ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুর রহমান স্বপন

অভিমত ॥ ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ জরুরী

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২০ এপ্রিল ২০১৬

অভিমত ॥ ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ জরুরী

শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। মিনারের প্রধান বেদিতে সভা-সমাবেশ করা যাবে না। ইতোপূর্বে একটি আদেশে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নিকটবর্তী স্থানে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর স্থাপনের। উচ্চ আদালতের আরও একটি আদেশ ঐতিহাসিক। তা হলো : সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানসমূহের যথাযথ সংরক্ষণ করার। যে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, সে দেশের আদালতের এমন রায় সত্যিই যুগান্তকারী এবং গর্বের। ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা যুগে যুগে দেশে দেশে হয়েছে। বাংলাদেশেও হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বদলানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্নসমূহ মুছে ফেলার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী চক্র প্রথমেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার কাজে হাত দেয়। যে স্থানটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেই স্থানটির স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলতে সেখানে স্থাপন করা হয় শিশুপার্ক। এভাবে সারাদেশে যেসব বধ্যভূমি এবং নির্যাতন ক্যাম্প ছিল সেগুলোর চিহ্ন মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হাতে নিহতদের বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ কাজ বন্ধ রাখা হয়। যেসব স্থানে হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদররা মুক্তিকামী বাঙালীর ওপর নির্যাতন চালায় সেগুলোও নষ্ট করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনতার বিকৃত ইতিহাস প্রচার করা হয় সরকারী প্রচার মাধ্যমে এবং শিশুÑকিশোরদের পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে। হাজারো মিথ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা চলে। সম্প্রতি মুজিবনগর গিয়েছিলাম। সফরসঙ্গী ছিলেন প্রিয় বন্ধু দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক চিত্ত ঘোষ, সম্পাদক গোলাম নবি দুলাল, সাংবাদিক কামরুল হুদা হেলাল, হামিদুল হক টুকু, জাহিদ হোসেন এবং সাইদুর রহমান। কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুর তারপর মুজিবনগর হয়ে বৈদ্যনাথতলা পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে শুধু পাটের ক্ষেত। কৃষক এবার পাটের দিকে ঝুঁকেছে। আমরা যখন দুপুর ১২টায় বৈদ্যনাথতলার ঐতিহাসিক আম্রকাননে প্রবেশ করলাম তখন সকলেরই ঘর্মাক্ত শরীর। প্রচ- খরা তাই তীব্র দাবদাহ। ধীর পায়ে আমরা ক’জন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার যেখানে শপথ গ্রহণ করেছিল সেই স্মৃতিসৌধের দিকে পা বাড়ালাম। আম্রকাননের উত্তর-পূর্ব কোনায় উপস্থিত হতেই মধ্যবয়সী এক লোক এগিয়ে এলেন। তার নাম সুভাষ মল্লিক। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এর সাক্ষী। তিনি বললেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান, এম. মনসুর আলী সাহেবরা যখন শপথ নেন তখন তিনি ঘটনাস্থলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাতারে উপস্থিত ছিলেন। সুভাষ মল্লিক গত ২০ বছর যাবত ঐতিহাসিক এই স্মৃতিসৌধ ধোয়া-মোছা ও পরিষ্কার করছেন। এমনকি দর্শনার্থীদের সঙ্গও দিচ্ছেন। সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষায় স্মৃতিসৌধের নির্মাণশৈলীর বিভিন্ন তথ্য তিনি আমাদের জানালেন। সরকার এই ‘গাইড’কে টাকা-পয়সা দেয় না। দর্শনার্থীরা যা দেয় তাতেই তার তিন সদস্যের সংসার চলে। মেহেরপুর উপজেলার ভবেরপাড়া গ্রামের অধিবাসী মৃত অনিল মল্লিকের ছেলে সুভাষ মল্লিক ১৯৬৪ সালে ঢাকাস্থ সেন্ট যোসেফ স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। অর্থাভাবে তিনি আর পড়তে পারেননি। ভাল ইংরেজী বলতে পারেন। তাই বিদেশী দর্শক-পর্যটকদের তিনি সুন্দরভাবে ঐতিহাসিক এই স্মৃতিসৌধের ব্যাখ্যা করেন। ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের ‘গাইড’ এই হচ্ছে সুভাষ মল্লিকের অহঙ্কার। তিনি বললেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুত উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী তখন (যুদ্ধকালীন) ছিলেন মেহেরপুরের এসডিও। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীসহ অনেক সেনা অফিসার সেদিন মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এবং একদল আনসার সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনার প্রদান করেছিলেন। তোপধ্বনি হয়েছিল কামানের গোলায়। আমরা যখন স্মৃতিসৌধের নির্মাণ বিষয়ক গল্প শুনছিলাম তখন কিছু শিশু-কিশোর স্মৃতিসৌধের বেদির উপরে নির্মিত স্তম্ভের ওপর উঠে বসল। সুভাষ মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন এবং তাদের সেখানে থেকে নামতে বললেন। শুধু তাই নয়, তিনি ওই শিশু-কিশোরদের খুবই সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন স্মৃতিসৌধের পবিত্রতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। ওরা খুশি হয়ে অনেকক্ষণ ঘুরে দেখল স্মৃতিসৌধ। ঐতিহাসিক স্থানটিকে স্মৃতিময় করে গড়ে তোলার প্রকল্পটি স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে মুজিবনগরের মানচিত্র প্রকল্পের কাজ। সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ সম্পন্ন করে ঐতিহাসিক স্থানটি সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা জরুরী। