু পরিবারের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে শচিনকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দিয়েছিলেন অঞ্জলি। ত্যাগ করেছেন নিজের অন্য সব কাজ। বিয়ের পরে আগের চেয়ে একটু গা-ছাড়া হয়ে পড়েছিলেন এবং নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ঢিল দিয়ে ফেলেছিলেন। আর সে কারণে অনেকখানি ওজন বেড়ে গিয়েছিল। অনেক বেশি চকোলেট এবং আইসক্রিম খাওয়ার কারণেও ওজন বেড়ে যায়। মুম্বাইয়ে ফেরার পর শচিন খেয়াল করলেন কোন পোশাকই আর পরতে পারছেন না, আঁটসাঁট হয়ে গেছে সব। ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ভারতের তেমন ব্যস্ততা ছিল না। সেজন্যই নিজের মতো করে স্বাধীন জীবন-যাপন করেছেন ভালবাসার অঞ্জলিকে নিয়ে। কিন্তু অঞ্জলি তাকে ক্রিকেটের জন্য করেছেন অনুপ্রাণিত। আর শচিনের হয়ে সামাজিক ও পারিবারিক ঐতিহ্যের কর্মকা-গুলো একাই চালিয়ে গেছেন অঞ্জলি। সে কারণেই জীবনসঙ্গিনী সম্পর্কে উপলব্ধি করেছেন কোন কৃতিত্ব দিয়েই অঞ্জলির অবদান স্বীকার যথেষ্ট হবে না। আর সেজন্যই বিশ্ব ক্রিকেট পেয়েছে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম একজনকে। নিজের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’-তে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ‘লিটল মাস্টার’ শচিন। হানিমুনে বেশ কিছুদিনের জন্য গোয়ায় ঘুরতে গিয়েছিলেন নব-দম্পতি। প্রতিযোগিতামূলক খেলার বাইরে আনন্দময় সময়ে কাটিয়েছেন তখন। গোয়ায় চার বন্ধু ছিল, তাঁদের নিয়ে ডবল-উইকেট টুর্নামেন্ট খেলেছেন। কিন্তু সেসব তো শুধু মজা করার জন্য খেলা, প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট নয়। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকলে শরীর রাখতে হয় ফিট, থাকতে হয় অনেক নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সবারই পারিবারিক দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। শচিন তখন ২২ বছর বয়সী হলেও ২২ গজের ক্রিকেট উইকেটই যেন তাঁর ঘর-বাড়ি। সতীর্থ ক্রিকেটাররাই যেন পরিবার। তবে কি অঞ্জলিকে বিয়ে করে ক্রিকেটকেই নির্বাসন দিতে হবে? সংসার ধর্মে মনোযোগী হতে হবে শচিনকে? পরিস্থিতিটা তাই বলছিল। কিন্তু অঞ্জলি তা হতে দেবেন কেন? শচিন যা সেটার জন্যই তো তাঁকে ভালবেসেছিলেন, সেজন্যই এসেছেন তাঁর ঘরে। আর এখন সেটা কিভাবে বাধাগ্রস্ত হতে দিতে পারেন? অঞ্জলি খুব ভাল করেই জানতেন শচিনের প্রথম প্রেম তিনি নয়, শচিনের প্রথম প্রেম ক্রিকেট। সেখান থেকে সহজে বিচ্ছিন্ন হতে পারবেন না লিটল মাস্টার। এ কারণে অঞ্জলি নিজেই তাঁর ক্যারিয়ারের চিন্তা মাথা থেকে বিসর্জন দিলেন। নিজেকে শুধু সঁপে দিলেন ক্রিকেটার শচীনের কাছে। পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন মেধাবী অঞ্জলি। সেটা ঠিকভাবে করে গেলে দারুণ একটি ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। কিন্তু অঞ্জলি ত্যাগ স্বীকার করলেন। তিনি শচিনকে বললেন, ‘আমি চাই তুমি তোমার স্বপ্নের লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাও। আমি স্বেচ্ছায় নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিচ্ছি। আমি আমার পরিবারের জন্য সবকিছুই ছাড়তে পারি।’ শচিনকে মন থেকে যেভাবে ভালবেসেছিলেন সেজন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল অঞ্জলির জন্য। পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনে যত ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন অঞ্জলি কোনকিছুতেই জড়াননি শচিনকে। নীরবে নিজেই সবকিছুর সমাধান করেছেন। আর এটাই অঞ্জলির প্রতি শচিনের ভালবাসা, টান এবং সম্মানটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। শচীন দ্রুতই অনুধাবন করেন তিনি জীবনে এমন একজনকে পেয়েছেন যার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায় এবং তীব্রভাবে ভালবাসা যায়। বছরের পর বছর শচিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেরিয়েছেন। নিজের দুই সন্তান সারা ও অর্জুন ছাড়াও প্রিয়তমা অঞ্জলিকে দীর্ঘ সময় দেখার সুযোগ পাননি। একাকী ঘুরেছেন দেশ ও দেশের বাইরে। আর সে কারণে নিজের সন্তানদের দিকেও মনোযোগ ছিল না। এমনকি ২০১১ বিশ্বকাপের পর খেয়ালই করেননি পুত্র অর্জুন উচ্চতার দিক থেকে তাকে প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছেন। অনেক মূল্যবান মুহূর্ত পরিবারের সঙ্গে কাটানো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন শচিন। কিন্তু শচিন এসব মেনে নিয়েছেন। কারণ পেশাদার যে কোন ক্রীড়াবিদের জন্য এসব ক্যারিয়ারেরই অংশ। কিন্তু শচিন নির্বিঘেœ তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নিশ্চিন্তে খেলা চালিয়ে যেতে পেরেছেন শুধু অঞ্জলির জন্যই। কারণ তিনি শচিনকে পারিবারিক, সামাজিক কোন কর্মকা-ে জড়াতে দেননি এবং দুই সন্তানকে একাই আগলে রেখেছেন। এতসব ব্যস্ততা একাকী নীরবে সামলে গেলেও সেসব নিয়ে শচিনের কাছে কখনও অনুযোগ করেননি অঞ্জলি। উল্টো বরং শচিনকে কেন পরিবারের বাইরে থাকতে হচ্ছে সে বিষয়ে সান্ত¡নামূলক কথা বলে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিভিন্ন সময়ে শচিন ২২ গজের ক্রিকেটে যা করেছেন সেজন্য গর্বিত হয়েছেন। এসব কারণে অঞ্জলি যখনই যা বলেছেন সেসব শিরোধার্য করে নিয়েছেন শচিন এবং গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করে সেই মোতাবেক চলতে চেষ্টা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ও সঙ্কটময় মুহূর্তেও অন্যতম পরামর্শক, উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন অঞ্জলি। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি শচিনের মা, দুই সন্তান, পারিবারিক খরচাপাতি পরিচালনা এবং সামাজিক বিভিন্ন কর্মকা-ে যুক্ত থাকা ইত্যাদি একাই করেছেন অঞ্জলি। আর শচিনকে বলেছেন, ‘বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। যখন কোন কাজ সম্পূর্ণ ঠিকভাবে শেষ হবে তখনই ফিরবে।’ আর এসবই শচীনের সবচেয়ে বড় আবেগ ও দুঃখের কারণ। তিনি আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন পরিবারকে ঠিকভাবে সময় দিতে না পারাটা বিভিন্ন সময়েই ভারাক্রান্ত করেছে তার হৃদয়কে। অঞ্জলি শুধু নিজেই শচিনকে কোনকিছু বলা থেকে বিরত থাকেননি, দুই সন্তানকেও কোন সময় অভিযোগ, অনুযোগ করার সুযোগ দেননি। সবাই মিলেই অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন শচিনকে। আরও একটি বড় সুবিধা ঘরেই পেয়েছেন তিনি। পেশাদার ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ইনজুরি। অঞ্জলি নিজেই ডাক্তার হওয়াতে সেসব পরিস্থিতিতেও পরামর্শ পেয়েছেন। সুস্থ, স্বাভাবিক থাকার জন্য এবং ইনজুরি কাটিয়ে ওঠার জন্য পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থাও পেয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। সবদিক থেকেই যেন শচিনের জন্য বর্ম ও শিরোস্ত্রাণ হয়ে সবকিছু থেকে রক্ষা করে গেছেন অঞ্জলি। এতসব সমর্থন ও ভালবাসাকে কোনভাবেই প্রশংসা করে শেষ করা সম্ভব নয়। কোন কৃতিত্বই যেন যথেষ্ট নয় অঞ্জলির জন্য। শচিনের জীবনে অঞ্জলি যেন ঈশ্বরের অসীম কৃপার একটি বিশাল উপহার! আর সে কারণেই লিটল মাস্টার শচিন দুই যুগ ধরে নির্বিঘেœ ক্রিকেট খেলে ভারতীয়দের কাছে হতে পেরেছেন ‘ক্রিকেট ঈশ্বর!’ তথ্যসূত্র : শচিন টেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ অবলম্বনে।
×