ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উষ্ণ নগরী হচ্ছে ঢাকা ॥ তাপমাত্রা বাড়ছেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২০ এপ্রিল ২০১৬

উষ্ণ নগরী হচ্ছে ঢাকা ॥ তাপমাত্রা বাড়ছেই

শাহীন রহমান ॥ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঢাকা মহানগর ধীরে ধীরে একটি উষ্ণ নগরীতে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বিগত ১শ’ বছরের মধ্যে এ বছর মার্চ মাসে বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে অথচ এই সময়ের মধ্যে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ২ ডিগ্রী। তাদের মতে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঢাকা শহর দিন দিন হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে। তবে এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ি করা হচ্ছে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রভাবেব সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ণকে। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ঢাকা নগরী একটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে বলে তারা অভিমত দিয়েছেন। গত এপ্রিলের ১১ তারিখেই দেশের তাপমাত্রা ৪১.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। যা নিকট অতীতে এপ্রিলের এই সময়ে তাপমাত্রা এত পরিমাণ বৃদ্ধির কোন রেকর্ড নেই। পাশপাশি একই সময়ে রাজধানীর ঢাকার তাপমাত্রাও উঠে যায় ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এপ্রিলের তাপমাত্রা পার্শ্ববর্তী ভারতে শতাধিক লোকের মৃত্যুর খবর পর্যন্ত পাওয়া গেছে অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলেও এ বছর এপ্রিলেই তা অতিক্রম করেছে। পরিবেশ সংগঠন পবার পক্ষ থেকেও সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রা জরিপ করে ঢাকায় অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছে। সংগঠনের নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ঢাকায় এলাকাভেদে তাপমাত্রার তারতম্য নিরূপণের লক্ষ্যে গত ১১ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা জরিপ করে দেখা গেছে, ধানম-ি লেক এলাকার চেয়ে ঢাকার যে কোন এলাকার তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রী বেশি। এলাকাভেদে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা পাওয়া যায় পল্টন মোড়, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ১নং গেট, শাপলা চত্বর, নিউ মার্কেট বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। এসব এলাকার তাপমাত্রা অন্যান্য এলাকার চেয়ে ১.৫ থেকে ৪ ডিগ্রী বেশি। তিনি বলেন, এর প্রধান কারণ মোটরযানের ধোঁয়া ও এসির গরম বাতাস, কংক্রিটের পাকা রাস্তার গরম। রাস্তার পাশে ফুটপাথে বা ছায়ার চেয়ে রাস্তার মাঝখানে বা রোদে তাপমাত্রা ১ থেকে ২.৫ ডিগ্রী বেশি। বাসের ভেতরে পেছনের চেয়ে সামনে তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রী বেশি পাওয়া গেছে। বাসা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করাই এর প্রধান কারণ। ঢাকায় থার্মোমিটারে যে তাপমাত্রা পাওয়া যায় বাস্তবে ঢাকার জনজীবনে অনুভূত তাপমাত্রা ৩ থেকে ৮ ডিগ্রী বেশি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলেই নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী শহর ঢাকা ধীরে ধীরে একটি উষ্ণ এলাকায় পরিণত হচ্ছে। নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় পরিকল্পনার অভাবে এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাছপালা ও জলাভূমি ধ্বংস করে ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হয়েছে। ঢাকার পরিবেশ, জনজীবন ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধিরোধে অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে। আবহাওয়া অধিফতরের তথ্যানুযায়ী ১৯০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এপ্রিল মাসের গড় তাপমাত্রা ছিল ২৭ দশমিক সাত ডিগ্রী। সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩৪ দশমিক দুই ডিগ্রী সেলসিয়াস অথচ ২০১৪ সাল থেকে এ মাসে গড় তাপমাত্রা অধিক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। যা অতীতে যে কোন সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ২০১৪ সালে গড় এপ্রিল মাসের গড় তাপমাত্রা বেড়ে প্রায় ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস পৌঁছে যায়। এ বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধেই আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৪২ ডিগ্রীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মার্চ মাসের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩২ দশমিক ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঢাকার সর্বোচ্চ গড় তাপামাত্রা ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এবার মার্চ মাসে এ রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫ দশমিক এক ডিগ্রী। ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে এ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ঢাকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৯৬০ সালে ৪২ দশমিক তিন ডিগ্রী অথচ এ রেকর্ডে এপ্রিল মাসেই দেশে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রীর কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে তারা অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন শুধু প্রাকৃতিক কারণেই নয়, মানবসৃষ্ট কারণও শামিল। ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা সবক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেয়া দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি বাড়ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের ২০১০ সালের প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের ওপর। ওই প্রতিষ্ঠানের ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধমান মেগাসিটি। বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। ১৯৯০ সালে যা ছিল ৬০ লক্ষ। ২০০৫ সালে ১ কোটি ২০ লাখে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২ কোটি। ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ, জনজীবন ও জনস্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হচ্ছে মূলত অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদী-খাল, জলাভূমি ও নি¤œাঞ্চল দখল ও ভরাট, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান দখল, প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দূষণ, ভূ’গর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলন, বায়ু দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, বর্তমান দেশে অস্বাভাবিক গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। দেশের অন্যান্য জেলার মতো ঢাকার তাপমাত্রাও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যার আধিক্য, নি¤œমানের গণপরিবহন, যানবাহন ও জেনারেটরের ধোঁয়া, বিভিন্ন ভবন ও যানবাহনের এসির বাতাস, পাকা ভবন ও রাস্তাঘাট, সবুজ চত্বর ও গাছপালার অভাব, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দূষণ, দখল, ভরাটের ফলে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। বর্তমানে এগুলোর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে এ শহরে যে পরিমাণ নি¤œাঞ্চল রয়েছে তার প্রায় ৭০ ভাগই ভরাট করা হয়েছে। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নি¤œাঞ্চল হারিয়ে যাবে অথচ ব্রিটিশ আমলে ঢাকা উত্তর দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকলেও সবুজ এলাকা শহরের সীমানার ভেতর অন্তর্ভুক্ত ছিল। একটি সবুজ এলাকা শহরের কেন্দ্রে উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। রমনা পার্ক ১৯০৮ সালে এবং সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে একটি আদর্শ নগরীর জন্য ২৫ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে অথচ ঢাকায় শতকরা ৫ ভাগ নতুন ঢাকায় ১২ ভাগ এলাকা সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ২০ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ লক্ষ্যে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। এসব এলাকা সরকারী ও বেসরকারীভাবে দখলের ফলে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। তারা বলছেন, এ বছরে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিবন্ধনকৃত মোটরযানের সংখ্যা ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৩৯৪টি। কংক্রিটের সড়ক ও মোটরচালিত যানবাহন থেকে নির্গত তাপ শহরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের মনিটরিংয়ে দেখা যায় যে, গত ১শ’ বছরে দেশের তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেলেও ঢাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে ২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। গাছপালা একদিকে তাপ শুষে নেয় অন্যদিকে শীতল অক্সিজেন সরবরাহ করে। তারা বলছেন, জলাভূমিও তাপ শোষণ করে অথচ গাছপালা ও জলাভূমি দুটোই ক্রমাগত ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। ফলে রাজধানী ঢাকা উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমেই তা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
×