ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দোষারোপের সূত্র ধরে এ হত্যার স্বীকারোক্তি জিজ্ঞাসাবাদে

একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে নির্মমভাবে খুন করেন মা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২০ এপ্রিল ২০১৬

একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে নির্মমভাবে খুন করেন মা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অবশেষে ধারালো ব্লেড দিয়ে দেড় বছরের একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিজ হাতে নির্মমভাবে এলোপাতাড়ি আঘাতে হত্যার কথা স্বীকার করেছে মা। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে পরকীয়ায় আসক্ত বলে দোষারোপের সূত্র ধরে ক্ষুব্ধ মা ঘটনাটি ঘটায়। ধারালো ব্লেডের আঘাতে শিশুটির নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে যায়। হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন মা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করেননি। ঘটনা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে মানুষ ডেকে বাইর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে মৃত শিশুর পাশে ঘুমিয়ে ছিলেন। যাতে অন্য কেউ ঘরে ঢুকে শিশুকে হত্যা করতে পারে বলে স্বামী ও মানুষকে ভুল বোঝানো যায়। আর হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ব্লেড ফেলে দেন বাথরুমের ভেতরে। যেখান থেকে ব্লেডটি আর কোন দিনই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। এমন ঘটনা রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। শত শত মানুষ ভিড় করেছে সেই বাড়িতে। সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরখান থানাধীন মাস্টারপাড়া এলাকার ৮৫৯ নম্বর চার তলার বাড়ির চার তলায় এই ঘটনাটি ঘটে। বাড়িটির মালিক সোনালী ব্যাংক নৌ সদর দফতর শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মোহাম্মদ ওহিদুজ্জামান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, দুটি বেড রুম আর একটি ডাইনিং রুম মিলে তিন রুমের ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান নেহাল সাদিককে নিয়ে বসবাস করত। প্রায় ২ বছর ধরে মাসিক পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়ায় বসবাস করছে পরিবারটি। তিনি শিশু হত্যার ঘটনাটি শুনেছেন। নিহত শিশুটি তার বাসায় বসবাস করা অবস্থায়ই জন্ম হয়েছিল। উত্তরখান থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আলমগীর হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, নিহত শিশুটির পিতা আব্দুস সামাদ। সামাদের পিতার নাম মাহবুব হোসেন (মৃত)। বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতপুর থানাধীন সৈয়দপুর গ্রামে। তিনি উত্তরার নর্থ টাওয়ারে লেডিস কর্নার নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শোরুমে কর্মরত ছিলেন। জানা গেছে, নিহত শিশুর মায়ের নাম মুক্তি বেগম। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার বানিয়াবাদ গ্রামে। আব্দুস সামাদের সঙ্গে প্রথম স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় অনেক আগেই। আর মুক্তি বেগমের সঙ্গেও তার প্রথম স্বামীর অনেক আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আব্দুস সামাদের সঙ্গে পাঁচ বছর আগে মুক্তি বেগমের বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালই ছিল। বিগত তিন বছর ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। স্বামীর ধারণা তিনি সকাল থেকে রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত বাইরে থাকেন। গৃহিণী স্ত্রী এমন সুযোগে পরকীয়া করে। আর স্ত্রীর ধারণা স্বামী চাকরির কথা বলে অধিক সময় বাইরে থাকার কথা বলে, সেটি পুরোপুরি সত্য নয়। তাকে ফাঁকি দিয়ে স্বামী হয়ত পরকীয়া করে। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া হতো। এ জন্য তাদের গত তিন বছরে বহু ঝগড়া হয়েছে। এ কারণে বাড়ি মালিকরা তাদের সরে যেতে বাধ্য করেছে। এ জন্য পরিবারটিকে গত এক বছরে অনেক বার বাসা বদলাতে হয়েছে। তবে দুই বছর ধরে ওই বাড়িতে বসবাস করলেও প্রায়ই ঝগড়া হতো। স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালে যথারীতি স্বামী কর্মস্থলে চলে যায়। সন্ধ্যার পর স্ত্রী পাশের বাসার এক মহিলাকে ডেকে নেয়। তাকে বলে, তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। তার স্বামী আসতে দেরি হবে। তখন হয়ত সে গভীর ঘুমে থাকবে। ডেকে না পেয়ে বা ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে দেরি হলে রাগারাগি করতে পারে। এ জন্য সে বাইর থেকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিতে বলে। স্ত্রী কথামত ঘরে শুয়ে পড়ে। আর ওই মহিলা বাইর থেকে ঘরের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে চলে যায়। রাত দশটার দিকে স্বামী যথারীতি বাসায় ফিরে। প্রথমে দরজায় নক করে। ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ হয় না। এক পর্যায়ে স্বামী দেখতে পায় ঘর বাইর থেকে ছিটকিনি দিয়ে আটকানো। তিনি যথারীতি দরজা খুলে ভেতরে যান। ঢুকেই দেখতে পান তার একমাত্র ছেলে বিছানার ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ছেলের পেটের নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে আছে। পাশেই ছেলের মা ঘুমিয়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখে চিৎকার দিলে জেগে ওঠে স্ত্রী। এরপর শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর কান্নাকাটি। এ সময় আশপাশের মানুষ এগিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। পরে লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। স্বামী ও প্রতিবেশীরা পুলিশকে জানায়, ওই ঘরে স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত আর কেউ থাকে না। এরপর পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে স্বামী-স্ত্রীকে আটক করে। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার বিধান ত্রিপুরা জনকণ্ঠকে জানান, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহের জের ধরে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটে। স্বামী মনে করতে স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িত। আর স্ত্রী মনে করত স্বামী পরকীয়ায় জড়িত। মূলত এ নিয়েই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে যখন ঝগড়া হতো তখন স্বামী বলত, সে ছেলেকে নিয়ে অন্য জায়গায় স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যাবে। বার বার এমন কথায় মানসিকভাবে মা ভেঙ্গে পড়ে। সন্তানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় মা তার একমাত্র সন্তানকে ব্লেড দিয়ে পেটে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। তাতে নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে গেলে শিশুটির মৃত্যু হয়। মৃতের মা এক পর্যায়ে আবেগে আত্মহত্যার করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা আত্মহত্যা করেনি। হত্যাকা-ের ঘটনা ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে কৌশল করে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই ঘরে মৃত সন্তানের পাশে ঘুমের ভান করে শুয়ে থেকে নাটক সাজায়। যাতে খোলা দরজা দিয়ে অন্য কেউ শিশুটিকে হত্যা করে পালিয়ে যেতে পারে বলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মা নিজ সন্তানকে হত্যার কথা স্বীকার করে। হত্যার পর রক্তাক্ত ব্লেডটি বাথরুমের ভেতরে ফেলে দেয়। এ ব্যাপারে স্বামী বাদী হয়ে স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হত্যা মামলাটির রহস্য ইতোমধ্যেই উদ্ঘাটিত হয়েছে। আসামিকে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য আদালতে সোপর্দ করা হবে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মা হত্যাকা-ের পুরো ঘটনাই বর্ণনা করেছেন। তবে খুনী মা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেবেন কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
×