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে মুজিবনগরের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্থানটির গুরুত্ব তেমনভাবে দেয়া হয়নি। ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হবে ইতিহাসসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহকে গুরুত্ব দিয়েই। মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরবময় ইতিহাস তা সংরক্ষণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে জানাতে হবে ইতিহাস। যে জাতি ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যত আঁকড়ে ধরেছে তারা তত উন্নত। ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে একটি জাতির গৌরব রক্ষা পায়। ভাল অতীতের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয় ভাল ভবিষ্যত। আমাদের রক্তঝরা ইতিহাস রয়েছে, যা বিশ্বের অনেক জাতির নেই। অথচ আমরা অবহেলায় তা নষ্ট করছি। মুজিবনগরের অসমাপ্ত কাজ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সমাপ্ত করা জরুরী। মানচিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহের যুদ্ধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৭ এপ্রিল যখন মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার শপথ নিচ্ছিল সেদিন পাক হানাদার বাহিনী নগরবাড়ী ঘাটে জল-স্থল এবং আকাশে যুদ্ধ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। হানাদাররা নগরবাড়ী ঘাটের দখল নিয়ে সড়কপথে পাবনা অভিমুখে রওনা হয়। তারা মহাসড়কের দু’পাশের শত শত বাড়িঘর, দোকানপাট পুড়িয়ে অগ্রসর হয়। হত্যা করে কয়েক শ’ নারী-পুরুষকে। পাবনা শহরে প্রবেশ করে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এর দু’দিন পর ১৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে কাশিনাথপুর-বগুড়া মহাসড়কের ডাব বাগানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে। যুদ্ধ হয় এবং কিছু হানাদার সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু বিমান থেকে গুলিবর্ষণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। শহীদ হন ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা। এই যুদ্ধ ছিল পাক হানাদারদের উত্তরবঙ্গে প্রবেশের জন্য জরুরী। বৈদ্যনাথতলার নির্মাণাধীন মানচিত্রে এই উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের উল্লেখ থাকা দরকার। দেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয়েছিল পাবনার বাউশগাড়ি-ডেমড়ায়। এছাড়াও গণহত্যা হয়েছিল সুজানগরের সাতবাড়িয়ায়। বাউশগাড়ি-ডেমড়ায় হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয় ৮ শতাধিক এবং সাতাবাড়িয়ায় নিহত হয় প্রায় ৪শ’ ব্যক্তি। অসমাপ্ত মানচিত্রে এই দু’টি গণহত্যার উল্লেখ নেই। এগুলোসহ দেশের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ এবং গণহত্যার চিত্র উপস্থাপন করা আবশ্যক। মুজিবনগরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে রেললাইন হবে। কারণ ভবিষ্যত বংশধররা ইতিহাস জানতে অবশ্যই ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করবে। এর জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। পোড়াদহ রেলজংশন থেকে মুজিবনগরের দূরত্ব ৫৫ থেকে ৬০ কিঃ মিঃ হবে। এই দূরত্বের রেলপথ নির্মাণ করা হলে উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব রেলের সঙ্গে মুজিবনগরের যোগাযোগ স্থাপন সহজ হবে। ইতিহাস হচ্ছে সময়ের প্রতিবিম্ব। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহকে আটকে রাখতে হয় নিদর্শনের মাধ্যমে। আমরা পরবর্তী বংশধরদের জন্য ইতিহাসকে যদি ধরে রাখতে না পারি তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম হবে দিকভ্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ করার উদ্যোগটি মহৎ, তবে এই জাদুঘর নির্মাণে যারা দান করতে চান তাদের দান নেয়ার বিষয়টিও দেখতে হবে। কারণ যুদ্ধাপরাধীরাও এখন চাইবে জাদুঘরের নির্মাণ কাজে দান করে তাদের নাম এই মহৎ কাজে জুড়ে দিতে। সতর্ক দৃষ্টি না রাখার কারণে ইতোমধ্যেই আমাদের অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। বহু মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক, বুদ্ধিজীবী এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারাতে হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তার চেয়েও কঠিন ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা বাঙালীর আছে। এর জন্য দরকার সঠিক নেতৃত্বের। সত্যকে জানতে হলে ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই অগ্রসর হতে হবে। পৃথিবীর যেসব জাতি ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরেছে তারা সভ্য জাতি হিসেবে শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হয়েছে। আমাদের ত্যাগ, সাফল্য এবং ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সকল তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। মিথ্যাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারীরা সর্বকালে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাদের সমুচিত জবাব দেবে ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। তাই আমাদের বীরত্বের ইতিহাস এবং তার ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ সংরক্ষণ করা জরুরী। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×